জেনোসাইড ডিনায়াল ল’ কেন চাই? কিভাবে চাই?
১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ১২:০৬
আপনারা কি লক্ষ্য করছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশের স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মিমাংসিত ব্যাপারগুলো হেয় করার অপচেষ্টায় তাদের সকল শক্তি দিয়ে লিপ্ত রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এমনকি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরাও ট্রাইব্যুনালের ভেতরে এবং বাইরে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করে আসছে। যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানরা এ দলে রয়েছে।
এরা ৩০ লাখ শহীদদের নিয়ে কটুক্তি করে। বীরাঙ্গণা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটুক্তি করে। বিকৃত রসিকতা করে। কোনও কোনওটি এমনও হয় যা সাধারণের সামনে তুলে ধরাও যায় না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা নিয়মিত তারা এ ধরনের লেখা অহরহ দেখেন।
বছরখানেক আগে মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভারতীয় সৈনিকদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রসঙ্গে সরকারের উদ্যোগ নিয়ে একটি স্ট্যাটাসের কাউন্টার করতে গিয়ে গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড গোলাম আজমের পুত্র আবদুল্লাহ হিল আমান আজমী তার ফেসবুক ওয়ালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৎকালীন কতজন সেনাসদস্য নিহত হয়েছিলেন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। রাজাকারপুত্র আজমীর মতে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে চার হাজার ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার তথ্য আসলে একটি ‘তত্ত্ব’ ছাড়া কিছুই নয়! এত সেনাসদস্য নাকি কোনোভাবে নিহত হতে পারে না।
শুধু এটুকু লিখেই ক্ষান্ত হননি, আরও লিখেছেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘তিন মিলিয়ন শহীদ’ হওয়ার বিষয়টিও একটি কাল্পনিক সংখ্যা!”
তখন সেই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে এই বিতর্ক সেখানেই শেষ হয়নি, আলোচনার আগুনে ঘি ঢালতে নেমে পড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও। আমরা আগেও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, প্রায় প্রত্যেক রাজাকারের বংশধর অন্তর্জালে সক্রিয় থেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রোপাগাণ্ডা চালায়। এসবের পেছনে খরচ করা হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। এতে জড়িত আছে ছাত্র শিবির আর আছে এক শ্রেণির ‘পেইড মিডিয়া’ যারা ক্রমাগত মুক্তিযুদ্ধ, শহীদের সংখ্যা, বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা নিয়ে বিদ্বেষপূর্ণ লেখালেখি করে।
এসব লেখার প্রত্যুত্তর যারা করেন তাদেরও আক্রান্ত হতে হয় এই অপশক্তির হাতে। বাকস্বাধীনতার নামে এসব দেশদ্রোহীদের যাচ্ছেতাই বাক্যের ব্যবহার আজও বন্ধ করতে পারিনি আমরা। এর কারণ মূলত একটাই– আমাদের দেশে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ইতিহাস-বিকৃতি রোধে কোনো আইন নেই।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলা আরেকজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কামারুজ্জামানের পুত্র ওয়ামী। নিরন্তর মুক্তিযুদ্ধের অবমামনা ও হেয় করাই তার কাজ। বাংলা ব্লগিংয়ের প্রথম দিকেই মুক্তিযোদ্ধাদের জামায়াত-বিরোধিতার কারণে তাদের ‘মেরুদণ্ডহীন মুক্তিযোদ্ধা’ বলেছিলেন।
এছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লা বলেছিলেন, “কেউ সুন্দরী নারীর লোভে, কেউ হিন্দুর সম্পদ লুণ্ঠন, কেউ ভারতীয় স্বার্থরক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। কেউই আন্তরিকতা কিংবা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি।”
এই যুদ্ধাপরাধী যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, “দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই এত মাতব্বরি।”
১৯৭১ সালের অপরাধের সাজায় কাদেরের ফাঁসি হয়েছে। তবে ১৯৭১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত একটানা মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের যে অবজ্ঞা-তাচ্ছিল্য তিনি করে গেছেন তার বিচার আমরা করতে পারিনি।
বাংলাদেশ ইসলামিক ইউনিভার্সিটির আইন অনুষদের ডিন এ বি এম মাহবুবুল ইসলাম একবার বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধী হতে হলে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হতে হয়। কিন্তু আমাদের এখানে যুদ্ধ হয়েছে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে। বাংলাদেশ সেই যুদ্ধের অংশ ছিল না। এ কারণে বাংলাদেশে কখনও যুদ্ধাপরাধী ছিল না।
প্রেস ইন্সটিটিউটের সভাপতি সাদেক খান বলেছিলেন, ”একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধাপরাধ করেছে, বিচার করতে হলে দুপক্ষেরই করতে হবে।”
বিএনপির সিনিয়র নেতা গয়েশ্বর রায়ের কথা তো মনে আছে সবার। তার কথা ছিলঃ
“পাকিস্তানের যারা বেতন-ভাতা খাইছে, শেষ দিন পর্যন্ত, তারা (শহীদ বুদ্ধিজীবী) নির্বোধের মতো মারা গেল, আমাদের মতো নির্বোধেরা প্রতিদিন তাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ফুল দেয়। না গেলে আবার পাপ হয়। ওনারা যদি এত বুদ্ধিমান হন, তাহলে ১৪ তারিখ পর্যন্ত নিজের ঘরে থাকেন কী করে, একটু বলেন তো।
এসব লেখা বা মন্তব্য পড়লে আমাদের সাধারণ বাঙালিদেরই রক্ত গরম হয়ে ওঠে। আর যারা একাত্তরে নির্যাতিত হয়েছেন, সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার শিকার যারা তাদের কথা বলার কিছু নেই। দেশদ্রোহীদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের এমন অবমাননার মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণ প্রজন্মসহ সাধারণ মানুষ আর মুক্তিযোদ্ধা-বীরাঙ্গনাদের দাবির প্রেক্ষিতে আজ দরকার একটি সুনির্দিষ্ট Genocide Denial Law।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আইন করে কণ্ঠরোধ করা হবে না তো? মোটেও নয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জাতীয় মীমাংসিত বিষয়াদি নিয়ে বিতর্ক তৈরির চেষ্টা হলে আইনের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর নিধনযজ্ঞ অস্বীকার নিয়ে করা ‘Holocaust Denial Law’ আর তুর্কিদের হাতে ১৫ লাখ আর্মেনিয়ান নিধন অস্বীকার নিয়ে করা ‘Armenian Genocide Denial Law’– যে আইন দুটো শুধু যে জার্মানি আর আর্মেনিয়ায় প্রযোজ্য তা নয়। পৃথিবীর বহু দেশেই ‘হিটলার ভালো মানুষ’, ‘তুর্কিদের হাতে গণহত্যা হয়নি’– এ ধরনের কথা বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আসুন প্রথমেই জেনে নেয়া যাক Genocide Denial আসলে কী?
Genocide Denial অর্থাৎ গণহত্যা অস্বীকার। বক্তব্য, সাহিত্য, বই, লিফলেট, পোস্টার, সমাবেশ, পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, ইন্টারনেট কিংবা যেকোনো মাধ্যমে, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা ব্যক্তিগতভাবে কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত প্রমাণিত এবং স্বীকৃত গণহত্যাকে অস্বীকার করা কিংবা ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে বলাকে Genocide Denial বলে। সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে হিটলারের করা নাৎসি নিধনকে অস্বীকার করা অর্থাৎ Holocaust Denial, আর তুর্কিদের হাতে ১৫ লাখ আর্মেনিয়ান নিধনকে অস্বীকার করা অর্থাৎ Armenian Genocide denial।
Genocide Denial Law আসলে একটা আইন যার মাধ্যমে এরকম প্রমাণিত বিষয় অস্বীকারকারীদের জেল-জরিমানা করা হয়। মজার বিষয় হচ্ছে এই আইন শুধু যে জার্মান আর আর্মেনিয়ায় প্রযোজ্য তা কিন্তু নয়। পৃথিবীর বহু দেশেই ‘হিটলার ভালো মানুষ’, ‘তুর্কীদের হাতে গণহত্যা হয়নি’ এ ধরনের কথা বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই আইনের কয়েকটি উদাহরণ:
National Socialism Prohibition Law অনুসারে অস্ট্রিয়ায় ন্যাশনাল সোশ্যালিস্টদের গণহত্যার ইতিহাস অস্বীকার বা তাদের অপরাধ হালকা করা চেষ্টা, অন্য কারো করা এ জাতীয় কাজ সমর্থন অথবা ন্যাশনাল সোশ্যালিস্টদের কোনো কাজের বৈধতা খোঁজার কোনো চেষ্টা কোনো ধরনের মিডিয়ায় প্রকাশ করা যাবে না। যদি কেউ করে তাকে দেয়া হয় ১ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড।
এছাড়া বেলজিয়ামের Negationism Law অনুসারে জার্মানির ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট আমলের গণহত্যার ব্যাপ্তি হালকা করা চেষ্টা, সমর্থন বা বৈধতাদানের সকল চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই আইনে শাস্তির মেয়াদ ৮ দিন থেকে ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও সেইসঙ্গে ৫ থেকে ২৬ হাজার ফ্রাঙ্ক জরিমানা।
চেক রিপাবলিকে এই আইনের নাম Law Against Support and Dissemination of Movements Oppressing Human Rights and Freedoms নাৎসি গণহত্যার ইতিহাস অস্বীকার, সন্দেহ, অনুমোদন/স্বীকৃতি বা তাদের কাজের বৈধতা দেবার চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই আইনে শাস্তি ৬ মাস থেকে ৩ বছরের কারাদণ্ড।
জার্মানির 130 Public Incitement অনুসারে (1985, Revised 1992, 2002, 2005) জনসমক্ষে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট আমলের অপরাধসমূহ অস্বীকার, সমর্থন বা তাদের অপরাধ লঘুকরণের চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। এ সংক্রান্ত কোনো সিম্বল প্রচার ও প্রদর্শন করাও দণ্ডনীয় অপরাধ। শাস্তি ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং/অথবা জরিমানা।
লুক্সেমবুর্গ Criminal Code, Act of 19 July 1997 অনুসারে ১৯৪৫ সালের আন্তর্জাতিক ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত যুদ্ধাপরাধ অস্বীকার, সমর্থন, লঘুকরণের প্রচেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই আইনে শাস্তির মেয়াদ ৮ দিন থেকে ৬ মাস কারাদণ্ড।
রোমানিয়ায় Emergency Ordinance No. 31 of March 13, 2002 অনুসারে গণহত্যার ইতিহাস অস্বীকার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রেসিস্ট, জেনোফোবিক বা ফ্যাসিস্ট সিম্বল প্রচার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। শাস্তি ৬ মাস থেকে ৫ বছর কারাদণ্ড (কিছু আইনসঙ্গত অধিকার রহিতকরণসহ)।
ফ্রান্সে LAW No 90-615 to repress acts of racism, anti-semitism and xenophobia (1990) ১৯৪৫-অনুসারে লন্ডন চার্টার এর আওতাভুক্ত অপরাধসমূহের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ বা প্রশ্ন উত্থাপন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এতে শাস্তির মেয়াদ ১ মাস থেকে ১ বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা।
আইন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেলো, এবার জানা যাক এই আইনের কিছু প্রয়োগ সম্পর্কে। আসুন এই অপরাধে শাস্তির কয়েকটা উদাহরণ দেখা যাক:
আর্মেনিয়ার গণহত্যাকে অস্বীকার করায় বার্নাড লুইস নামের এক সাংবাদিককে ফ্রান্সের এক আদালত এক ফেন্স জরিমানা করে ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে। একই কায়দায় রবার্ট ফিউসন নামের এক ব্যাক্তিকে আর্মেনিয়ার গণহত্যাকে অস্বীকার করায় ৩ মাসের জেল এবং ৭০০০ ইউরো জরিমানা করা হয়। এছাড়া গ্যাস চেম্বার-কে অস্বীকার করায় প্রখ্যাত লেখক গেস্টন আরমারকে এক সুইস আদালত ছয় বছরের কারাদণ্ড দেয়।
‘জর্জি ন্যাগি’ নামের এক কম্পিউটার প্রকৌশলী। ২০১১ সালের ২৩শে অক্টোবর হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের একটি রাজনৈতিক র্যালির মধ্যে ন্যাগির হাতে ধরা ছিলো একটি প্ল্যাকার্ড। যেখানে খুব স্পষ্ট করে সে লিখে রেখেছিলো ‘হলোকাস্ট নামের কিছু হয়নি’। সাথে সাথেই পুলিশ ন্যাগিকে গ্রেফতার করে সেই র্যালি থেকে। এখানে উল্লেখ্য যে হাঙ্গেরি সরকার ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই হলোকাস্ট [The Holocaust was the mass murder of six million Jews and millions of other people leading up to, and during, World War II] অস্বীকার করবার বিরুদ্ধে একটি আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের মাধ্যমে আদালত ন্যাগিকে ১৮ মাসের সাস্পেন্ডেড জেল দেয়। এছাড়া আদালত নির্দেশ দেয় যে ন্যাগিকে হাঙ্গেরির হলোকাস্ট মেমোরিয়াল জাদুঘর, বুদাপেস্ট, পোল্যান্ডের Auschwitz death camp -এদের মধ্যে যেকোনো একটা তাকে ঘুরে দেখতে হবে।
জার্মানির স্কুলে সব ছাত্রছাত্রীদের অবশ্যপাঠ্য নাৎসি ইতিহাস। সেখানে তুলে ধরা হয়, কেন হিটলার ও তার ফ্যাসিবাদ মানব সভ্যতার জন্য অভিশাপ নিয়ে এসেছিলো। কেন নাৎসি বাহিনীর আদর্শ মানবতাবিরোধী ছিল, কেন সব জার্মান নাগরিককে সচেতন হতে হবে, যেন এমন ঘটনার আর কখনোই পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
আজ থেকে একশ বছর আগে ঘটে যাওয়া বিস্মৃত গণহত্যা নিয়ে বাজে কথা বললে আজ জেল জরিমানা হয়, অথচ এই বাজে কথা শোনার জন্য কোনো ভিকটিম/নির্যাতিত মানুষের পরিবারের কেউই হয়তো বেঁচে নেই। আর আমাদের দেশে এখনো পায়ে গুলি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে আছেন, ধর্ষণের বীজ নিয়ে বীরাঙ্গনারা বেঁচে আছেন, শহিদ বুদ্ধিজীবীর শার্ট বুকে নিয়ে তার সন্তান বেঁচে আছেন। তবুও এই আধুনিক সভ্যতায় পুরো মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করলেও কিচ্ছু যায় আসে না। এই দেশে জাতির জনককে অবমাননা করলে শাস্তি হয় অথচ যেই মুক্তিযুদ্ধ না হলে ‘জাতির জনক’ কখনোই হয়ত ‘জাতির জনক’ হতেন না, সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাজে কথা বললে, অবমাননা করলে, তিরস্কার করলে কিছুই হয় না।
মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করে এই ধরনের লেখালেখি যে আদতে এক ধরনের অপরাধ, সেটা আমাদের বিচারিক আদালতে প্রমাণ করতে পারটাই এখন সময়ের দাবি। আশার একটা ক্ষীণ আলো দেখছি— কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যেমন ফেসবুক, টুইটার, ব্লগে Bangladesh Genocide Denial আইনের পক্ষে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু আলোর পেছনেই অন্ধকার থাকে। আর বাঙালি তো, তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরাই।
আমাদের খুবই ভালো করে লক্ষ্য রাখতে হবে এই আইনটার ব্যাখ্যা যেন একেবারেই সুনির্দিষ্ট হয়। কোনো ভাবেই যেন আইনটা বিস্তৃত ব্যাখ্যার আইনের দিকে না যায়। হতে পারে একেবারেই নির্দিষ্ট কিছু শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা যেমন—
১) ৩০ লক্ষ শহিদ অস্বীকার করা
২) সর্বনিম্ন ২ লক্ষ বীরাঙ্গনাদের অস্বীকার করা
৩) ১৯৭১ সালে সংগঠিত গণহত্যাকে অস্বীকার করা
৪) ‘মুক্তিযুদ্ধ কোনো যুদ্ধ নয়’ বলা
৫) ‘জামায়াত কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধ করেনি’ বলা
৬) ‘রাজাকার/আল-বদর/আল-শামস নামক দল আন্তর্জাতিক অপরাধ করেনি’ বলা
৭) স্বাধীনতা নিয়ে রসিকতা করা
৮) ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে সিভিল ওয়ার কিংবা গৃহযুদ্ধ বলা
৯) বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করা
এরকম আরও কিছু সুনির্দিষ্ট বাক্য।
কারণ কোনো ভাবেই যদি এটার সেন্স বিস্তৃত হয়ে যায় তাহলে হয়ত এই আইন বুমেরাং হয়ে ফিরতে পারে আমাদের দিকেই। কোনো সরকার চাইলেই যেন এই আইনকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে। তাই আবারো বলছি, আইনটা যেন হয় কিছু সুনির্দিষ্ট বাক্যের ব্যবহার। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি ব্যাপারটা এমন হয় যে এই আইনে বলা হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা হয় এমন কথা বলা অপরাধ’ তখন ব্যাপারটা বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সেন্স অনেকের কাছে অনেক রকম। ‘মুক্তিযুদ্ধ অবমাননা’ বাক্যের হাজারটা ইন্টারপ্রিটেশান সম্ভব। জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘সবাই একটি ফুল-কে বাঁচাতে যুদ্ধে যায় নি’ কথাটা মনে রাখা দরকার। মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন তাই এই যুদ্ধের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনেক গভীর। আমি সেই ভার আইনজ্ঞ আর আইনের ছাত্রদের হাতেই ছেড়ে দেব। একটা কথাই বলতে চাই, শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে এই আইনের কারণে আদালতে দাঁড়াতে হয়েছে— এই দৃশ্য যেন আমাদের দেখতে না হয়।
এই আইন আমাদের রক্ত দিয়ে অর্জিত ইতিহাসকে নানাবিধ উদ্ভট ন্যারেটিভ ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করবার সমস্ত সুযোগ নস্যাৎ করবে। আমরা চাই আমার মাটিতে থেকে আমার মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করে, আমাদের শহিদদের অবমাননা করে, আমার বীরাঙ্গনাদের অপমান করে কেউ যেন আর মাথা উঁচু করে ঘুরতে না পারে।
তথ্যসূত্রঃ
১)sachalayatan.com/node/48186, ২)bangla.bdnews24.com/CitizenJournalism/article952903.bdnews
৩)antisemitism.org.il/eng/Legislation%20Against%20Antisemitism%20and%20Denial%20of%20the%20Holocaust
৪)genocidepreventionnow.org/Home/GPNISSUES/GPNBulletinLAWSAGAINSTDENIALSpecialSection9/tabid/164/ctl/DisplayArticle/mid/971/aid/470/Default.aspx
৫) ইতিহাস-বিকৃতিরোধে আইন করার এখনই সময়– ডাঃ নুজহাত চৌধুরী
৬)en.wikipedia.org/wiki/Genocide_denial
৭)bhorerkagoj.net/print-edition/2016/08/24/103833.php
৮)ntvbd.com/opinion/36420/কী-থাকছে-ডিজিটাল-নিরাপত্তা-আইনে
৯)prothom-alo.com/bangladesh/article/737050/ডিজিটাল-নিরাপত্তা-আইন-হচ্ছে-৫৭-ধারা-থাকছে-না
১০)banglatribune.com/columns/opinion/137199/ডিজিটাল-নিরাপত্তা-আইন-নতুন-তর্কের-খোরাক
১১)kalerkantho.com/print-edition/first-page/2016/03/23/339231
১২)sachalayatan.com/nazrul_islam/55753
সারাবাংলা/এমএম