Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কাঁদছে চট্টগ্রাম!


১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ১২:৩৬

আপোষকামীতা তার চরিত্রে ছিলনা। তার একটা বড় উদাহরণ-চট্টগ্রাম বন্দরে আমেরিকান প্রতিষ্ঠান এসএসএ’র টার্মিনাল নির্মাণ ঠেকিয়ে দেয়া। ১৯৯৯-২০০০ সালের কথা। তখন তার দল ক্ষমতায়। সেই সরকারই এসএসএ-কে টার্মিনাল নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিও ছিল। কিন্তু বেঁকে বসেন মহিউদ্দিন। গড়ে তোলেন আন্দোলন। তার যুক্তি, কর্ণফুলির মোহনায় কোন বিদেশী প্রতিষ্ঠান টার্মিনাল করতে পারবেনা। কারণ, তাতে চট্টগ্রাম বন্দর এবং দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। শেষপর্যন্ত তাঁর যুক্তিই মেনে নেয় সরকার। সেই টার্মিনাল আর হয়নি।

বিজ্ঞাপন

মহিউদ্দিন চৌধুরীর এমন রাজনৈতিক গোয়ার্তুমির উদহারণ আরও রয়েছে। আর এসব করার সময় তার সরকার না ভিন্ন দলের সরকার ক্ষমতায় সেসব মাথায় রাখেননি। মানুষের কথা, চট্টগ্রামের স্বার্থ আগে ভেবেছেন। দেখা গেছে, শেষঅবধি তার যুক্তিই সবাই মেনে নিয়েছেন। তার যুক্তিই সঠিক ছিল। সবশেষ উদাহরণটি ছিল, গৃহকর। বর্তমান মেয়র তার দলের। দলে তার রানিংমেট। কিন্তু, গৃহকর অযৌক্তিক দাবি করে নেমে পড়েন আন্দোলনে। কথা বলেন দলের মেয়রের বিরুদ্ধে। তার কথা, এই বাড়তি গৃহকর মানুষকে বেকায়দায় ফেলবে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে। বর্তমান মেয়র সেসব মানতে চাননি। তবে, এই আন্দোলনের একপর্যায়েই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেষে দেখা গেল, মহিউদ্দিনের যুক্তিই মেনে নিয়েছে সরকার। গৃহকর মূল্যায়ন স্থগিত করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এভাবে মহিউদ্দিন বারবার জিতেছেন। মানুষের কথা বলে জিতেছেন। মানুষের পক্ষে থেকে জিতেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিতেছেন। সংকটের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে সমাধান এনে দিয়েছেন।

অথচ, তার জীবনটা এমন সহজ-সরল ছিলনা। জন্মেছেন রাউজানের গহিরায় ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর। রেলের চাকুরে বাবার আট সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। বাবার চাকুরি সূত্রে তার স্কুল জীবন কেটেছে দেশের নানা জায়গায়। সবশেষ উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কিন্তু এই ধরাবাধা জীবনে তার কখনো মৃসণ কাটেনি। ছাত্রজীবনেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। এরপর এলো বাঙালির অহংকারের মুক্তিযুদ্ধ। অসম সাহসে ঝাপিয়ে পড়েন সেই যুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বীরত্বগাঁথা সহযোদ্ধারা এখনো গর্ব ভরে বলেন। কত উপায়ে কত কৌশলে পাক হায়েনাদের বিভ্রান্ত করেছেন। লড়েছেন।

স্বাধীনতার পর তিনি জড়িয়ে পড়েন শ্রমিক আন্দোলনে। রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এটা তার জন্য বড় টার্নিং পয়েন্ট। কারণ, শ্রমিক আন্দোলনেই মানুষ মহিউদ্দিনকে চেনেন নতুন করে। সাহচর্য পান বঙ্গবন্ধুর সহচর জহুর আহমদ চৌধুরীর। অনেকে বলেন, মহিউদ্দিন জহুর আহমদ চৌধুরীর শীষ্য। সেই সুবাদে বঙ্গবন্ধুরও স্নেহধন্য। বঙ্গবন্ধু নাকি চট্টগ্রাম এলে আগে জিজ্ঞেস করতেন, আমার মহিউদ্দিন কই? সেই মুহিউদ্দিনের জীবনে কালো অধ্যায় নামিয়ে আনে জাতির জনকের হত্যা। সারাদেশের মধ্যে তিনিই প্রথম রাজপথে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেন। সংগঠিত করেন তরুণদের। রীতিমত বিভীষিকাময় করে তোলেন তখনকার সরকারকে। শেষে সরকারের অত্যাচারে জেল জুলুম সহ্য করেছেন। পালিয়ে ভারতে থেকেছেন আত্মগোপনে। সেখানকার জীবন আরেক সংগ্রামের। পত্রিকা বিক্রি করেছেন কলকাতার পথে পথে। কাজ করেছেন রেস্টুরেন্টে।

এমন জীবন শেষে আবারও ফেরেন দেশে। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে ১৯৯৪ সালে হয়েছেন চট্টগ্রামের সিটি মেয়র। দায়িত্বে ছিলেন টানা ১৬ বছর। সেই সময়টি চট্টগ্রামের জন্য বলা চলে স্বর্ণযুগ। কারণ কিছু সংস্কার আর উন্নয়নে তিনি চট্টগ্রামকে রোলমডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন। বদলে ফেলেছিলেন চট্টগ্রামের চেহারা। এখনো মানুষ চট্টগ্রামের যেই চেহারার প্রশংসা করেন, সেটি মহিউদ্দিনের গড়ে তোলা।

মহিউদ্দিনর ষোলশহরের চশমাহিলের বাড়িটিকে কেউ কেউ মজা করে বলেন লঙ্গরখানা। বলার যথেষ্ট কারণও আছে। তার বাড়িটিতে প্রতিদিন ২০০-২৫০ মানুষের খাওয়া হয়। গরুর মাংস আর সাদাভাতের এই আয়োজনে রোজ নেতা-কর্মী ছাড়াও অনায়াসে খেয়ে পারেন যে কেউ। তার বাড়িতে গিয়ে কেউ না খেয়ে ফিরেছেন এমন উদাহরণ বিরল। কেউ গেলে আগে খাওয়া। তারপর আলাপ।

মহিউদ্দিন চৌধুরী এতটাই মুজিব অন্তপ্রাণ ছিলেন প্রতিবছর নেতার শাহাদাতবার্ষিকীতে টু্ঙিগপাড়ায় ৩০ হাজার মানুষের জন্য মেজবান দিতেন। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করতেন। এমন উদাহারণ কজন নেতার আছে! মহিউদ্দিন চৌধুরী বাসায় ক্যাজুয়াল পোশাকে থাকতেন ঠিকই কিন্তু কেউ কখনো সাক্ষাতকার নিতে গেলে মুজিবকোট ছাড়া ক্যামেরার সামনে বসতেননা। মুজিব-হাসিনা ছিল তার অন্তরাত্মা। সবকিছুর উপরে এ দুজন তার কাছে। দলের নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে কখনো কখনো মনক্ষুন্ন হয়েছেন। কিন্তু মুজিবকন্যা বিমূখ হননি। মুজিবকন্যা তার কাছে সবকিছুর ওপরে।

কেউ কেউ বলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী বদমেজাজী। সেটা যারা বলেন, তারা কেউই মহিউদ্দিনের পালস জানেননি। কারণ, তার স্বভাবটিই ছিল শাসনের সুরে বুকে টেনে নেয়া। আদর-ভালবাসা দেয়া। সেজন্যই তিনি আওয়ামী লীগের নেতা হলেও তাতে গন্ডিবদ্ধ থাকেননি। সব দলের নেতাকর্মীদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মহিউদ্দিন ভাই। পারিবারিক অনুষ্ঠান, সামাজিক কোন আয়োজন, বিয়ে-মৃত্যু এসবে কখনো দলীয় পরিচয় দেখেননি, খবর পেলেই সবার আগে হাজির মহিউদ্দিন চৌধুরী। রাজনীতিতে কখনোই প্রতিহিংসার বেড়াজাল তৈরি করেননি। সেকারণেই সবশেষ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর, তার সুস্থতা কামনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সরব দেখা গেছে অন্য দলের নেতাকর্মীদের। কায়মনোবাক্যে প্রার্থণা করেছেন সবাই। এটাই মহিউদ্দিনের ভালবাসার রহস্য। এটাই মহিউদ্দিন চৌধুরী।

১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরি দুর্যোগে পচাগলা লাশ বহনে অগ্রভাবে মহিউদ্দিন চৌধুরী, কেটিএস গার্মেন্টসে আগুনে মাংসপিন্ডে পরিণত হওয়া ৬৫টি লাশও মহিউদ্দিনের কাঁধে। তাঁর কাঁধটি সবার জন্য এমনই নির্ভরতার ছিল। তাইতো তিনি হয়ে উঠেছিলেন আকাশ সমান।

স্বৈরাচার, স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকে হঠাতে অগ্রভাবে মহিউদ্দিন। মানুষের অধিকার আদায়ে মহিউদ্দিন। এতসব যিনি অনায়াসে সামলান সেই তিনিই রয়ে গেলেন চট্টগ্রামের হয়ে। দলীয় প্রধান বহুবার বহুভাবে তাকে জাতীয়ভাবে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, যাননি। তিনি থেকে যেতে চেয়েছেন চট্টগ্রামের মানুষের ভালবাসা বুক আঁকড়ে। থেকেছেনও শেষ পর্যন্ত। অসুস্থ হয়ে ঢাকা-সিঙ্গাপুর ঘুরে একমাস কাটিয়ে এসে শেষ পর্যন্ত চিরশান্তির ঘুম দিলেন তার প্রিয় চাঁটগাঁয়। বঙ্গবন্ধুর পরে এমন মাটি অন্তঃপ্রাণ নেতা আর কখনো দেখেছে কেউ!

দেখেনি বলেইতো শেষ শয্যার সময় ম্যাক্স হাসপাতাল ঘিরে প্রিয় নেতার ফিরে আসার আশায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে কয়েক হাজার নেতাকর্মী। সাধারণ মানুষ। শেষ খবর শুনে মাতমে মাতমে আকাশ বাতাস কাঁপিয়েছে। এ এক অন্যরকম আবেগ। যে আবেগ কেবল একজনই ধারণ করতে পারেন। একজনকেই মানায়। তিনি চট্টলবীর। যার কাছে রাজনৈতিক পরিচয় আর মূখ্য নয়। থাকেনা। সেকারণেইতো চট্টগ্রাম কাঁদছে।

কামাল পারভেজ : আঞ্চলিক সম্পাদক, চ্যানেল টুয়েন্টিফোর

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর