Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে মুক্তির সংগ্রাম

প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ
২৬ মার্চ ২০২২ ১০:৫০

১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ। চারদিকে উত্তাল। ওই সময়টায় বাঙালির জাতীয় জীবন ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ও ঊর্মিসঙ্কুল। আর এমন প্রেক্ষাপটে বাঙলার মানুষের মনে স্বাধীনতার বীজ বপন করে স্বাধীনতার জন্য সবাইকে প্রস্তুত করে তোলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত বাঙালির প্রতি ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ‘যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে’ আহ্বান জানান তিনি।

বিজ্ঞাপন

বাঙলার আপামর জনসাধারণ তার সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে তোলে। জীবন দিয়ে রুখে দেয় দখলদার শাসকগোষ্ঠীর সকল ষড়যন্ত্র। ‘কৃত্রিম রাষ্ট্র’ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ২৩ বছর পর ১৯৭০ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনের ফলাফল ছিল আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছয় দফা কর্মসূচির প্রতি জনগণের ম্যান্ডেট। নির্বাচনের আগে ও পরে বঙ্গবন্ধু সভা-সমাবেশে বলেছেন, ‘আমার ছয় দফা যেহেতু জনগণ গ্রহণ করেছে, সুতরাং তা পরিবর্তন–সংশোধন করার অধিকার আমার নাই। পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি এবং সেখানকার সামরিক–বেসামরিক আমলাদের কাছে ছয় দফা ছিল বিছুটির মতো, যা তাদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিত।’

বিজ্ঞাপন

ইতিহাস বলে, ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ায় জানুয়ারিতেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসতে পারত, কিন্তু তৎকালীন সরকার ও পিপলস পার্টি-মুসলিম লীগ ষড়যন্ত্র করে পিছিয়ে দেয়। ৩রা মার্চ অধিবেশন আহ্বান করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ তাতে আপত্তি করেনি, বরং অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। তবে সাধারণ মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিল এবং উপলব্ধি করতে পারছিল যে— একটা ষড়যন্ত্র চলছে, যাতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে না পারে। ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ শুরু করে। সরকারও চালাচ্ছিল দমননীতি। এমতাবস্থায় বহু মানুষ পুলিশ-বিডিআরের গুলিতে নিহত হয়।

এরই মাঝে পুরো পাকিস্তানে দ্বিতীয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই দায়িত্ব-জ্ঞানহীন, অসংযত ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। তিনি ঢাকায় পরিষদের অধিবেশনে যোগ না দেয়ার হুমকিও দিচ্ছিলেন। আরও এমন সব উক্তি করছিলেন, যা তার মতো আধুনিক শিক্ষিত মানুষ নয়, অপ্রকৃতিস্থ লোকের পক্ষেই কেবল সম্ভব। ভুট্টো বলছিলেন, তার দলের এমপিরা ঢাকা এলে তাদের হত্যা করা হবে। অথচ তখন পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো কোনো দলের এমপি ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ভুট্টোর এমন বক্তব্য অস্বাভাবিক ও অসম্ভব।

এদিকে পরিষদের অধিবেশন বসার নির্ধারিত তারিখ ৩রা মার্চ, তার ৩ দিন আগে অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বঙ্গবন্ধুকে এক সংবর্ধনা দেয়। সেখানে তিনি এক দীর্ঘ নীতি-নির্ধারণী ভাষণ দেন। তার দলের নীতি ও কর্মসূচি ব্যাখ্যা করেন। ভুট্টোর অমূলক কথাবার্তার জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের সব এমপিরা বসে আলোচনা করে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো দলের একজন এমপি-ও যদি যুক্তিযুক্ত কথা বলেন, তা আমরা গ্রহণ করব। আমাদের ছয় দফা কারও ওপর চাপিয়ে দেব না।’ অর্থনৈতিক প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বলেন, তার সরকার ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি’ গ্রহণ করবে, বাংলাদেশে আর কোনো ‘২২ পরিবার’ হতে দেবে না।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নেতা নির্বাচিত হন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগের সব সদস্যের বৈঠক বসে ১ মার্চ সকালে পূর্বাণী হোটেলে। একদিন পরই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসতে যাচ্ছে। চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এমপিরা। রাজনৈতিক মহলে শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল যে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। পূর্বাণী হোটেলে বৈঠক চলাকালেই খবর আসে, সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছেন।

মূলত এটা ছিল পাকিস্তানে গণতন্ত্রের মাথায় বজ্রাঘাত। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বরাবরই ছিল নিপীড়িত ও নিগৃহীত। তাদের একটা অপ্রাপ্তি ছিল সবক্ষেত্রেই। এর মাঝে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা বাঙালিরা সৃষ্টি করেনি, ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সৃষ্টি। কিন্তু ইয়াহিয়া দুষছিলেন শেখ মুজিবকে, এদেশের মানুষকে।

ইয়াহিয়া বলেন, দেশ বর্তমানে গভীরতম রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে। কয়েক সপ্তাহ আলোচনার পরও রাজনৈতিক দলগুলো মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পরিষদের অধিবেশনে যোগ না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অযাচিতভাবে সামরিক জান্তার প্রধান আরও বলেন, ‘ভারত অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যা পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে।’ সব সমস্যার মূলে ভুট্টো হলেও তাকে দোষারোপ না করে উল্টো ভারতের ওপর দোষ চাপান ইয়াহিয়া। তবে সূত্র অনুযায়ী, তখন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের কোনো রকম প্রভাব বিস্তারের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

পূর্বেই বলেছি মার্চ বাঙালির জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাসের শুরু অর্থাৎ ২রা মার্চ থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো বাংলাদেশের প্রশাসন চলছিল। এর মধ্যে ২৫ শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন ইয়াহিয়া। দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি ঢাকা আসেন তার উপদেষ্টাদের নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতে।

কয়েক দিন ধরে তাদের মধ্যে বৈঠক হয়। বাইরে রাজপথে স্বাধীনতাকামীদের উত্তাল আন্দোলন ও সম্ভাব্য আক্রমণের প্রতিরোধের প্রস্তুতিও চলে। ২১শে মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা আসেন। বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। আর এই সময়ে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও গোলাবারুদ আসছিল পূর্ব-পাকিস্তানে। বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহাকে স্তব্ধ করে দিতে গণহত্যার প্রস্তুতি নেয় ইয়াহিয়া–ভুট্টো চক্রও। ২২–২৫শে মার্চ অনুষ্ঠেয় অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙলার মানুষ।

২৩ শে মার্চ ছিল ‘পাকিস্তান দিবস’। ওইদিন বাংলাদেশের সর্বত্র ‘স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা’ উত্তোলন করা হয়। বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধের প্রতিবাদে ২৭শে মার্চ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেন। তবে এর আগেই ২৫শে মার্চে রাতের আঁধারে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে দখলদার পাকিস্তানের সৈন্যরা। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার শুরুর রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়।

যদি এর আগেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আচরণ দেখেই কিছু একটা হতে যাচ্ছে-এমনটা আশঙ্কা করছিলেন রাজনৈতিক মহল। তাই বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে অনেকেই তাকে ২৫শে মার্চ সন্ধ্যারাতে আত্মগোপনে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেননি। তিনি তার ধানমন্ডির বাসভবনেই অবস্থান করেন। এই পর্যায়ে বলা যায়, আত্মগোপনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল তার জীবনের সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত। কারণ তার এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়, তিনি যে একজন গণতান্ত্রিক নেতা এবং সাহসের সঙ্গে সাংবিধানিক উপায়েই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চান। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ধরনও ছিল তা-ই। মানুষের অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে বারবার কারাবরণ করেছেন।

এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য, ‘আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। কারণ, আমি গোপন রাজনীতি পছন্দ করি না, আর বিশ্বাসও করি না।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৩৪)। তাছাড়া তিনি জানতেন যে, কোনো নেতা পালিয়ে বা আত্মগোপনে থেকে সংগ্রাম করে সফল হয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই। তাই তো জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে গ্রেপ্তার হন তিনি। তাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে বন্দি রাখায় বিশ্বজনমত যায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। স্বার্থান্বেষী কয়েকটি দেশ বাদে সবার সমর্থন পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা। ’৪৭-এ দেশ ভাগের পর মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য যে সংগ্রামের সূচনা করেন, সেটাকে ক্রমেই এগিয়ে নিয়ে যান স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের দিকে। পাকিস্তানি শোষক ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র, মামলা, জেল-জুলুম মোকাবিলা করে ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই জোরদার করেন গণতান্ত্রিক আন্দোলন। সাত কোটি বাঙালির প্রত্যেকে পরিণত হয় একেকটি যোদ্ধায়।

প্রতিদিনই নতুন নতুন নির্দেশনা দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য জাতিকে গড়ে তোলেন। ন’মাস যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ ও মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে শৃঙ্খলমুক্ত হয় বাংলা। অর্জিত হয় চিরকাঙ্খিত স্বাধীনতা। আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে পরিচিত হই বিশ্বদরবারে। সেই থেকে স্মৃতিময় ২৬শে মার্চ আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা দিবস। প্রায় অর্ধশত বছর আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেশকে দখলদারমুক্ত করার সংগ্রামে নামার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তার নির্দেশমতো ‘যার যা আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’য় যুদ্ধ অবতীর্ণ হয় বাঙালি। এবার আসুন—আমরা তার কন্যার ডাকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সবাই একযোগে কাজ করি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; জামালপুর

সারাবাংলা/এসবিডিই

প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ মত-দ্বিমত স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে মুক্তির সংগ্রাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর