স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু
২৬ মার্চ ২০২২ ১২:৩০
আজ স্বদেশপ্রেমে দেশবাসীর উদ্বুদ্ধ হওয়ার দিন। বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবের দিন। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর অনন্যসাধারণ এক দিন। বাঙালি জাতির জীবনে বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর দিন। সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জাগানিয়া দিন। স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনার এই সময়টি জাতি নিবিড় আবেগের সঙ্গে স্মরণ করে। ১৯৭১ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন দেশবাসীকে। সেই ঘোষণার আলোকেই মরণপণ লড়াই এবং রক্তসমুদ্র পাড়ি দিয়ে বীর বাঙালি ছিনিয়ে আনে জাতীয় ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরব ও অহংকারের দিন আজ ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতার ৫০তম বছর। এবারের স্বাধীনতা দিবস এসেছে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর বছরেই স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। এবারে এ দিনটি জাতির সামনে এক অন্যরকম আনন্দঘন অনুভূতি নিয়ে এসেছে।
স্বাধীনতা মানুষের সর্বাপেক্ষা কাম্য বস্তু। স্বাধীনতা লাভের জন্য বাঙালি জনগণ বহুদিন ধরে আকুল ছিল। পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেয়ে উপমহাদেশের জনগণ পেয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান দু’টো রাষ্ট্র। এরপর শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাঙালিদের নতুন করে শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেঁধে রাখার ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানি হানাদারদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি জাতি। বাঙালি জাতিকে মুক্তির মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে ধাপে ধাপে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যান ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ’৪৮-এ বাংলা ভাষার দাবীতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পথ বেয়ে ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালি প্রথম জেগে উঠে ৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি। ফাগুনের আগুনে ভাষা আন্দোলনের দাবি আর উন্মাতাল গণমানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত একাকার হয়ে যায় সেদিন। ভাষার জন্য প্রথম জীবনদান বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে। সেই থেকে শুরু বাঙালির শেকল ভাঙার লড়াই।
পলাশীর অম্রকাননে হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতার লাল সূর্য আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত হয়ে দেখা দেয় বাংলার আকাশে। ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ’৫৬-এর সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, ’৫৮-এর মার্শাল ’ল বিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফার আন্দোলন, ৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থান, ৬-দফা ভিত্তিক আন্দোলন। এরপর ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বিশাল জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু বজ্রকন্ঠে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা’ খ্যাত কালজয়ী ঐতিহাসিক ভাষণ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন প্রভূত ঘটনা প্রবাহের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। উত্তাল একাত্তরে চিরতরে বাঙালির পরাধীনতার শেকল মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। মূলত সেদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় মুক্তির সংগ্রাম।
২০১৬ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের সংবিধানের উপক্রমণিকায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে বাংলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জনসভায় এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হইবার ডাক দেন এবং ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ উপক্রমণিকায় আরও বলা হয়েছে, রক্তপাতহীন স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এবং রাজনৈতিক নেতাদের সহিত ঢাকায় আলোচনায় বসেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্বাধিকারের দাবিতে জেগে ওঠা নিরীহ বাঙালির ওপর চালিয়েছিল নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ঢাকাসহ সারাদেশে ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলার মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে বিভীষিকাময় যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। শুরু হয় বাঙালি নিধনযজ্ঞ। বাঙালিদের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়। সে ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করার জন্য দেশবাসীকে অনুরোধ ও নির্দেশ দেন। তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেস থেকে সে বার্তা ছড়িয়ে যায় দেশের সর্বত্র। “এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে”—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো শেষ তারবার্তা।
স্বাধীনতা, বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একই বৃন্তে চেতনার ফুল। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেদিনই ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে মরণপণ ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরো বাঙালি জাতি। অন্যদিকে, পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর আল শামসদের নৃশংস তাণ্ডবে এক কোটি বাঙালি শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। দল মত নির্বিশেষে ভারতের প্রতিটি জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন ও সহায়তা করায় বাঙালি আজও তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। মুক্তি পাগল বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতার রক্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে বলে ভারতে প্রশিক্ষণ নেয়। অস্ত্র কাঁধে তুলে নেয়। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, কামার-কুমার সবাই শরিক হয় মুক্তির এ লড়াইয়ে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হানাদারদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্বকে বিস্মিত করে দেয় বাংলা মায়ের অকুতোভয় সন্তানরা। বিশ্বের মানচিত্রে অঙ্কিত হয় নতুন দেশ- বাংলাদেশ। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি প্রথমবারের মতো পায় তার নিজস্ব ভূখণ্ড এবং মহার্ঘ্য স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের এই ধারাবাহিক সংগ্রামে জীবনের ৪ হাজার ৬৭৫ দিন জেলে কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। জুলুম-হুলিয়া, শত যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্ট, বেদনাকে সহ্য করে বাংলার কৃষক-শ্রমিক জনতার মুখে হাসি ফোটাতে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু। কয়েকবার ফাঁসিকাষ্টের মুখোমুখিও হয়েছেন। মিথ্যা মামলায় অসংখ্যবার কারাবরণ করার পরও স্বাধীনতা অর্জনের প্রশ্নে আপস করেননি। অবশেষে তিনি বাংলার মানুষকে দিয়েছেন একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, জাতীয় সংগীত, সংবিধান ও বিশ্বের বুকে গর্বিত পরিচয়।
রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে গরিব, দুঃখী, মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাই জাতির জনকের কাছে বাংলাদেশের সকল মানুষ ঋণী। আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আমরা একটি সুখী, সুন্দর সোনার বাংলা অনেক আগেই অর্জন করতে পারতাম। স্বাধীনতার পরপরই সরকার গঠন করে তিনি একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে যেভাবে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটাই তার প্রমাণ বহন করে। স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তি এবং তাদের দোসররা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে সেই পথ রুদ্ধ করে দেয়। অথচ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ, স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি তারই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে দেশ অনেক চড়াইউৎরাই পেরিয়ে আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই বিরোধী চক্র নিজেরাই আজ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে গেছে। হেনরি কিসিঞ্জারের মুখে পড়েছে ছাই।
মহান স্বাধীনতার ৫০তম বছর—যদিও মহাকালের বিচারে খুব বড় সময় নয়। তবে এ সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। আগামী প্রজন্ম পেতে যাচ্ছে সমৃদ্ধিশালী উন্নত বাংলাদেশ। অল্প সময়ে কোনো জাতির এতদূর এগিয়ে যাওয়ার নজির বিশ্বের অন্য কোথাও নেই। উন্নয়নের অভিনব যাত্রায় এগিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের নতুন বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হতে আর বেশিদিন বাকি নেই।
লেখক: গবেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই