Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বৃত্ত থেকে বাইরে যাওয়া ।। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা


১৫ এপ্রিল ২০১৮ ২০:০৫

গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন, এ্ নিয়ে বিতর্ক শেষ হবার নয়। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে। অবাধ স্বাধীনতা আছে, একথা যেমন বলা যাচ্ছেনা, তেমনি একেবারে নেই, সেকথাও ঠিক না। সাম্প্রতিক কোটা বিরোধী আন্দোলনে লাইভ কভারেজ করতে গিয়ে চরম হেনস্তা ও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন অনেক সাংবাদিক। এতে বোঝা যায়, রাষ্ট্রশক্তি শুধু নয়, বেসরকারি দুষ্টশক্তিও নাগরিক মনে হিংসার মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে।

এই আক্রমণ, এই নিগ্রহ, কখনো হত্যা করা অনেকদিন ধরেই হচ্ছে। রাজধানীর বাইরে স্থানীয় সাংবাদিকরা এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন বেশি করে। বিগত জামাত-বিএনপি জোট সরকারের আমলে খুলনায় মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালুসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। কাউকে গুলি করে, কাউকে বোমা মেরে। এরা প্রত্যেকেই স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করলেও জাতীয়ভাবে পরিচিত ছিলেন ভাল সাংবাদিক হিসেবে। সাংবাদিক হত্যা বা নির্যাতনের খুব কম ঘটনারই বিচার হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

একদিকে সংবাদ মাধ্যমের নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা, গণমাধ্যম কর্মীদের উপর নিয়মিত আক্রমণ আর অন্যদিকে তাদের জন্য সীমিত আইনগত সুরক্ষা। এটাই আজকের বাংলাদেশের বাস্ববতা। একটা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, সীমিত স্বাধীনতা, চাকরির অনিশ্চয়তার সঙ্গে এদেশের সাংবাদিকদের কাজ করতে হয় ভয় আর আতংককে সঙ্গী করে। কাজ করতে হয় আপস করে করে। সেই ন্যূনতম স্বাধীনতাটুকুও এখন হুমকির মুখে। সবচেয়ে বেশি অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে ধমকানি। রাজনীতির কারবারি আর সুশীলদের আরেক অস্ত্র আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা। সেটি বদলে যে নতুন আইন আসছে, তা নিয়েও আছে সংশয়।

কিছু বড় কর্পোরটে হাউজ, যাদের নানাবিধ গণমাধ্যম আছে, তারা যে ধরণের সাংবাদিকতা করে তারা এগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম। কিন্তু ছোট ছোট সংবাদ মাধ্যমগুলো এমন এক আর্থিক পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছে যে এই তাদের পক্ষে টিকে থাকাই এখন এক সংগ্রাম। ফলে আপসের রাস্তা কেবল প্রশস্ত হচ্ছে। কত কাহিনী চেপে যেতে হয়, তা সে সরকারেরই হোক, বেসরকারি হোক বা বিজ্ঞাপন দাতাদের হোক বা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হোক।

বিজ্ঞাপন

সভা, সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন, সেমিনার আর ঘটনা ছাড়া কার্যত সাংবাদিকদের উৎসাহ কম অনুসন্ধানে, এমনকি বিশ্লেষণী সাংবাদিকতায়ও। নির্ভয়ে, নির্মোহভাবে সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করার মুক্ত পরিবেশ ক্রমেই যেন হারিয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে। সাংবাদিকতার পেশায় ঝুঁকি যত বাড়ছে তত নেমে যাচ্ছে সংবাদের মান। কঠোর সমালোচনামূলক সংবাদ পরিবেশন কমে যাচ্ছে। চাপা পড়ে যাচ্ছে প্রান্তিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর। খবরের কাগজের বিরাট অংশ আর টিভি নিউজের দীর্ঘ সময় ব্যয়িত হচ্ছে দুটি বড় দলের ঝগড়া আর ফ্যাসাদের খবরে। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কারণে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ হচ্ছে ব্যাপক হারে।

এমন বাস্তবতায় আমাদের সামনে উপস্থিত নতুন যুগের প্রযুক্তিভিত্তিক অনলাইন মাধ্যম। এখন আমাদের অনেক বেশি পথ চলা প্রযুক্তির সাথে। চাপ আছে, সীমাবদ্ধতা আছে। তবুও সাংবাদিকতা আছে, থাকবেও। আমরা বুঝতে পারছি চেনা ছকে আর থাকছনো সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের চেহারা। পরিবর্তিত হচ্ছে তাদের কাজের ধরণ।

বিশাল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বদলে ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে কম লোক, প্রযোজনা পর্যায়েও কম কর্মী। কিন্তু অনেক বেশি অডিয়েন্স তথা মানুষের সাথে যোগাযোগ ও তাদের বুঝতে শেখা। স্টোরি টেলার হয়েই থাকছেনা গণমাধ্যম কর্মী, তাকে হতে হচ্ছে কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজিষ্ট বা আধয়ে কৌশলী। সবাই ডিজিটাল কেন্দ্রিক, আবার সবাই কানেকটরস। মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখার সৃজনশীল দক্ষতার অধিকারী।

বিশ্লেষণী দক্ষতার অধিকারী কর্মী চাই এখন। কারণ শুধু লিখে বা বলে দিয়ে কাজ শেষ করার বদলে এখন আমাদের বুঝতে হবে পাঠক, শ্রোতা বা দর্শকের চাহিদা।

মাল্টিমিডিয়া ষ্টোরি টেলিং-এর কাঠামোটা চলে যাচ্ছে কনভারজেন্স বা কেন্দ্রীভূত মিডিয়ার ধারণায়। একই ব্যক্তি একই ছাদের নীচে বিভিন্ন মাধ্যমে। তথ্য সংগ্রহ, লেখা বা বলা, শ্যুটিং, এডিটিং-সব একসাথে এবং বিশ্লষণী ক্ষমতাসহ।

শুরু করেছিলাম গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ টেনে। রাষ্ট্র এবং কর্পোরেটের চাপ, সামাজিক মাধ্যমে কট্টর মতামত, পুলিশের অপব্যবহার, মিডিয়ার আপস — মত প্রকাশের স্বাধীনতার সামনে বিস্তর বাধা। এগুলো মোকাবেলা করতেই হচ্ছে, হবেও সামনের দিনগুলোতে। রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দলগুলি সাংবাদিকদের ওপর বলপ্রয়োগ করে, তাদের দমন করতে চায়, নানাভাবে তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করতে উদ্যত, এবং করেও। বাধা হয়ে আছে বেসরকারি ব্যবসায়ীরাও। আর তাই, গণমাধ্যমগুলির বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি বড় বিপদ তৈরি হয়। বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন ছাড়া মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যম চালানো দুঃসাধ্য। প্রযুক্তিভিত্তিক অনলাইন একদিন এই বৃত্ত থেকে গণমাধ্যমকে বের করে আনবে বলেই বিশ্বাস করি এবং সেখানেই নিহিত থাকবে সাংবাদিকরে স্বাধীনতার ধরণটি কেমন হবে।

গণমাধ্যমের পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে রাষ্ট্র ও সমাজ পথ চলবে বলে ধারণা করি। সংবাদ মাধ্যম হল গণতন্ত্রের শক্তি ও রক্ষাকবচ। শক্তিশালী গণতন্ত্রের স্বার্থেই সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার সঙ্গে কোনওরকম আপস কাম্য হতে পারে না। ডিজিটাল মাঠে দেশীয় গণমাধ্যমকে জায়গা করে না দিলে সেই স্থান নিবে অজস্র পোর্টাল যেসবের সাথ এই মাটির যোগাযোগ নেই। রাষ্ট্র ও সমাজ তা নিশ্চয়ই নিরবে দেখবেনা।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: এডিটর ইন চিফ সারাবাংলা.নেট, দৈনিক সারাবাংলা ও জিটিভি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর