Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের অবসান হোক

ইমরান ইমন
৪ এপ্রিল ২০২২ ১৫:২৬

চাকরি একজন ব্যক্তির সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা। ব্যক্তি তার সামাজিক অবস্থান সুদৃঢ়, আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং সামগ্রিকভাবে উন্নত জীবনযাপনের জন্য একটা ভালো চাকরি চাইবে এটা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে যে যার প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অনুযায়ী চাকরি প্রত্যাশী হবে এবং তার বৈষয়িক সেক্টরে চাকরি করবে। কিন্তু আমাদের দেশে এর উল্টো চিত্রটাই লক্ষ্য করা যায়। এখানে দেখা যায়— মেডিকেলে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী ডাক্তার না হয়ে হয়ে যাচ্ছেন ম‌্যাজিস্ট্রেট। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে হয়ে যাচ্ছেন পুলিশ, প্রশাসন, কাস্টমস ও পররাষ্ট্র কর্মকর্তা।

এর পেছনে কারণ কি? কারণ হলো বিসিএসে সুনির্দিষ্ট ক্যাডারমোহ ও ক্যাডার বৈষম্য। বিসিএস বলতে— বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস কে বোঝায়। এর কাজ হলো দেশকে সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য, দেশের সার্বিক শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আমলা তৈরি করা, আমলাদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করা।

এদেশের তরুণ প্রজন্মের মাঝে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝে দিনদিন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার প্রবণতা অদ্ভুত হারেই বেড়ে চলছে। অনেকেই জীবনে সফল হওয়া বলতেই বুঝেন ‘বিসিএস ক্যাডার’ হওয়া। এ প্রবণতা একটা জাতির সার্বিক উন্নতিতে অন্যতম অন্তরায়। একটা দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতিতে সব শ্রেণী পেশার মানুষের অংশগ্রহণ এবং অবদান থাকতে হয়। এদেশের বর্তমান প্রজন্ম ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর শুধু বিসিএস মোহের কারণে ১৯৭১ পরবর্তী এ প্রজন্মের মাঝে আমরা তেমন কোনো বুদ্ধিজীবী দেখছি না। সবাই শুধু এখন আমলা হওয়ার পেছনেই দৌঁড়াচ্ছে। একটা দেশ কতটুকু উন্নতির শিখরে পৌঁছবে সেটা সে দেশের বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা দেখে নির্ণয় করা হয়। বুদ্ধিজীবী শূন্য মানে দেশ ও জাতির উন্নতি শূন্য। এজন্যই ১৯৭১ হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রথমে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনকশা তৈরি করেছিল।

মনে প্রশ্ন জাগে—এতো এতো কর্ম পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও এদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, তরুণ প্রজন্ম কেন শুধু বিসিএস এর পেছনে দৌড়াচ্ছে? সহজ উত্তর—মান-সম্মান, যশ ও খ্যাতি, পাওয়ার প্র্যাকটিসের ক্ষমতা। কে না চায় ‘পাওয়ার প্র্যাকটিস’ করতে? কেন না চায় বস হতে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিসিএস-ই একমাত্র চাকুরী যেখানে বিশেষ মান-সম্মান, যশ-খ্যাতি পাওয়া যায়, সরকারি ছায়াতলে থেকে পাওয়ার প্র্যাকটিস করা যায়। পাশাপাশি দুর্নীতি ও লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা যায়। তাই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে দিনদিন এদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, তরুণ প্রজন্ম বিসিএস এর দিকে ঝুঁকছে। আর এ চাহিদাই বিসিএস’কে “সোনার হরিণে” পরিণত করেছে।

বিসিএস কে আজকে সোনার হরিণে পরিণত করা বা এদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সফলতার চাবিকাঠি মনে করার পেছনে যে মাধ্যমটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে সেটি হলো ‘মিডিয়া’। “এইচএসসি তে দুইবার ফেল করেও বিসিএসে প্রথম”, “তারার আলোয় পড়েও বিসিএস ক্যাডার”, “প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে অতঃপর বিসিএস ক্যাডার”, “বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পর ফিরে এলো প্রেমিকা”—পত্রপত্রিকায়, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত এমন সব চোখধাঁধানো শিরোনাম এদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর, তরুণ প্রজন্মের বিসিএস মুখী হওয়ারও অন্যতম কারণ। প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, “প্রচারেই প্রসার।” বিসিএস এর ক্ষেত্রে এমনটাই হচ্ছে। আরেকটা অন্যতম কারণ হলো আমলাতন্ত্রের সর্বমুখী ক্ষমতা। আমলাতন্ত্রে করা যায় না, পারা যায় না বলে এমন কিছু নেই এই বোধদয় থেকে বর্তমান প্রজন্ম দলে দলে সদলবলে আমলা হওয়ার পথে দৌড়াচ্ছে। কেননা এ প্রজন্ম তাদের চোখের সামনে দেখছে, আমলাতন্ত্রে কোনভাবে ডুকতে পারলে রাতারাতি অর্থবিত্ত ও সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা যায়, সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে রাখা যায়, দেশকে লুটপাট করে খাওয়া যায় বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কায়দায়।

বিশ্ববিদ্যালয় হলো দেশের উচ্চ শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হলো গবেষণা। আর এর প্রধান কাজ হলো শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করে তোলা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তেমন কোনো গবেষণা হয় না। এখানকার শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরীতে গিয়ে বিভিন্ন প্রকার জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা না করে, করে বিসিএস চর্চা। তারা শুধু পড়ে থাকে গুটিকয়েক বিষয়ের উপর। প্রথম বর্ষে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীকে দেখা যায় বিসিএসের উপর তুমুল নির্ভরশীলতা। একাডেমিক পড়াশোনা থেকেও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিসিএসের পড়াশোনা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, লাইব্রেরীগুলোতে হওয়ার কথা ছিল বিভিন্ন প্রকার জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা আর গবেষণা। আর এভাবে চলতে থাকলে দেশের উচ্চশিক্ষা বিশেষ করে বিশেষায়িত শিক্ষা যে মুখ থুবড়ে পড়বে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিসিএস এর প্রতি এদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর নির্ভরশীলতা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে- ৪০ তম বিসিএস এ আবেদনকারীর সংখ্যা মালদ্বীপের জনসংখ্যাকেও অতিক্রম করেছে। পরবর্তী বিসিএসগুলোতে সংখ্যাটা বেড়েই চলছে। দেশের বিশাল এক শিক্ষিত জনগোষ্ঠী কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, উদ্যোক্তা, আবিষ্কারক হওয়ার নেশা ছেড়ে আমলা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। এটা প্রকৃতপক্ষে দেশের জন্য কোনভাবেই মঙ্গলজনক নয়। হ্যাঁ, দেশের মেধাবীদের দেশ পরিচালনায় এগিয়ে আসা উচিত, কিন্তু তারও একটা সীমা রয়েছে। একটা দেশ তো শুধু আমলা বা আমলাতন্ত্র দিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।

সোনার হরিণ বিসিএস পরীক্ষার সূচনায় হয় ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার মাধ্যমে। এর মাধ্যমে বিশাল একটা অংশ বাছাই হয়ে যায়। এর প্রশ্ন মূলত ভাষা, সাহিত্য, সাধারণ জ্ঞান, সাধারণ গণিত ও বিজ্ঞান, রাষ্ট্র, ইতিহাস, ভূগোলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

প্রিলিমিনারির পরবর্তী ধাপ হলো লিখিত পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজি এবং বাংলাদেশ বিষয়াবলী বিষয়গুলোতে ২০০ নম্বর করে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তে ১০০ নম্বর করে রয়েছে। আর ১০০ নম্বর করে বরাদ্দ রয়েছে গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা বিষয়ে। সর্বমোট ৯০০ নম্বরের পরীক্ষা।

সম্প্রতি ৪০তম বিসিএসের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, ট্যাক্স-এর মতো শীর্ষ ক্যাডার পদসমূহে মনোনীত হয়েছেন দেশের বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ানিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়াররা। এ নিয়ে অনেক সমালোচনার ঝড় উঠছে। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে, এর নেপথ্যে কী? দিনদিন ইঞ্জিনিয়ারিংরা তাদের নিজস্ব ক্যাডার পদ ছেড়ে কেন অন্য কাড্যারের দিকে ধাবিত হচ্ছে! আমরা ৩৮তম বিসিএসেও এমনটা লক্ষ্য করেছি। ৩৮ তম বিসিএস এর ক্যাডার পদ বিশ্লেষণে দেখা গেছে- ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই তাদের পেশার সাথে জড়িত ক্যাডার পদ ছেড়ে পররাষ্ট্র, প্রশাসন ও পুলিশ এবং অনেকেই সাধারণ ক্যাডার পদে যোগ দিয়েছেন। মোট ২২০৪ জনের মধ্যে পররাষ্ট্র ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন ২৫ জন। এ ২৫ জনের ৭ জন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, ১৩ জন বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আবার এ ১৩ জনের ১০ জনই বুয়েটের শিক্ষার্থী।

এখন আমার সাদাসিধে প্রশ্ন—একজন মেডিকেল পড়ুয়া শিক্ষার্থী এতো কষ্ট, এতো পরিশ্রম করে, এতো লাখ লাখ টাকা খরচ করে দীর্ঘ ৫/৬ বছর ডাক্তারি পড়াশোনা করে কেন স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদান না করে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ বা কর ক্যাডারে যোগদান করলেন? এর নেপথ্যে কী? তাদের পেছনে পরিবার,সমাজ, রাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে। তাদের কি উচিত নয় পরিবার,সমাজ, রাষ্ট্রের সে ঋণ শোধ করা?

আমাদের বাবা-মায়েরা একজন ছেলে বা মেয়েকে চোখ ভরা স্বপ্ন আর বুক ভরা আশা নিয়ে মেডিকেলে ভর্তি করান, তার ছেলে বা মেয়েটিকে ডাক্তার বানাবেন বলে। তাছাড়া একজন ডাক্তার স্বাস্থ্য ক্যাডারে আসলে সেটা আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য যেমন কল্যাণকর তেমনি দেশ ও জাতির গর্বের বিষয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে এক লাখের বেশি চিকিৎসক নিবন্ধন নিয়েছেন। বর্তমানে সরাসরি চিকিৎসা পেশায় যুক্ত এমন চিকিৎসকের সংখ্যা (সরকারি ও বেসরকারি) ৬০-৭০ হাজার। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২৫-৩০ হাজার। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা ও রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় কমপক্ষে দুই লাখ চিকিৎসক প্রয়োজন।

সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সূত্র অনুযায়ী, দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পাঁচ বছরের এমবিবিএস ডিগ্রি নিতে একজন শিক্ষার্থীর ব্যয় হয় ১৮-২০ লাখ টাকা। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে সরকারের ব্যয় ১৫ লাখ টাকার অধিক। এমন পরিস্থিতিতে মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের দিনদিন অন্য পেশায় চলে যাওয়া দেশের জন্য কোনভাবেই মঙ্গলজনক নয়।

এমনিতেই আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল অবস্থা। দেশে করোনা সংক্রমণের পর এদেশের স্বাস্থ্যখাতের করুণ চিত্র জনসম্মুখে ফুটে ওঠে। দেখা যায়—স্বাস্থ্যখাতে আমরা কি পরিমান দুর্বল, কি পরিমান পিছিয়ে! এমনতাবস্থায় ডাক্তারদের ডাক্তারির মতো মহৎ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাওয়া দেশের জন্য অশনি সংকেত। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে?

প্রশ্ন উঠতে পারে— এ দেশে ডাক্তাররা তো আর প্রশাসন ক্যাডারে কর্মরত একজন ক্যাডারের মতো সমান সুযোগ-সুবিধা, যশ-খ্যাতি, পাওয়ার প্র্যাকটিস করতে পারেন না। হ্যাঁ, এটা সত্য যে একজন প্রশাসন কর্মকর্তা যে গাড়ি, বাড়ি বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পান একজন ডাক্তার কিন্তু তেমনটা পান না। আর এ ক্ষোভ থেকেই নিজস্ব ক্যাডার পদ ছেড়ে তারা চলে যাচ্ছেন প্রশাসন, পররাষ্ট্র ক্যাডারে।

একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার কখনোই তার স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের তার চাইতে কম মেধাবী সহপাঠীটা তার উপর কর্তৃত্ব করবে, প্রভাব খাটাবে—এটা সে মেনে নিতে পারবে না। তাই বিসিএসে ঘটছে পেশাবদলের ঘটনা। আর এর নেপথ্য আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দায়ী।

স্বাস্থ্য ক্যাডারের শুরুতে প্রথমে একজন ডাক্তারকে নিয়োগ দেয়া হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে নেই কোনো গাড়ির সুবিধা, ভাড়ায় থাকতে হয় সরকারি কোয়ার্টারে। ব্যক্তিগত সহকারী ও আলাদা কোনো অফিস থাকে না। পদোন্নতির জন্য প্রয়োজন হবে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রির, যা সম্পূর্ণ শেষ করতে লেগে যায় ১০-১৫ বছর।

অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডারে চাকরির শুরুতে মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব, ডিসি অফিসের কর্মকর্তা, এসিল্যান্ড হিসেবে যোগদানের সুযোগ রয়েছে। রয়েছে ধারাবাহিক পদোন্নতির সুযোগ, গাড়ি-বাড়ির সুবিধা, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে মাসিক ৫০ হাজার টাকা। ব্যক্তিগত সহকারী, পাওয়া যাবে আলাদা অফিসও। আর ইউএনও হলে সরকারি বাংলো ও গাড়ির সুবিধা তো রয়েছে। পদোন্নতি পেলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবও হতে পারেন। রয়েছে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়ার সুযোগ, প্রেষণে আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজের সুযোগও রয়েছে। এসব বৈষম্যের দেয়ালই ডাক্তারদের স্বাস্থ্য ক্যাডার ছেড়ে অন্য ক্যাডারে যোগ দিতে বাধ্য করছে।

ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদেরও একই অবস্থা। বুয়েটে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স সাবজেক্টে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীটা বিসিএস দিয়ে এখন পররাষ্ট্র ক্যাডার। এতো বছর তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে এখন কর্ম ক্ষেত্রের কোনো মিল নেই। সে যদি তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পেশায় থাকতো—আমরা হয়তো পেতাম সেরা আইটি চিপ নির্মাতা, ভবিষ্যৎ মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠান নির্মাতা, বিশ্বের সেরা প্রযুক্তিবিদ বা সফল বিজ্ঞানী।

ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদদের তাদের নিজস্ব পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগদানের ফলে সাধারণ বিষয় নিয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের অধিকার হতে। সাধারণত বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শনসহ ইত্যাদি সাধারণ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরাই তো যোগ্যতা বলে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কর, সাধারণ ক্যাডার পাওয়ার কথা। সাধারণ এসব বিষয় নিয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল বা কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থীদের মতো আলাদা তেমন কোনো চাকরির বাজার নেই।

একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেলে চাকুরি, অর্থের বিনিময়ে রোগী দেখার কর্মস্থল। একজন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন শিল্প, কল-কারখানায় চাকরির সুযোগ। একজন কৃষিবিদেরও চাকরির আলাদা সেক্টর রয়েছে।

কমার্স ফ্যাকাল্টির শিক্ষার্থীদের জন্যেও রয়েছে আলাদা চাকরির পরিবেশ। তাদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক ও বিমা সেক্টর, বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। দেশের প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান সময় অনুযায়ী, আর্টস ও সোস্যাল সাইন্স ফ্যাকাল্টির শিক্ষার্থীদের ভরসার জায়গা এই বিসিএস। যদিও বিসিএস ছাড়া আরো অনেক ভালো ভালো সেক্টর রয়েছে।

বিসিএসে কি আদৌ সুখ শান্তি আছে! স্বামীর একজায়গায় পোস্টিং, স্ত্রীর আরেক জায়গায় পোস্টিং, পরিবার থেকে দূরে থাকা, বিপদে আপদে পাশে থাকতে না পারা, উপর মহলের হরেক রকমের চাপ ইত্যাদি নানা মানসিক যন্ত্রণার নাম বিসিএস। কিন্তু বিসিএস কে তো ‘সোনার হরিণ’ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন শুধু এপথেই সবাই দৌড়াচ্ছে। এই বিসিএস-ই তাদের একমাত্র স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা। এ বিসিএস মুখীতাই একটা সৃজনশীলতা বিমুখ, মেরুদন্ডহীন, দাসসুলভ প্রজন্ম তৈরি করছে। কিন্তু আবার এ বিসিএসে রয়েছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে সমন্বয়হীনতা, রয়েছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য।

যে ক্যাডারগুলো সাধারণ এসব বিষয় নিয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা পাওয়ার কথা সেসব ক্যাডারগুলো এখন দখল করে আছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও কৃষিবিদরা। সাধারণ এসব বিষয় নিয়ে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর তো আর ডাক্তার তথা স্বাস্থ্য ক্যাডার হওয়া সম্ভব না।

এ প্রশ্ন না উঠে পারে না যে, কৃষি ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা কেন কৃষি সচিব হবেন না? কেন স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরিবর্তে ইংরেজি সাহিত্যের একজন শিক্ষার্থীকে স্বাস্থ্যসসচিব হতে হবে? কেন সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একজন শিক্ষক শিক্ষাসচিব হবেন না বা হতে পারবেন না?

বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডার পদে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য এখন চরম লেবেলে। এজন্য রীতিমতো পেশাবদলের ঘটনা ঘটছে। একজন এডমিন ক্যাডার যে সুযোগ-সুবিধাগুলো পাবেন সেগুলো কেন স্বাস্থ্য ক্যাডারের অধিকারী একজন ডাক্তার পাবেন না? একজন পুলিশ ক্যাডারের পুলিশ অফিসার যে সুযোগ সুবিধাগুলো পাবেন সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের অধিকারী একজন শিক্ষক যিনি জাতি গড়ার কারিগর বলে পরিচিত তিনি কেন তা পাবেন না?

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। দিনশেষে আমাদের দেশে দেখা যায়-প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বা ডিগ্রির সাথে আমাদের চাকরি বা কর্মক্ষেত্রের কোনো মিল থাকে না। এজন্য ডাক্তারি পড়ুয়া একজন ডাক্তার ডাক্তারি না করে যোগদান করেন প্রশাসনে। ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে আজীবন পড়োশোনা করে যোগ দেন পররাষ্ট্র/পুলিশে। তাহলে আমাদের এ শিক্ষার কী মূল্য রইলো? শিক্ষা তো তার মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হলো। এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশের উচ্চশিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়বে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিশ্বের অন্যান্য দেশসমূহে দেখা যায়, যে যে বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছে, পড়াশোনা শেষে সে সে বিষয় সম্পর্কিত চাকরিতে যোগদান করছেন। কিন্তু আমাদের দেশে এর উল্টো চিত্রটাই লক্ষ্য করা যায়। এখানে ডাক্তারি পড়ে হয়ে যায় পুলিশ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এখন ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। এখনই পরিবর্তনের জোয়ার তুলতে হবে। যে যে বিষয়ে পড়াশোনা করছে তার জন্য, তার বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত সেরকম কর্ম পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পেশা অনুযায়ী সব পেশাতে সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য শিক্ষা খাতের সংস্কারের জন্য প্রচলিত নিয়মকানুন পরিবর্তনে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। বিসিএস এর মতো তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ চাকরি পরীক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির উপর সমন্বয় তথা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ক্যাডার মনোনয়ন দিতে হবে, দূর করতে হবে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য। তখন হয়তো বৈষম্যের দেয়াল ভাঙবে। শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হবে। ক্যাডার বৈষম্য নিয়ে হাহাকার দূর হবে।

বিসিএসের মতো তুমুল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শুধু ক্যাডার ভিন্নতার কারণে বৈষম্যের শিকার হওয়া কোনভাবেই যৌক্তিক নয়। ক্যাডার ভিন্নতার কারণে কেউ সুযোগ-সুবিধা বেশি পাবেন, কেউ কম পাবেন—এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বস্তুত বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে প্রশাসন ও পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বেশি। ফলে প্রতিনিয়তই সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে একটি আন্তঃক্যাডার বৈষম্য থেকেই যাচ্ছে। এ আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের মতো সব ক্যাডারে সুপারনিউমারারি (সংখ্যাতিরিক্ত পদ) পদোন্নতি ও পদসোপান তৈরির বিষয়ে ২০১২ সালে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে কার্যকর উপায় বের করতে সেসময়ে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমামকে প্রধান করে কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত সচিব সভায় আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করে সবার জন্য ন্যায়সঙ্গত পদোন্নতি ও পদায়ন নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরও এক্ষেত্রে এখনও কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার নয় বছর অতিবাহিত হলেও সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের অবসান না হওয়ার বিষয়টি ভীষণ দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। এর থেকে কি প্রমাণ হয় আমলাতন্ত্রের এক সংখ্যবদ্ধ গোষ্ঠী চান না আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন হোক?

আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের ফলে প্রশাসন ছাড়া বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে সবসময়ই একধরনের চাপা ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। সম্প্রতি এসব ক্যাডার কর্মকর্তাদের আন্দোলনে মাঠে নামতেও দেখা গেছে। এসব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অভিযোগ—তারা সুপারনিউমারারি পদোন্নতির সুযোগ না পেলেও প্রশাসন ক্যাডারের সিনিয়র সহকারী সচিব পদের প্রায় সব কর্মকর্তাকে সুপারনিউমারারির সুযোগে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। অথচ সরকারের এ পদে সবার পদোন্নতি পাওয়ার সমান অধিকার থাকার কথা। শুধু পদোন্নতি নয়, সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

বিসিএসে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন এখন সময়ের দাবি। এই ক্যাডার বৈষম্যের বিরূপ প্রভাব কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা ডাক্তারী, ইঞ্জিনিয়ারীতে পড়াশোনা করেও কর্মক্ষেত্রে এসে ক্যাডার বৈষম্যের বলি হয়ে নিজস্ব ক্যাডার ছেড়ে যোগ দিচ্ছেন জেনারেল ক্যাডারে। তাই মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে হচ্ছেন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, কাস্টমস ও পররাষ্ট্র কর্মকর্তা। এটা একটা দেশের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশে ভালো মানের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, গবেষক তৈরি হবে না।

বিসিএস এখন দেশের সোনার হরিণ চাকরি। আর এই সোনার হরিণ ধরতে যারা অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, পরিশ্রম, সংগ্রাম করেন তাদের সাথে ক্যাডার বৈষম্য কোনভাবেই কাম্য নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেটি যাতে আর আমলাতন্ত্রের ফাঁকফোকরে আটকে না থাকে এবং সে নির্দেশনা যাতে দ্রুত বাস্তবায়ন হয় এটাই কাম্য। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী অতি দ্রুত আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের অবসান ঘটুক—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের অবসান হোক ইমরান ইমন মত-দ্বিমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর