Thursday 28 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিদেশি ঋণ নয়, সমস্যা অনিয়ম আর দুর্নীতিতে

সাব্বির আহমেদ
১১ এপ্রিল ২০২২ ২২:১৮

বাংলাদেশে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের বেশি হারে অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে তিন বছর সাত এবং এক বছর আট শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনার কারণে এই প্রবৃদ্ধির হার ৩.৫১ এবং ৫.৪৭ শতাংশ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে আবার তা সাত শতাংশ অতিক্রম করবে বলে প্রাক্কলন করছে সরকার। অর্থনৈতিক এই প্রবৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে সরকারের দেওয়া নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ বিভিন্ন রকমের প্রণোদনা এবং ক্রমবর্ধমান অবকাঠামো। দেশের প্রতিটি মানুষ এখন বিদ্যুৎ পাচ্ছে। গ্যাস সংকট দূর হয়েছে বহুলাংশে। প্রায় প্রতিটি গ্রামে এখন পাকা রাস্তা। টেলিযোগাযোগে এবং ইন্টারনেটে দেশ এখন সারা বিশ্বের কাছে উল্লেখ করার মতো বিষয়। যারা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে উপহাস করেছিল তারাই এখন বলছে, বাংলাদেশ সারাজাহানের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। দেশে মাথা পিছু আয় বেড়েছে। বেড়েছে মজুরি, বেতন, ব্যবসায়ীক লাভের পরিমাণ, পণ্য ও সেবার মূল্য। মুদ্রাস্ফীতির থেকে মানুষের আয় বেড়েছে অধিক হারে। ফলে বেড়েছে ক্রয় ক্ষমতা; কমেছে দারিদ্র্য। এক দশক আগের ৪০ শতাংশ দারিদ্র্য এখন নেমে গেছে ২০ শতাংশের নিচে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের এই অর্জন হয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কর আদায়, অন্যান্য আয় বৃদ্ধি এবং সরকারের গ্রহণ করা বিদেশি ঋণের কারণে। সরকারের বাজেট বিগত এক দশকে বেড়েছে ছয় গুণেরও বেশি। প্রতি বছরই সরকার ঘাটতি বাজেট করেছে। ঘাটতির এক অংশ এসেছে স্থায়ীয় মুদ্রায় ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে, আরেক অংশ বৈদেশিক মুদ্রায় গ্রহণ করা ঋণ ও অনুদান থেকে। অনুদানের পরিমাণ সামান্যই ছিল। অর্থের বাড়তি যোগানের ফলে দিন দিন অবকাঠামো সুবিধা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিকে ত্বরান্বিত করেছে। এখানে বাড়তি অর্থ প্রবাহ এবং অবকাঠামো সুবিধা বৃদ্ধির যৌথ মিথস্ক্রিয়ায় অর্থনৈতিক উন্নতির সহযোগী অতিক্রিয়া (synergy) তৈরি হয়েছে। শুধু আভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়ে এই অতিক্রিয়া সৃষ্টি সম্ভব ছিল না। আভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার পর্যাপ্ত যোগানের ফলেই দেশের এই অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার যোগানের প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স, রফতানি আয় এবং বৈদেশিক ঋণ। বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ না নিলে সম্ভব হতো না এত ব্যাপক পরিমাণের অবকাঠামো নির্মাণ। অবকাঠামোর উন্নতি না হলে হতো না উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন এবং রফতানি প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশের এই অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে বৈদেশিক ঋণের প্রভাব অনস্বীকার্য।

বিজ্ঞাপন

ঋণযোগ্য লোকের উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। যখন একজন মানুষের অধিক কিছু করার যোগ্যতা এবং সামর্থ্য আছে কিন্তু পর্যাপ্ত মূলধন নেই তখন যদি তিনি ঋণ করে তার সক্ষমতা বৃদ্ধি করেন তবে তিনি তার সামর্থ্যকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারেন। ঋণ গ্রহণের সময় খেয়াল রাখতে হয় যে ঋণ নেওয়ার জন্য যে সক্ষমতা দরকার তা আছে কি-না, ঋণ নিয়ে আসলেই তিনি আরও বেশি পণ্য উৎপাদন বা সেবা প্রদান করতে পারবেন কি-না এবং যে বাড়তি উৎপাদন তিনি করবেন তার অর্থনৈতিক মূল্য দিয়ে তিনি ঋণের শর্তানুযায়ী সুদাসল পরিশোধ করতে পারবেন কি-না। যদি এই শর্তগুলো ঋণ গ্রহীতা পূরণ করতে পারেন তবে অবশ্যই তিনি ঋণ গ্রহণ করবেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার জন্য। এ কথা যেমন একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি তা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বুঝে শুনে নেওয়া ঋণ সবসময় উপকারী।

করোনাকালে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি পূর্বের মতো অধিক হারে বৃদ্ধি পায়নি। এ সময়ে জিডিপি বৃদ্ধির হার অনেক দেশের মতো ঋণাত্মক না হলেও আগের বছরের তুলনায় কমেছিল। দেশে কৃষির অধিক উৎপাদন, প্রবাসীদের রেমিটেন্স এবং তৈরি পোশাক রফতানির গতি আগের থেকে বেশি ছিল বলে আমাদের জাতীয় আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়নি যা হয়েছে প্রায় সকল উন্নত অর্থনীতির দেশে। প্রতিবেশী ভারত, নেপাল এবং শ্রীলংকায়ও ছিল জিডিপি’র ঋণাত্মক হার। ব্যাপক টিকাদানের এবং অন্যান্য সংক্রমণ প্রতিরোধ করার উপায় গ্রহণের ফলে ২১ সালের শেষের দিক থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে গেলে অর্থনীতি আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরতে শুরু করে। করোনাকালে যে সকল সেক্টরে কার্যক্রম সীমিত ছিল, বিশেষ করে নির্মাণ এবং পোশাক ছাড়া অন্যান্য শিল্প উৎপাদন, সেগুলো পুরোদমে চালু হয়ে গেলে আমদানির উপর চাপ পড়ে; কমতে থাকে রিজার্ভের পরিমাণ। করোনাপূর্ব ২০২০ সালের জানুয়ারি শেষে যে রিজার্ভ ছিল ৩২/৩৩ বিলিয়ন ডলার তা ২০২১ সালের আগস্টে ১৬ বিলিয়ন ডলার বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ বিলিয়নে। ফেব্রুয়ারি শেষে এই রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬ বিলিয়ন ডলারে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রফতানি অতিরিক্ত আমদানি হয়েছে ১.৫ বিলিয়ন ডলার। করোনাকালে যে পরিমাণ বাড়তি রিজার্ভ জমেছে সে তুলনায় এই ঘাটতি কিছুই না। তাছাড়া আমাদের মত দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে বাণিজ্য ঘাটতি স্বাভাবিক। আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ হয় রেমিটেন্স এবং ঋণের মাধ্যমে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ২০২০-২১ সাল শেষে আমাদের বৈদেশিক ঋণ ছিল ৭৮.০৪ বিলিয়ন ডলার যা জাতীয় আভ্যন্তরীণ আয়ের মাত্র ২২.০%। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ এর যৌথ উদ্যোগে ২০২১ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত Joint World Bank-IMF Debt Sustainability Framework for Low-Income Countries এ বলা হয়েছে দুর্বল অর্থনীতির দেশের জন্য জিডিপি’র ৩৫%, মধ্যম শক্তির অর্থনীতির জন্য ৫৫% এবং শক্তিশালী অর্থনীতির জন্য ৭০% পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের বর্তমান মূল্য নিরাপদ। ঝুঁকিপূর্ণ নয়। আমাদের ৭৮.০৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ ভবিষ্যৎ মূল্যে রয়েছে যা বর্তমান মূল্যে আরো কম হবে। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ এর নিয়মানুসারে বর্তমান মূল্য হিসেব করে অংক করলে জিডিপি ও বৈদেশিক আয়ের অনুপাত ২২% এর কম হবে। আমাদের বৈদেশিক ঋণ এখন যে পর্যায়ে রয়েছে তাতে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে সময় নষ্ট করার মানে হয় না।

আমাদের দুশ্চিন্তার জায়গা হচ্ছে সরকারের প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ করতে না পারা এবং দুর্নীতির কারণে প্রকল্প খরচ বেড়ে যাওয়া। এই দুই সমস্যা সমাধান করতে না পারলে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ এবং দেশজ সম্পদ আহরণ করে যে গতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তা ধরে রাখা যাবে না; অর্থনীতি উল্টোরথে চলতে শুরু করবে। এর সঙ্গে আরেক সমস্যা, বিদেশে টাকা পাচার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরো তেজের সঙ্গে এগিয়ে যেতে দিচ্ছে না। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির আরেক সাইডএফেক্ট হচ্ছে উন্নয়নের সুবিধা সমভাবে বণ্টন না হওয়া। ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে।

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় উপকারভোগী হচ্ছে সমাজের উপর তলার মানুষেরা। ধনীরা এখানে অত্যধিক ধনী হয়ে যাচ্ছে যা এখন বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে বিলিয়নিয়ার বানানোর কারখানা হিসেবে পরিচিত করছে। এখানকার ধনীদের খুব কমসংখ্যক লোক সঠিক পথে ধনী হচ্ছে। বেশিরভাগ লোক ধনী হচ্ছে সরকারি কাজে দুর্নীতি ও অনিয়ম করে এবং সিন্ডিকেট বানিয়ে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি করে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের পকেট কেটে নিয়ে। এরা এক দিকে সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে কম আয়ের মানুষদের শোষণ করে চলছে; আরেক দিকে, বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফসল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে দিচ্ছে না। এরা দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচার করে কানাডার বেগম পাড়ায়, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে বাড়ি বানায়। অনেকের টাকা জমা হয় আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, পানামাসহ বিভিন্ন দেশে। পশ্চিমা সরকারগুলো একদিকে আমাদের ন্যায়নীতির ছবক দেয় আরেক দিকে আমাদের এখান থেকে কালোপথে পাচার করা টাকা নিজের দেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়। অনেক বছর ধরে সামাজিকভাবে আলোচিত হলেও টাকা পাচার রোধে সরকারকে কার্যকর কিছু করতে দেখা যাচ্ছে না।

টাকা পাচার বিষয়ে গবেষণা করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) বলেছে, দেশ থেকে যত টাকা পাচার হয় তার বেশিরভাগ হয় বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে। বাংলাদেশ থেকে যত বৈদেশিক বাণিজ্য হয় তার ১৮% ভুয়া। অর্থাৎ, ১৮ শতাংশ বাণিজ্যের নামে পাচার হয়ে যায়। এই পাচার রোধ করতে হবে। এর রোধ করার জন্য বৈদেশিক বাণিজ্যের নিয়ম-কানুনের মধ্যে কোথায় কত ফাঁক-ফোকর আছে তা খুঁজে বের করে বন্ধ করতে হবে। এর জন্য দরকার বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ে একটা উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন টাস্কফোর্স তৈরি করা যারা বিস্তারিত গবেষণা করে ফাঁক-ফোকর বন্ধের জন্য সরকারকে পরামর্শ দেবে। সরকার সে অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ করবে, আইন প্রণয়ন করবে।

অনেকে দুর্নীতির ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধির জন্য আবার স্বয়ং অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই দায়ী করে পত্রিকায়, টেলিভিশনে বয়ান দিচ্ছে। এসব কথা-বার্তা দুর্নীতিকে জায়েজ করার সামিল। এরা জ্ঞান-পাপী। এদের অপপ্রচারে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হলে তার হিস্যা সকলের সমানভাবে প্রাপ্য। ধনীরা বেশি পাবে আর গরীব কম পাবে এমন কথা অর্থনীতি শাস্ত্রের কোথাও বলা নেই। সামাজিক সম্পদের সুসম বণ্টনের ক্ষেত্রে সমস্যা করে রেখেছে কিছু কিছু আইন এবং সরকারি নিয়ম-কানুন। এগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। সংশোধন করতে হবে এসব বৈষম্য সৃষ্টিকারী আইন।

গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যে পরিমাণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে তাতে সর্বস্তরের মানুষের আয় এবং জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। এখন কাউকে খাদ্যাভাবে থাকতে হয় না; কৃষক-মজুর-শ্রমিকের সন্তানেরা শুধু শিক্ষায়ই নয়, উচ্চ শিক্ষায় উঠে আসছে তরতর করে। দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমলেও, দূর হয়ে যায়নি। সমাজে দুর্নীতি না থাকলে বা কম থাকলে, সিন্ডিকেট না থাকলে এদের উন্নতি আরও বেশি করে চোখে পড়ত; সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে অনিয়ম, অনাচার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হত। মানুষের মনে প্রশান্তি থাকত। বিশ্ব প্রসন্নতা তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে আসত অনেক উপরে।

লেখক: লিড কনস্যালটেন্ট; ঢাকা কনস্যালটিং লিমিটেড

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর