বিজ্ঞান শিক্ষাই পারে কূপমণ্ডুকতা ঠেকাতে
১২ এপ্রিল ২০২২ ২০:৪৫
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। জাতির মেরুদণ্ডটিকে সবল করতে পারে আমাদের শিক্ষকরা। জাতির বাতিঘর বলা হয় শিক্ষকদের। কারণ রাষ্ট্রের নতুন প্রজন্মকে অন্ধকার পথ থেকে আলোর পথে নিয়ে যেতে পারে শিক্ষা অর্থাৎ শিক্ষক সমাজ। বিশেষ করে বিজ্ঞানশিক্ষার গুরুত্বটা বেশি কারণ বিজ্ঞান ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জীবন ও জগতের নিয়ম জানা ও শেখা যায়। অপর দিকে নতুন প্রজন্মকে সত্যানুসন্ধানী মন, যুক্তি গ্রহণ ও ভুল চিন্তা বর্জন করে আধুনিক মনন গড়ে তুলতে পারে বিজ্ঞান শিক্ষক। যার ফলে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের মধ্য দিয়েই সম্ভব মানুষকে সাম্প্রদায়িক কুপমণ্ডক ধ্যান ধারণার অবসান ঘটানো।
স্বাধীনতার একান্ন বছরের বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা আজ কোন পথে? কেমন আছেন শিক্ষক সমাজ? বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে আমাদের দেশের বিজ্ঞান শিক্ষা কতটুকু অগ্রসর? বাঙালির বিজ্ঞানসাধনা সম্পর্কে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন, ‘শিল্প বিপ্লবত্তোর ইউরোপে যখন বিজ্ঞান বিকশিত, আমাদের দেশে তখন মধ্যযুগের অন্ধকার। ইউরোপে অন্ধকার যুগ অর্ধ-সহস্র বৎসর স্থায়ী হলেও আমাদের দেশে তার পরমায়ু ছিল প্রায় দ্বিগুণ।’ আমাদের দেশে বাণিজ্যের প্রসার এবং করপোরেট পুঁজির দুর্দমনীয় বিশ্বায়নের ফলে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসার নয় বরং বিজ্ঞানশিক্ষার দুরবস্থা হয়েছে। তার প্রমাণ হিসাবে বলা যায় সম্প্রতি, মুন্সিগঞ্জ জেলা সদরের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ে ক্লাসে বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল না কী ইসলাম ধর্ম ও ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে আপত্তিকর কথা বলেন। যা এক শিক্ষার্থী মোবাইলে রেকর্ড করে। এ বিষয়ে ক্লাস শেষে শিক্ষকের বিচারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা প্রধান শিক্ষক বরাবর লিখিত আবেদন করেন। পরদিন বিষয়টি জানাজানি হলে বিদ্যালয় চলাকালীন শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করে। পরে ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই বিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী বাদি হয়ে ইসলাম ধর্মের ওপর আঘাত করে বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ এনে স্কুলের গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন।
এরপর ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে। শিক্ষার্থীদের এই কাজটি অত্যন্ত অসম্মানের ও অমর্যাদাকর আর তেমন একজন জাতি তৈরীর কারিগরকে কারাগারে গ্রেফতার করে রাখা জাতির জন্য লজ্জাকর বিষয়। যদিও গত রোববার ১৯ দিন পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন ধর্ম অবমাননার মামলায় অভিযুক্ত বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে জেলা কারাগার থেকে মুক্ত হন তিনি। ঘটনার দিনে ছাত্রদের করা ১৩ মিনিটের টেপটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ওই পোস্টটি বিশ্লেষণ করে বুঝা যায়, ছাত্র-শিক্ষকের ওই আলাপটির মধ্যে শিক্ষক বুঝাতে চেয়েছেন ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের নাম বিজ্ঞান। ফলে বিজ্ঞান আর ধর্ম এক নয়, কারণ ধর্ম হলো বিশ্বাস। আর বিজ্ঞান হলো, পরীক্ষা নিরীক্ষার বিষয়। আর তাই বিজ্ঞান ও ধর্মকে এক করা ঠিক নয়। যার উদাহরণ হিসেবে অনেক কিছু দিয়ে তার মধ্যে তিনি বলেছেন, ‘হনুমান নাকি সূর্যটাকে কানের ভেতর রেখেছে। আমাদের হিন্দু ধর্মের যারা বয়স্ক তারা খুব বিশ্বাস করে যে এই হনুমানের কানের মধ্যে সূর্য থাকে, এখন প্রশ্ন হচ্ছে হনুমান যদি কানের ভেতর সূর্য রাখে তবে পৃথিবীর ১৩ লক্ষ গুন বড় হচ্ছে সূর্য। এই পৃথিবী সূর্যের ১৩ লক্ষ গুন ছোট! এই ছোট পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে হনুমান কিভাবে তার কানের ভেতর সূর্য রাখে? এই রকম গাঁজাখুরি গল্প যারা করে তাদের গল্প বিশ্বাস করতেই হবে? কেন আমরা এসব বিশ্বাস করব? কমবেশি সব ধর্মের মধ্যেই এরকম গাঁজাখুরি গল্প আছে। আমরা সচেতন থাকবো। এসব বলতে গেলেই বিতর্ক। যাক, তোমাদের পড়ানো শুরু করি। এসব বিতর্কে যেয়ে লাভ নেই।’ বিজ্ঞানের কথা সহজভাবে বুঝিয়ে বলা শিক্ষককে যখন কারাগারে থাকতে তখন মনের ভেতর ভীষণ প্রশ্ন জাগে! শ্রেণিকক্ষে কী এমন ভুল বলেছেন শিক্ষক? তার অপরাধ পরীক্ষা নিরীক্ষা না করেই শিক্ষককে জেল হাজতে পাঠিয়ে দিয়ে দেশ হলো ধর্মান্ধতাদের রক্ষক। রাষ্ট্রযন্ত্র কী বিজ্ঞান পড়াতে চায় না? না কী রাষ্ট্রযন্ত্র বুঝে গেছে শিক্ষার্থীরা যত বেশি পড়ে তত বেশি জানে, তত কম মানে!
স্বামী জেলে থাকার সময়ে হৃদয় মন্ডলের স্ত্রী ববিতা হাওলাদার বলেছিলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে নানা দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। আমার স্বামী যখন স্কুলে যেতেন তখন রাস্তায় ছাত্ররা তার নাম ধরে নানা কটূক্তি করতো। ক্লাসের মধ্যেও ছাত্ররা তার নাম নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করতো। বাসায় লোহার দরজায় জোরে জোরে লাথি মেরে চলে যেত, জানালায় শব্দ করতো। নাম ধরে বাসার সামনে চিৎকারও করতো। এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আমার স্বামী প্রায়ই আক্ষেপ করতেন। এ বিষয়ে তিনি ছাত্রদেরকে বুঝিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। সেজন্য তিনি এ বিষয়গুলো সহ্য করেই ক্লাস নিতেন। আমরাও এ বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই নিতে শুরু করছিলাম। আমার স্বামী কোনো ধর্মের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করেনি। তাকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে!’
রক্তের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে প্রগতিশীল মানুষ উদ্বিগ্ন কারণ আমাদের স্বাধীন দেশ সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি রাষ্ট্রদর্শন ও চিন্তা-চেতনা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। যদি পাকিস্তানি রাষ্ট্রদর্শন থেকে মুক্ত হতে পারত তাহলে নির্বাসনে যেতে হতো না প্রগতিশীল লেখকদের এবং অপমান অপদস্থ হতে হতো না বাংলার সহজিয়া মরমিয়া আউল বাউলকে। আরও দেখতে হতো না সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বিশেষ করে এক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আগুনে রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া, বটতলা ও হাতীবান্ধা গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়ি-ঘর। রাতের আঁধারে চলে লুটপাট ও নৈরাজ্য। দুর্গাপূজায় কুমিল্লার এক মণ্ডপে দুর্বৃত্তের রাখা পবিত্র কুরআন অবমাননার জের ধরে ঘটেছিল এ ঘটনা। কুমিল্লা ছাড়াও চাঁদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের নানান জায়গায় মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী দল ও মানুষ এসব ঘটনায় অফলাইন ও অনলাইনে প্রতিনিয়ত উসকানি ও ইন্ধন দিয়েছে। আমাদের দেশে এ যাবৎ যতগুলো ধর্মীয় অবমাননার নামে গ্রেফতার করা এবং আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে তা প্রত্যেকটি ঘটনা ধর্মান্ধতাদের কারণে হয়েছে। বাস্তবে কেউ কখনও পবিত্র ধর্মকে অবমাননা করেনি বরং ধর্মান্ধতারা বারবার ধর্মের দোহাই দিয়ে নিরীহ মানুষকে নিপীড়ন করেছে।
ধর্মান্ধতাদের প্রধান চরিত্র হলো ধর্মের নামে কোনো অজুহাত পেলেই জ্বলে ওঠে এবং জ্বালিয়ে দাও। এ দেশ যেন এক ধর্মান্ধতাদের চাষবাস। দেশে কী মধ্যযুগীয় সেই বর্বর যুগে চলে যাচ্ছে? ইতিহাসে সত্য কথা বলার জন্য নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে বিজ্ঞানীদের উদাহরণ হিসাবে বলা যায়। গ্রিক পণ্ডিত আর্কিমিডিস যখন গণিত নিয়ে গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তখন রোমানরা আক্রমণ করেছে তার দেশে। যুদ্ধে তার দেশের সম্রাট হেরেও গেছেন। কিন্তু গবেষণায় ব্যস্ত থাকার কারণে যুদ্ধের ফলাফল কী হয়েছে। এমন সময় এক সৈনিক এসে ধারালো খোলা তরবারি হাতে নিয়ে আর্কিমিডিসের মাথায় ধরে আত্মসমর্পণ করতে বলে। তখন বিজ্ঞানী বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আহ্, বিরক্ত কোরো না, দেখছ না ব্যস্ত আছি!’ জ্ঞানহীন মাথামোটা সৈনিক গণিতের কী বোঝে! আর্কিমিডিসকে সে চেনে না, জানে শুধু যুদ্ধ করতে। আর্কিমিডিসের কথায় তার আঁতে ঘা লাগল। তলোয়ারের এক কোপ বসিয়ে দিল সে আর্কিমিডিসের ঘাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ধুলোয় লুটিয়ে পড়লেন জগদ্বিখ্যাত বীর আর্কিমিডিস।
আরেক বিজ্ঞানী জিওর্দানো ব্রুনোকে সত্যি কথা বলার কারণে মেরে ফেলা হয়েছিল। তবে মারা হয়েছিল ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নয়, গর্দান কেটে নয়, আগুনে পুড়িয়ে! বিচারকের তেমনই হুকুম—তার রক্তের এক ফোঁটাও যেন পৃথিবীর সঙ্গে না মেশে। পুড়িয়ে মারলে তো আর রক্ত পৃথিবীতে মিশতে পারবে না। কী এমন অপরাধ করেছিলেন ব্রুনো! তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী সৌরজগতের তুচ্ছ গ্রহ ছাড়া এর আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই। পৃথিবী ও বিশ্বজগত চিরস্থায়ী নয়, একদিন এসব ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে এই সত্য রোমের শাসক মেনে নিতে না পেরে ধর্ম ও বাইবেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে মেরে ফেলা হয় বিজ্ঞানীদের।
তবে খুব আক্ষেপের সঙ্গে বলছি, একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে আমরাই সাম্প্রদায়িক- কুপমণ্ডক ধ্যান ধারণায় আছন্ন হয়ে ধর্মান্ধতা চাষ করছি। তারই ফলাফল হিসেবে আজকে বিজ্ঞান শিক্ষককে জেলে দেখতে হচ্ছে। আর দাবি তুলতে হচ্ছে অবিলম্বে বিনা অপরাধে গ্রেফতারকৃত শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের মুক্তি দিতে হবে।
বিজ্ঞান শিক্ষা সংকোচন নয় বিজ্ঞান শিক্ষার যথাযথ প্রচার ও প্রসার করতে হবে। বিজ্ঞান-পাঠকের সংখ্যা, রুচি ও প্রস্তুতির প্রবৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটাতে হবে। বিজ্ঞান-লেখকের লেখাভ্যাসের উন্নয়ন করতে হবে। সেই সাথে সাবলীল গদ্য ব্যবহার এবং সহজ পরিভাষা সৃষ্টি করতে হবে। গুণগত মানসম্পন্ন ও চমৎকার চিত্রবহুল বিজ্ঞানগ্রন্থ প্রকাশের উপযোগী প্রকাশনালয় করতে হবে। সংবাদমাধ্যমে রাশিচক্র বা এ সপ্তাহের ভাগ্য প্রচারে গুরুত্ব কমিয় দিয়ে গুরুত্ব সহকারে বিজ্ঞান-পাতায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় ছাপানো আগ্রহ তৈরী করতে হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন লেখকের লেখা বাদ নয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশে এক দিকে যেমন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাড়বে অপর দিকে বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ে তোলার পথে একটি অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়াবে। ফলে একই ধারার সেক্যুলার ও বিজ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
বিজ্ঞান শিক্ষাই পারে কূপমণ্ডুকতা ঠেকাতে মত-দ্বিমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ