Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা

অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ
১৪ এপ্রিল ২০২২ ১৫:৪৫

আজ পূর্ব দিগন্তে যে সূর্য উঠেছে, তা আর পাঁচটা ভোরের মতো হলেও এর মাহাত্ম ভিন্ন। এটি যে বছরের প্রথম সূর্য, নতুন বছরের কিরণ। নব নব স্বপ্ন আর পুরনোকে স্মৃতির মণিকোটরে গেঁথে সে এসেছে নতুন রূপে, যে কিনা অতীতের গ্লানি, রোগ-শোক, বালা-মুসিবতকে দূরে রেখে নিয়ে যাবে নতুনের অবগাহনে। নতুন দিনে, নতুন সময় তথা নতুন স্বপ্নের পানে।

নতুন বঙ্গাব্দ ১৪২৯ এবার এসেছে অনেকটা স্বাভাবিক পরিবেশে। গত দুই বছর করোনা মহামারির কারণে বাঙালির সর্বজনীন এ উৎসব আয়োজনে ভাটা পড়লেও এ বছর স্বাভাবিক সময়ের মতোই বর্ষবরণ হচ্ছে। বর্ষবরণের ঐতিহ্যবাহী আয়োজন রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান দুই বছর পর স্বমহিমায় ফিরে এসেছে। বৈশাখের প্রথম সূর্যোদয়কালের এ আয়োজন শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। সে রীতি আজও চলছে। শুধু ১৯৭১ সালে বিরূপ পরিস্থিতির কারণে তা অনুষ্ঠিত হয়নি; তবে ২০০১ সালে এ অনুষ্ঠানে জঙ্গিরা ভয়াবহ বোমা হামলা করলেও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি। কিন্তু গত দুই বছর করোনা সংক্রমণের তীব্রতায় বটমূলের অনুষ্ঠান হতে পারেনি। পাশাপাশি এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রাও চেনা রূপে ফিরেছে। এর বাইরেও পহেলা বৈশাখের উৎসব এখন গ্রাম-গঞ্জ-শহর সর্বত্র ব্যাপক মাত্রায় দৃশ্যমান। বিভিন্ন এলাকায় যেমন বৈশাখী মেলা বসে, তেমনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা অনুষ্ঠান হয়। এসব অনুষ্ঠানে বৈশাখ বরণে নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

আজ বৈশাখকে বরণ করে সবাই যেমন বলছে, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’; তেমনি কায়মনে প্রার্থনা করে চলেছে ‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/ মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’।

বিজ্ঞাপন

ঐতিহাসিকদের মতে, বৈদিক যুগে বাংলা সনের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। তবে মোঘল সম্রাট আকবর ফসলি সন হিসাবের সুবিধার্থে বৈশাখ মাসকে প্রথম মাস ধরে বাংলা বর্ষপঞ্জি চালু করেন। নবাব মুর্শিদকুলি খান বৈশাখ মাস থেকে বাংলায় প্রথম খাজনা আদায় শুরু করেন।

পহেলা বৈশাখ কেবল সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে অর্থনীতিরও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। জমিদারি আমলে বৈশাখের মূল আয়োজন ছিল খাজনা আদায় উপলক্ষে ‘রাজপুণ্যাহ’ ও ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’ উৎসব। জমিদারি প্রথা বিলোপের পর রাজপুণ্যাহও বিলুপ্ত হয়। আর আধুনিক সময়ে অর্থনৈতিক লেনদেনের ধারায় পরিবর্তন আসায় হালখাতাও তার জৌলুস হারিয়েছে।

আদিতে পহেলা বৈশাখের উৎসব খাজনা আদায়বিষয়ক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তা পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়িক দেনা-পাওনার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। গত দুই বছরের কথা বাদ দিলে এর আগের বছরগুলোতে আমরা যেমন দেখেছি, বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিচিত্র-বহুমুখী ধারায় প্রবাহিত হয়। কেবল দোকানে বকেয়া আদায়ের হালখাতা নয়; ঈদ ও অন্যান্য উৎসবের মতো পহেলা বৈশাখেও পোশাকের সঙ্গে বসতঘর ও কর্মক্ষেত্র সাজানোর আয়োজন হয়। এবারও পহেলা বৈশাখ ঘিরে অর্থনীতির পালে সে হাওয়া লেগেছে। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখের দুই সপ্তাহ পরেই ঈদ বলে এবার দুই বড় উৎসব ঘিরে এ মাসের শুরু থেকেই কেনাকাটা করছেন বিভিন্ন স্তরের মানুষ। রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র বিপণিবিতান, শপিংমলে পহেলা বৈশাখ আর ঈদের পোশাকে ব্যবসায়ীরা এনেছেন বৈচিত্র্য। বর্ষবরণে লাল, সাদা, সবুজ পাঞ্জাবি; শাড়ির সঙ্গে রয়েছে বাহারি সব পোশাক। ফলে দুই উৎসবের বিকিকিনিতে ব্যবসায়ীরাও গত দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশা করছেন।

বর্তমানে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে তাই মুখ্য হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, যা প্রবর্তনের কৃতিত্ব পুরোটুকুই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনি শান্তিনিকেতনে প্রথম ঋতুভিত্তিক উৎসবের আয়োজন করেন। বর্তমানে এ উৎসবকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠার পাশাপাশি এসেছে নতুন এক গতিশীলতা।

প্রতিটি পহেলা বৈশাখেই আমাদের সংকল্প থাকে, সমৃদ্ধ-উন্নত-গর্বিত বাংলাদেশ গঠনের পথ যেন নির্বিঘ্ন হয়। উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রযাত্রা, প্রগতিশীলতার ধারায় আমাদের পথচলা উল্লেখযোগ্য। আমাদের প্রত্যাশা, পহেলা বৈশাখ জাগ্রত করবে আমাদের শান্তি ও সম্প্রীতির চেতনা। ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র, জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার অন্তরে বাংলা নববর্ষ নতুন করে দোলা দিক।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আকাঙ্ক্ষা করেছেন নতুন বছরে- ‘অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’। এই চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা অন্যান্য পহেলা বৈশাখের মতো আজও মত-পথ নির্বিশেষে সব বাঙালির হৃদয়ে দোলা দেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। সব ধর্মের মানুষের মিলনের উৎসব বাংলা নববর্ষ। পহেলা বৈশাখের এ মহিমা অটুট থাকুক। ধর্মীয় সংকীর্ণতা আর সাম্প্রদায়িকতার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে সবাই মাতুক উৎসবের আনন্দে। আমাদের প্রত্যাশা, নতুন বছরের নতুন সূর্যোদয় বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজের জন্যও নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসবে। জীর্ণ ঝরা পাতার মতো পুরোনো বছর শেষে ঝরে পড়বে সব অন্ধকার। সম্প্রীতি ও শান্তি নতুন বছরে সবুজ পাতার মতো অঙ্কুরিত হবে আমাদের জীবনের সর্বস্তরে।

তাই আসুন রবি ঠাকুরের কণ্ঠে আমরাও বলি, ‘মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়’। আমরা মহামারি করোনা জয় করেছি। এবার সুন্দর বাংলাদেশ গড়ব। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

শরৎ বাংলাদেশের কোমল স্নিগ্ধ এক ঋতু
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৪

সম্পর্কিত খবর