পলাশীর অস্তমিত সূর্য ফের উদিত মেহেরপুরের আম্রকাননে
১৭ এপ্রিল ২০২২ ১৩:৩৮
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক পরাজয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। যে আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য আস্তমিত হয়েছিল, ১৯৭১ সালে একই আম্রকাননেই সেই স্বধীনতার সুর্যের উদয় হয় যে মহানয়কের নেতৃত্বে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সতেরশ সাতান্ন সালের ২৩ জুন বর্তমান ভারতের মুর্শিদাবাদের পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। এর ঠিক ২১৪ বছর পরে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগরে আরেক আম্রকাননে পুনরায় উদিত হয় বাংলার সেই অস্তমিত স্বাধীনতার সূর্য। পৃথিবীর ভূখণ্ডে জন্ম নেয় স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল দিনটি ছিল শনিবার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। যে দিন বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবেরপাড়া আম্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধকালীন স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ নেয়। এর মাধ্যমে ঘোষণা হয় নতুন এক রাষ্ট্রের এবং সারা পৃথিবীকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়।
এর আগে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করে সেখানে সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদ ঘোষণার ও স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের গোপন সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই কার্যক্রমের গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যায় এবং হানাদার পাকিস্তান বিমানবাহিনীর জঙ্গি বিমান ১৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বোমা বর্ষণ করে এবং সেদিনই চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। এরপর অত্যন্ত সতর্কতা ও গোপনীয়তা অবলম্বন করে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে ১৭ এপ্রিল সকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের সময় ও দিন তারিখ নির্ধারিত হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয়। দুপুরের মধ্যে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে হাজার হাজার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা–জনতা, দেশিবিদেশি সাংবাদিক এবং জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। হাজার হাজার কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ গগন বিদারী স্লোগানে মেহেরপুরের আম্রকাননের আকাশবাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহী চৌধুরী ও পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে দেবদারু গাছের পাতা দিয়ে তোরণ নির্মাণ করা হয়। গালিচা বিছানো ছোট্ট একটা মঞ্চও সাজানো হয়। তোরণের দুপাশে ঝোলানো হয় বঙ্গবন্ধুর ছবি। পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী পবিত্র কোরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তাকে রাষ্ট্রপতি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দ্বায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদের ওপর। কর্ণেল (অব) আতাউল গনি ওসমানিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাজধানীর নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। শপথ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে শপথ অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে ২৬ মার্চ হতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়। স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণের এই ১৭ এপ্রিল বাঙালি জাতির জীবনে এক শাশ্বত ঐতিহাসিক দিন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় এই দিবসটি মুজিবনগর দিবস হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বেই মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। প্রায় ১ কোটি লোক ঘরছাড়া হয়ে আশ্রয় নেয় বন্ধুপ্রতিম বিপদের বন্ধু প্রতিবেশি দেশ ভারতে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ গণধিকৃত, ধর্ষক, হানাদার পাকিস্তানিদের আত্মসমপর্নের মধ্য দিয়ে শ্বাপদের ভয়াল থাবার নখর–দন্তের বিষাক্ত ছোবল থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। শহীদের রক্তে ভেজা শ্যামল বাংলার পবিত্র মাটি মিত্র ও মুক্তিবাহিনী উদ্ধার করে। চাঁনতারা মার্কা পাকিস্তানের পতাকা চিরদিনের জন্য নামিয়ে বাংলাদেশের স্বর্ণালি মানচিত্র খচিত গাঢ় সবুজের মধ্যে রক্তিম সূর্য সম্বলিত ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশের নতুন পতাকা উড়িয়ে দেয়। আম্রকাননে উদিত হয় বাংলার স্বাধীনতার নতুন সূর্য।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
জুয়েল সরকার পলাশীর অস্তমিত সূর্য ফের উদিত মেহেরপুরের আম্রকাননে