Friday 25 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকার

প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ
১৭ এপ্রিল ২০২২ ১৩:৫০ | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২২ ১৬:৩১

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর একটি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সামনে আসে। এই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের এক নিভৃত আমবাগানে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ঘটে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এর মাঝে যুদ্ধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচে কানাচে।

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে সমর্থনের জন্য গঠিত হয় এক সরকার। যা ইতিহাসেমুজিবনগর সরকারহিসেবেই পরিচিত। অনেকের কাছে প্রবাসী সরকার নামেও পরিচিত।

বিজ্ঞাপন

১৪ এপ্রিল ১৯৭১, বুধবার। যুদ্ধাবস্থার মধ্যেই বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় ১৭ এপ্রিল ১৯৭১, শনিবার। ওইদিন সকালে মেহেরপুরের সীমান্ত এলাকা বৈদ্যনাথতলা গ্রামে নিভৃত আম্রকাননে উপস্থিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানসহ আরো অনেকে। যোগ দেন দেশিবিদেশি সাংবাদিকেরাও।

এরই মাঝে অতিথিদের জন্য গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে কিছু চেয়ার আনা হলো। যার অধিকাংশেরই হাতল ভাঙা। আমবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া পাহারায় থাকেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। খবর পেয়ে আশপাশের লোকজনও জড়ো হয়েছেনগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে প্রথম সরকার গঠনের ইতিহাসের সাক্ষী হতে।

খোলা আকাশের নিচে চৌকি পেতে তৈরি করা হলো শপথের মঞ্চ। সকাল ১১টার দিকে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। একে একে মঞ্চে উঠলেন জাতীয় চার নেতা; সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এইচ এম কামারুজ্জামানসহ অন্যরা।

শুরুতেই বাংলাদেশকেগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশরূপে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই ঘোষণাপত্রটিই হলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান আইনি দলিল, যা আমাদের সংবিধান এবং সরকার গঠনের মূল ভিত্তি। এরপর অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান।

বিজ্ঞাপন

সরকারের রাষ্ট্রপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

মন্ত্রিসভার দপ্তর বণ্টন করা হয় ১৮ এপ্রিল ১৯৭১। এরইমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন কর্নেল (অব) এমএজি ওসমানী। শপথ নেওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে ইপিআরের (ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট) একটি দল গার্ড অব অনার দেয়। পাশাপাশি রাষ্ট্রের সরকার গঠনের কথা জনসম্মুখে আনুষ্ঠানিকভাবে সেখানে ঘোষণা করা হয়।

শপথ অনুষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত সমাবেশে স্বাধীনতার মূল ঘোষণা আদেশটি ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে প্রচার করা হয় এবং এর কার্যকারিতা ঘোষণা করা হয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে। (সূত্র: লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মেজর রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম)

শপথগ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের সামনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই সরকারকেমুজিবনগর সরকারহিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে এই সরকারের বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম লাভ করে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটি।

এর মাঝে ভারতের তৎকালীন সরকার জনগণ এবং বিশ্বের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের অকুণ্ঠ সাহায্য সমর্থন এদেশের মানুষকে সাহস জুগিয়েছে।

এর আগে অর্থাৎ ২৫ মার্চের কালরাতে নিরীহ বাঙালির ওপর আকস্মিকঅপারেশন সার্চলাইটশুরু করে শেখ মুজিবকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় শাসকগোষ্ঠী।

তারা ভেবেছিল হয়তো শেখ মুজিবকে বন্দি করলেই বাঙালিকে রুখে দেওয়া যাবে। কিন্তু একাত্তরে মুক্ত মুজিবের চেয়ে বন্দি মুজিব বাংলার মানুষের কাছে হয়ে ওঠেন পাহাড়সম প্রেরণার উৎস।

তাই তো ধর্মবর্ণ, নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক দাবিবাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দৃপ্ত শপথ নেয় বাঙালি জাতি। দীর্ঘ নয় মাস অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা সংগ্রাম করেছে এদেশের মানুষ। ৩০ লাখ মানুষের রক্ত এবং বিনিময়ে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি মেলে। দুই লাখ মা বোনকে ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘৃণ্য পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।

মুজিবনগরে বাংলাদেশের যে সরকার গঠন করা হয় তা ছিল জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই গঠিত। ফলে এটি ছিল সম্পূর্ণ বৈধ সাংবিধানিক সরকার। যুদ্ধের উপরও এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। তাই বলা উচিতএই সরকারের শপথ শুধু একটি সরকার গঠনের শপথ ছিল না। এই শপথ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার শপথও।

এর মাধ্যমে মূলত ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে বাংলার যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার ঠিক ২১৪ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আরেক আম্রকাননে যেন বাংলার সেই অস্তমিত সূর্য আবারও উদিত হয়। যা বাংলার নির্যাতিত মানুষের মনে আশা জাগিয়েছিল। পথ দেখিয়েছিল নতুন দিনে, নতুন সূর্যের।

এই সরকারের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্যতার কথা উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম তারলক্ষ প্রাণের বিনিময়েবইয়ে লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন একটি আইনানুগ সরকার না থাকলে ভারত কিংবা অন্য কোনো দেশ আমাদের রাজনৈতিক এবং নৈতিক সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছুক না হলেও খুবই সতর্ক থাকতো। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন দেশগুলো ভারতের অস্ত্র সরবরাহের পদক্ষেপকে আর্ন্তজাতিক আইনের লংঘন হিসেবেও আখ্যায়িত করার সুযোগ নিতে পারতো অনেকে।

ওই অবস্থায় যুদ্ধে লিপ্ত আমরা হয়ে পড়তাম পরিত্যাক্ত এবং অসহায়! কেননা জনগণ আমাদের যতই প্রশংসা করুক না কেন, আন্তর্জাতিকভাবে আমরা সবাই বিদ্রোহী হিসেবে প্রতিপন্ন হয়ে পড়তাম। ওই পরিস্থিতিতে আমাদের কার্যক্রমের কোনো বৈধতা থাকতো না।

এছাড়া কূটনৈতিক অঙ্গনে সমর্থনের অভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে যেকোনো বিষয় ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। সমস্ত কিছু বিবেচনায় এনেই ওই সময় বাংলাদেশের আইনানুগ সরকার গঠনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

সীমিত সামর্থ্যের মাঝে মুজিবনগর সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ প্রশাসন পরিচালনা করেছে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং স্বাধীনতার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ওই সরকার এক কোটির বেশি শরণার্থীর জন্য ত্রাণ, দেশের অভ্যন্তর থেকে লাখ লাখ মুক্তিপাগল ছাত্রজনতাযুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে; যা পাকিস্তানিদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করেছিল।

একই সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ রাখা, বিশ্ব জনমত গঠনসহ বিভিন্ন অবিস্মরণীয় কীর্তি সম্পন্ন করেন ওই সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা; যা সমকালীন বিচারে অতুলনীয় অবিস্মরণীয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর অবস্থিত ছিল কলকাতার সার্কাস এভিনিউয়ে। সেখান থেকেই মূলত কূটনীতিক কার্যাবলী সম্পাদিত হতো। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের এইড অ্যান্ড অ্যাডভাইজার ছিলেন ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম।

যুদ্ধদিনের সরকার পরিচালনার নানা কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করেছেন তার বিভিন্ন স্মৃতিচারণামূলক লেখায়ও। তিনি লিখেছেন,…বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতির আবেদন জানিয়ে সে সময়কার ১০৭টি দেশের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠির সঙ্গে পাঠানো হয় তিনটি করে সংযুক্তিবঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং লস কন্টিনিউয়েন্স অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট অর্ডার।

‘…পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। যুত্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটসহ সর্বত্র তার (বঙ্গবন্ধু) নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় স্থান পায়। বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তা সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি থেকে শুরু করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে যে দাবি চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, সে ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; জামালপুর

সারাবাংলা/এসবিডিই

প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকার