ইদযাত্রায় এবারও কি দুর্ভোগই সঙ্গী?
১৭ এপ্রিল ২০২২ ২১:৫৭
ইদযাত্রায় মহাসড়কে যাত্রীদের দুর্ভোগের বিষয়টি নতুন নয়। প্রতিবছর ইদের সময় ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় মহাসড়কে এবার ঘরমুখী মানুষের ঢল নামবে। অনুমিতভাবেই গত দুই বছরের তুলনায় বেশিসংখ্যক মানুষ ঈদে গ্রামের বাড়িতে যাবেন। কিন্তু মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ চলায় যাত্রী ও চালকদের দুর্ভোগ বাড়বে।
দেশের চারটি প্রধান মহাসড়কের মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে যানজটের আশঙ্কা বেশি। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও যানবাহনের জট তৈরির আশঙ্কা করছেন চালক ও যাত্রীরা। এছাড়া ঢাকা-খুলনা পথে পদ্মা নদী পার হতে ভোগান্তির আশংকা রয়েছে আগের মতোই।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক
ইদুল ফিতরে ঘরমূখী মানুষের শেকড়ে ফেরার অন্যতম পথ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। এই সড়কে গত কয়েক বছরে অনেক উন্নয়ন হলেও স্বস্তির আশা নেই। কারণ এখনও বিভিন্ন অংশে সংস্কার ও নির্মানকাজ চলায় মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দিসহ কয়েকটি স্থানে নিয়মিতই যানজট হচ্ছে। যা ইদের সময়ে বহুগুন বাড়বে বলে আশংকা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার ও সীতাকুণ্ডের কয়েকটি স্থানে লেনের সংস্কারকাজ চলাকালীন চার লেনের যানবাহনগুলো দুই লেনে চলাচল করেছে। বিশেষ করে দাউদকান্দি অংশে যানজটের কারণে এক ঘণ্টার পথ অতিক্রম করতে ৫-৬ ঘণ্টা সময় লাগছে। অনেক সময় সংস্কার এলাকার কয়েক কিলোমিটারে সৃষ্টি হওয়া যানজট ধীরে ধীরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ ও কুমিল্লার দিকে চান্দিনা এলাকা পর্যন্ত পৌঁছায়। সীতাকুণ্ডেও কয়েকটি স্থানে গিয়ে জ্যামের শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। ঈদযাত্রায় এ অংশে যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করছেন সাধারণ মানুষ।
ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক
ঢাকা থেকে রংপুর হয়ে পঞ্চগড় উত্তরাঞ্চলগামী মহাসড়কে যানজটের আশঙ্কার কারণ সড়কে নির্মাণকাজ। এই সড়কের বিভিন্ন অংশে উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ চলমান। সড়কের বেহাল দশায় স্বাভাবিক সময়েই প্রতিদিন এ সড়কে যানজট লেগে থাকে। যা ইদের সময়ে তীব্র আকার ধারণ করে।
ঢাকা থেকে যারা উত্তরবঙ্গে যেতে নবীনগর মোড় পার হতেই যানজটে পড়তে হয়। চন্দ্রার রাস্তাটিতে গাড়ি উঠতে পারলে চার লেনের প্রশস্ত সড়ক। এ সড়ক ধরে যাওয়া যায় টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত। এ পথে থাকা মির্জাপুরের গোড়াইয়ে উড়ালসড়ক ইদের আগেই খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু সমস্যা হলো বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত যাওয়া।
এলেঙ্গার পার হতেই সড়কের কোথাও চার লেইন কোথাও দুই লেইন। চার লেনের সড়ক ধরে গাড়ি দ্রুত এগুনোর পর দুই লেনের সড়কের মুখে জানযট লেগে যায়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতুও দুই লেনের। ফলে যানবাহনগুলো সেতুতে টোল দিতে গিয়ে এবং সেতু পার হতে গিয়ে যানজটের শিকার হয়। কয়েক বছর ধরে মূলত এ কারণেই যানজট হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৩ হাজার যানবাহন সেতু পার হয়। কিন্তু ঈদযাত্রায় এই সংখ্যা ৩০ থেকে ৩৫ হাজারে উন্নীত হয়। এসবের ফলে ইদের সময় যানজট ভয়াবহভাবে বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে চার লেনের নির্মানযজ্ঞ চলছে। এছাড়াও এ মহাসড়কের অন্যতম বড় সমস্যা যত্রতত্র পার্কিং ও যানবাহনের অবৈধ স্ট্যান্ড। যা এবারের ইদযাত্রায় দুর্ভোগের কারণ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে গাড়ির চালক ও মহাসড়ক সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মাত্র ১২ কিলোমিটার সড়ক সঠিকভাবে দেখভালের অভাবে মূলত যানযট হয়। এই ১২ কিলোমিটার হচ্ছে সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর থেকে ভুলতা পর্যন্ত। এই অংশটুকুতে মূল রাস্তা দখল করে বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে আঞ্চলিক পথে চলাচলকারী যানবাহন যেমন লেগুনা, সিএনজিচালিত অটোরিকশাস্ট্যান্ড। এছাড়া এই সড়কজুড়ে বিভিন্ন কলকারখানা যেমন স্পিনিং ও পেপার মিলের মালবোঝাই ট্রাক ও লরির যত্রতত্র অবৈধ পার্কিং, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নামে সড়কে চাঁদাবাজিও একটি বড় সমস্যা।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজটের আশঙ্কার কারণ সড়কে নির্মাণকাজ। ঢাকা শহরের সীমানা পার হলেই গাজীপুরের টঙ্গী। এখান থেকে শুরু হয়েছে খানাখন্দ আর ভাঙাচোরা রাস্তার। অনেকে বলেন, টঙ্গীতে গাড়ি নিয়ে গেলে নাকি সাজেকের মেঘের রাজ্যের দেখা মেলে। বস্তুত ধুলার রাজ্যকে রসিকজন মেঘের সঙ্গে তুলনা করাটা নির্মম রসিকতা হলেও ওই এলাকার জন্য এটাই বাস্তবতা।
এই বেহাল সড়কের একদিকে চলছে উন্নয়নকাজ, অন্যদিকে সংকুচিত হয়ে যাওয়া সড়ক দিয়ে প্রতিদিন চলছে কয়েক লাখ যানবাহন। ফলে এখনই প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে থাকে যানজট। এই মহাসড়কের গাজীপুরের টঙ্গী সেতু থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়কে যাত্রীদের দুর্ভোগ লেগেই থাকে। এ সড়কে ২০১২ সালে শুরু হয় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ, যা ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। ১২ কিলোমিটার অতিক্রম করতে এখন সময় লাগে ৩-৪ ঘণ্টা, কখনো কখনো এর চেয়েও বেশি। এছাড়া টঙ্গী থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার সড়ক এখনো খানাখন্দে ভরা। তাই যাত্রীদের অতিরিক্ত দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ইদের আগে এ সড়কে যানবাহনের চাপ বাড়লে যাত্রীদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আরেক বড় সমস্যা সড়কে পানি জমে থাকা। বৈশাখের শুরু থেকে বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই হিসাবে ইদের আগেও বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টি হলে এ সড়কে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
দৌলতদিয়া- খুলনা মহাসড়ক
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রীদের বড় সমস্যা পদ্মা পাড়ি দেওয়া। ইদের সময়ে এই রুটে ফেরিতে উঠতে পারাটাই চ্যালেঞ্জ। বাংলাবাজার-শিমুলিয়া এবং মাঝিকান্দি-শিমুলিয়া নৌরুটে ফেরি সংকট এবং শুধুমাত্র সকাল-সন্ধ্যা ফেরি চলাচল করায় আসন্ন ঈদুল ফিতরে দক্ষিণাঞ্চলের ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরি ও ঘাট চাহিদার তুলনায় কম।
দৌলতদিয়া প্রান্ত ব্যবহার করে দিনে গড়ে সাড়ে চার হাজার যানবাহন ও লাখো যাত্রী পার হয়। ঈদ ঘিরে এ সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এ পথে সচরাচর ২০টি ফেরিতে গড়ে ২০০ যানবাহন পার হয়। বর্তমানে নৌ চ্যানেল সরু থাকায় ফেরি কমে ১৭টি চলাচল করছে। আর পানি কমে চর জাগায় পারাপারেও লাগছে দ্বিগুণ সময়। তাই এবার ইদের আগেই ভয়াবহ যানজট হচ্ছে পাটুরিয়া প্রান্তে। শুক্র ও শনিবার সহস্রাধিক যানবাহনের চাপে সাত-আট ঘণ্টা ঘাটে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান না হলে এবারের ঈদযাত্রায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার ঘরমুখো বাসিন্দাদের সীমাহীন দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হবে।
কী চিত্র দেশের অন্য সড়কের?
মহাসড়কের অবস্থা তো জানা হলো। কিন্তু মহাসড়ক পার হলেই যে কেবল ভোগান্তির শেষ তা কিন্তু নয়। কেবল একটি পাঁচটি প্রধান মহাসড়কই নয়, ইদের আগে-পরে দেশের সব মহাসড়কেই যানবাহনের চাপ বেশি থাকায় যানজট সৃষ্টি হয়। মহাসড়কের পাশে হাটবাজারের কারণেও যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে দেশের মহাসড়কগুলো কার্যত মহাসড়ক হয়ে উঠতে পারছে না। বর্তমানে সারা দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে ছোট-বড় হাজার হাজার দোকান নিয়ে কয়েক শ স্থায়ী, অস্থায়ী ও অবৈধ হাটবাজার গড়ে উঠেছে। আর এসব হাটবাজারকেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে যানবাহনের গতি কমে যাচ্ছে। যত্রতত্র মানুষের রাস্তা পারাপারের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা, বাড়ছে যানজট।
ইদের সময়ে মহাসড়কে যানযটের আরেকটি বড় কারণ, ভিআইপিদের গাড়ি ও রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এসব যাত্রীবাহী যানবাহন নিয়ম লঙ্ঘন করে চলাচল করে। এতে মহাসড়কে যানজট সৃষ্টি হয়।
এখন পর্যন্ত চোখে পড়া পদক্ষেপ
ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে নানা প্রস্তুতির কথা শোনাচ্ছে সড়ক বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংস্কারকাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে গত শনিবার এক সভায় ২০ এপ্রিলের মধ্যে সব সড়ক চলাচলের উপযোগী করার নির্দেশ দেওয়া হয়। বৈঠকে বলা হয়, যেখানে যেখানে মেরামত দরকার, তা আগে করে ফেলতে হবে। মহাসড়কগুলো যাতে স্থানীয় সড়কের মতো হয়ে না যায়, সেজন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। মহাসড়কের যত্রতত্র অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। ঈদে যাত্রীদুর্ভোগ কমাতে মহাসড়কের খানাখন্দ দ্রুত মেরামতেও মনোযোগী হতে হবে।
তথ্যসূত্র: সারাবাংলা ডট নেটসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সাম্প্রতিকতম তথ্য
লেখক: উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ইদযাত্রায় মহাসড়কে এবারও কি দুর্ভোগই সঙ্গী? জুয়েল সরকার মত-দ্বিমত