Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: হীরক জীবন

হাবীব ইমন
১৬ এপ্রিল ২০২২ ১৯:০৩

‘পূর্ণতা-অপূর্ণতার প্রসঙ্গটি হল একটি আপেক্ষিক বিষয়। অনেক বিষয়ে আমার সন্তুষ্টি আছে, আবার অনেক বিষয়ে আমার মাঝে অপূর্ণতার অনুভূতিও আছে। তবে পূর্ণতা-অপূর্ণতা নিয়ে আত্মবিশ্লেষণ করা আমার কাছে সময়ের অপচয় বলে মনে হয়। মানবমুক্তির জন্য নিরন্তর কাজ করে যাওয়াটিই হলো বড় কথা। সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি, এটিতেই আমি পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট।’ —কথাগুলো কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের বাম রাজনীতিতে বৈচিত্র্যময় সংগ্রামমুখর জীবন তার। জীবনের নানা বাঁকে তার জীবন আজ পঁচাত্তরের হীরক আলোর জীবন। খাদহীন হীরের মতো জ্বলজ্বল। অন্তরালে থাকতে ভালোবাসেন তিনি। ক্ষয়ে যাওয়া একটি সমাজে প্রজ্ঞাবান, সৎ, নিষ্ঠাবান, শৃঙ্খলাসম্পন্ন, সমাজ ও সময়সচেতন বিরল মানুষ হিসেবে রাজনীতিতে তিনি অবিসংবাদিত।

ঢাকার অদূরে সাভারে সাভার উপজেলার গেন্ডা গ্রামে। এখানেই তাদের কয়েক পুরুষের বাস। এ গ্রামেই তার জন্ম, ১৯৪৮ সালের ১৬ এপ্রিল। জন্মের পর তার নাম রেখেছিল মুজাহিদুল ইসলাম খান। ডাক নাম ছিল সেলিম। তবে শৈশবেই মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নামে নিজেকে পরিচিত করতে শুরু করলেন। পাকিস্তানী খানদের প্রতি অত্যাচার আর নির্যাতনের প্রতিবাদস্বরূপ নাম থেকে ‘খান’ শব্দ ব্যবহার করা বাদ দেন।

বাবা মোসলেহ উদ্দিন খান ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, আর মা উম্মে হানী খানম ছিলেন নারীনেত্রী ও সমাজসেবক। বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান সেলিম। তার বড় দুই বোন, ছোট পাঁচ বোন। সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত।

ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করার প্রবল তাড়না থেকেই তার গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলেন। ওই সময় যৌথ পরিবার থেকে চলে আসাটা বেশ চ্যালেঞ্জিংও ছিল। তিনি নিজে প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফাইভ-সিক্স পর্যন্ত পড়েছিলেন। প্রবল আগ্রহ থাকা সত্তে¡ও এর পরে আর লেখাপড়া চালানো সম্ভব হয়নি তার। সবসময় সেই অতৃৃপ্তি বয়ে বেড়াতেন। তার মধ্যে সব সময় এ চিন্তা কাজ করেছে যে, তার সন্তানরা বিশেষ করে মেয়েরা যেন উচ্চশিক্ষিত হতে পারে। পরিবার, সমাজের কাছ থেকে অনেক কটু মন্তব্য শোনা সত্তে¡ও তিনি মেয়েদের শিক্ষিত করেছেন। যারা একসময় সমালোচনা করেছেন, পরে তারাই তাদের মেয়েদের শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ করেছেন।

বিজ্ঞাপন

বাবার চাকরির সুবাদে কমরেড সেলিমের মা গ্রামের বাড়ি থেকে কলকাতায় চলে যান। সেখানেই তার অগ্রজ দুই বোনের মধ্যে মেজ বোনের জন্ম। তখন খালা, মামাসহ পরিবারের আরও অনেকে কলকাতায় চলে আসেন। সব মিলে কলকাতায় একটি পারিবারিক আবহ সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মা ফের গ্রামে চলে আসেন। বোমা বর্ষণের কারণে তখন অধিকাংশ মানুষই শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায়।

দাদার মৃত্যুর দুই-আড়াই বছর পর মূলত মায়ের আগ্রহেই তাদের গোটা পরিবার ঢাকায় চলে আসেন। এ প্রসঙ্গে কমরেড সেলিম বলেন—‘সংসার স্থানান্তরের কথা আমার আবছা মনে আছে। আমরা সাভার থেকে নৌকায় করে বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের ঘাটে আসি। হাসপাতালের কেবিনেই ছিলাম কয়েক মাস; সেখানেই আমার তৃতীয় তথা পিঠাপিঠি ছোট বোনের জন্ম হয়।’

গোপীবাগের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে তারা বসবাস শুরু করেন। তখন রেলস্টেশন ছিলো ফুলবাড়িয়ায়। মতিঝিল ছিলো বন-জঙ্গলে ভরা। কমলাপুর থেকে দক্ষিণ দিকের পুরো অঞ্চল বর্ষার পানিতে টইম্বুর থাকত। সেখানে তারা শাপলা তুলতেন।

সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলে আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়েই কমরেড সেলিমের স্কুলে যাওয়া শুরু। যদিও ওই স্কুলে বেশিদিন যাওয়া হয়নি। তখন তারা শান্তিনগরের চামেলিবাগে ভাড়া বাসায় থাকতেন। যখন নয়াপল্টনে চলে আসেন তখন কলেজিয়েট ব্রাঞ্চ স্কুলে পড়া শুরু করেন। ওই স্কুলটিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন তিনি।

কলেজিয়েট (ব্রাঞ্চ) স্কুলে পড়ার সময়ই তার মা আরও ভালো স্কুলে পড়ানোর চিন্তা করলেন। কলেজিয়েট থেকে তৃতীয় শ্রেণি পাস করে সেন্ট গ্রেগরিতে গিয়ে ফের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হোন। সেন্ট গ্রেগরিতে ছিলো ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষাব্যবস্থা। সেলিমের ভাষায়—এটিই ছিল তার জীবনের মোড় পাল্টে দেয়ার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা, সেন্ট গ্রেগরি তখন ছিল সারা দেশের মধ্যে অন্যতম সেরা স্কুল। বাংলা এবং ইংলিশ মিডিয়াম দুটোই ছিল। সেখানে ঢাকা শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেরা পড়তে আসতো। প্রতিবছর সেরা রেজাল্ট এই স্কুল থেকেই হতো। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম অবস্থান সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের জন্য বলতে গেলে বরাদ্দই ছিলো।

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি স্কুলে খুব নিয়মিত ছিলাম না। এই সময়টা স্কুল পালানো স্বভাব ছিলো। অযথা ছুটি নিয়ে বাইরে চলে যেতেন। রেজাল্টও ভালো ছিলো না। নবম শ্রেণিতে যখন বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হোন, ফলাফল এক লাফে শীর্ষে উঠে গেল। তখন থেকেই স্কুলের সব পরীক্ষায় তিনি ‘ফার্স্ট বয়’। গণিতে ১০০-এর মধ্যে ১০০ পাওয়া তার জন্য এক রকম নির্ধারিতই ছিল। ম্যাট্রিকেও ১০০ পেয়েছিলেন।

মায়ের অনুপ্রেরণায় পাকিস্তান রেডিওতে কবিতা আবৃত্তি করার শুরু করলেন। সময়টা তখন ১৯৫৫ সাল। পরিচালক তখন তার আবৃত্তি শুনে শিশু শিল্পী হিসেবে নাটকে তালিকাভুক্ত করলেন। ফতেহ লোহানী, রণেন কুশারী, কাফি খান, মাধবী চ্যাটার্জী, আয়েশা আক্তার, কাজী খালেক, ইকবাল বাহার চৌধুরী, আমিনুল হক প্রমুখের মতো বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীর সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হয়েছিলো তাঁর। সমর দাশ, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান সবাইকে খুব কাছে থেকেই পেয়েছিলেন। শিশুশিল্পী হিসেবে সকলেই তাঁকে স্নেহ করতেন।

নৃত্যশিল্পী-অভিনয় শিল্পী লায়লা হাসান, তার বড় বোন ডেইজি আহমেদ, মোদাব্বের হোসেনের ছেলে মন্টি, আহসান হাবিবের মেয়ে কেয়া প্রমুখ শিশু শিল্পীদের সাথে অভিনয় করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’, ‘সম্পত্তি সমর্পণে’র মতো অনেক বিখ্যাত নাটকে অভিনয় করার সুযোগ হয়েছে তার। পাকিস্তান রেডিওতে অভিনয় করতে করতেই ভয়েস অব আমেরিকা থেকে তাকে অভিনয় করার আহ্বান জানানো হয়। ভয়েস অব আমেরিকায় আব্রাহাম লিংকনের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয়ের কথা তিনি আজও ভুলতে পারেন না।

রেডিওর বাইরে মঞ্চনাটকে অভিনয় করার অনেক অনুরোধ পেয়েছিলেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রিফিউজ করেছিলেন। এর মধ্যে ‘দেওয়ানা মদিনা’ নামের মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছিলেন। ওই নাটকে সুলতান আহমেদ এবং আয়েশা আকতার খানম নায়ক-নায়িকার অভিনয় করেন। তাছাড়াও জেলা পরিষদ মিলনায়তনসহ দু-একটি মঞ্চে নাটকে অভিনয় করেছিলেন।

একদিন ফতেহ লোহানী বললেন, তাকে সিনেমায় অভিনয় করতে হবে। কমরেড সেলিম তার বাবাকে সে কথা জানাতে বললেন। সিনেমায় অভিনয় করা নিয়ে বাড়িতে দ্বিধা ছিল। কেউ কেউ মনে করলেন-এই জগতে গেলে সেখান থেকে তিনি আর ফিরতে পারবেন না। লেখাপড়ার সর্বনাশ হবে। শেষ পর্যন্ত বাড়ি থেকে অনুমতি দেয়া হয়। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ফতেহ লোহানীর পরিচালনায় ‘আসিয়া’ সিনেমায় নায়কের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেন। যেদিন প্রথম শুটিং হয়, তখন তিনি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। অভিনয়ের আগের দিন তার জ্বর ছিলো। গ্রামের একজন ডানপিটে ছেলের চরিত্রে আমি পাতলা গেঞ্জি এবং লুঙ্গি পরে অভিনয় করেন। সম্ভবত, ‘আসিয়া’ সিনেমার চিত্রগ্রহণের মাধ্যমেই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম কাজ শুরু হয়েছিল। আর্থিক সংকটের কারণে ছবিটি শেষ করতে ৩-৪ বছর লেগে যায়। ওই সময়ের মধ্যেই প্রথম বাংলা ছবি হিসেবে ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পেয়েছিলো।

পাকিস্তান আমলে ঢাকা টেলিভিশন যেদিন উদ্বোধন করা হয়, (বর্তমান রাজউক ভবনে) সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও কমরেড সেলিম কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম। এটিও তার শিল্পী জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পড়ালেখার চাপ আর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার কারণে তিনি আস্তে আস্তে অভিনয় থেকে দূরে সরে যান।

ষাটের দশকে নামকরা স্কুলগুলোতে স্কাউট আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। তিনি তৃতীয় শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠার পরপরই জুনিয়র স্কাউট তথা কাব সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। এরপর নানা রকম প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে বিশেষ স্কাউটিং-এর নিয়ম-শৃঙ্খলা আয়ত্ত করেন এবং সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের ‘ফিফথ ট্রুপ’-এর সদস্য হোন; এক সময় তার ট্রুপ লিডারও হয়েছিলেন।

স্কাউট আন্দোলন ছিলো তার জীবন গঠনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিশেষ আগ্রহ-উদ্দীপনা নিয়েই এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। অনেক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। স্কাউট আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি সিগন্যালিং, সেতু নির্মাণ, রান্না, ফার্স্ট এইড, সাঁতার ইত্যাদি অনেক কিছু শিখতে পেরেছেন। স্কাউট আন্দোলনের মাধ্যমে সময়জ্ঞান সম্পর্কেও বিশেষভাবে সচেতন হয়েছেন, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং আগে-পরে আমার রাজনৈতিক জীবনেও গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলেছে।
স্কাউট আন্দোলনের সময়ই তিনি রেডক্রসের হয়ে কাজ করতেন। বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সাধারণ মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, রেডক্রসের শতবর্ষ উপলক্ষে আমেরিকায় জুনিয়র রেডক্রসের সদস্যদের আন্তর্জাতিক সমাবেশে যাওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে দুইজন নির্বাচিত হোন। এ সময়কালে ওয়াশিংটনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়।

ষাটের দশকের আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, পাদ্রিদের দ্বারা পরিচালিত ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে দ্বৈত শিক্ষাব্যবস্থায় এমন নানা ঘটনা কমরেড সেলিমকে ক্রমেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী করে তোলে। ’৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে তাদের বাড়িতে আলোচনা হত। বলা যায়, শৈশব থেকেই রাজনীতির সঙ্গে পরিচিতি। যদিও তিনি পড়ালেখা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতাম। অষ্টম শ্রেণির পর থেকেই তিনি সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের সেরা ছাত্র। স্কুলের টেক্সট বইয়ের বাইরেও নানা কাজে অংশ নিতেন তিনি। একবার তিনি ফেলে দেয়া ছোটখাট কিছু যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে হাইড্রলিক টারবাইন বানিয়ে বাল্ব জ্বালাতে সক্ষম হোন। জাতীয় বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে ওই প্রজেক্টটি জমা দিয়ে সেরা প্রজেক্টের পুরস্কারও পেয়েছিলেন। বাড়িতেও রাসায়নিক দ্রব্য এনে গবেষণা করতেন। এগুলো নিয়েই সময় চলে যেতো। কিন্তু এসএসসি পাস করার পর এসবের পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।

সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে পাস করে ছাত্ররা সাধারণত নটরডেম কলেজে ভর্তি হতো। কিন্তু তারা কয়েক বন্ধু অন্যরকম চিন্তা করলেন। এসএসসি পরীক্ষার পর অবসর সময়ে বন্ধুরা বসে আলোচনা করতেন- নটরডেম কলেজে ভর্তি হলে আবারো পাদ্রিদের সেই কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যেই থাকতে হবে। তারা আর এমন কঠোর বন্দি অবস্থার মধ্যে থাকতে চাই না। এবার ভিন্ন কিছু করা দরকার। ছাত্র হিসেবে তাদের আরও দায়িত্ব আছে। দেশের জন্য কাজ করতে হবে। তখন ছাত্র রাজনীতি তুঙ্গে। ভালো ছাত্ররাই রাজনীতি করতেন। ধীরে ধীরে তিনি ছাত্র সংগঠনগুলোর ব্যাপারে খোঁজ নিতে থাকেন। তুলনা করতে থাকেন ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগের মধ্যে। লক্ষ্য করেন, ভালো এবং মেধাবীরাই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের স্কুলের অনেক বড় ভাই তখন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। ছাত্র ইউনিয়নের ইশতেহার, বইপত্র সবই তাকে আকৃষ্ট করতে থাকে। এক পর্যায়ে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন, রাজনীতি করতে হলে বামপন্থি, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রগতিশীল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েই রাজনীতি করবেন। এরপর প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও যোগাযোগ করতে থাকেন। শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের বড় ভাইদের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকেন।

এই সময়ের মধ্যেই মনজুরুল আহসান খান তাকে নটরডেম কলেজের লাইব্রেরি থেকে একটি বই এনে নিজে পড়ার পর পড়তে দিলেন। তিনি তখন ওই কলেজের ছাত্র। বইটি ছিল মার্ক্স-এঙ্গেলসের ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’। এই কমিউনিস্ট ইশতেহারের প্রথম বাক্য থেকে শেষ বাক্য পর্যন্ত তাকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। তিনি দেখলেন, বইটির প্রতিটি বাক্যই বিজ্ঞানসম্মত এবং যুক্তিসঙ্গত। সত্য কথা বলতে, রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার মত এ বইটিও তার ওপর প্রভাব ফেললো। তার সাধারণ ভাবনাগুলোকে আরও সুনির্দিষ্ট করে দিল। তখন বন্ধুদের সঙ্গে আরও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আমরা ঢাকা কলেজে ভর্তি হবেন এবং তা-ই করলেন। সেটি ১৯৬৫ সালের কথা।

ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েই ছাত্র রাজনীতি করতে শুরু করেন। তখন রাজনীতি করতে হলে হোস্টেলে থাকা জরুরি। বাবা-মা বললেন, তুমি বাসা থেকে ক্লাস করবে। তিনি বললেন, ভালো রেজাল্ট করতে হলে লাইব্রেরি ওয়ার্ক করতে হবে, আর লাইব্রেরি ওয়ার্ক করতে হলে হোস্টেলে থাকা জরুরি। মূলত রেজাল্ট নয়, রাজনীতির কারণেই আমি হোস্টেলে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এই কারণেই বাবা-মায়ের কাছে মিথ্যা অজুহাত তুলে ধরেছিলেন।

অতিগোপনে তিনি রাজনীতি করতে থাকেন। রাতে হলগুলোতে ছোট ছোট করে সভা করেন। ছাত্র ইউনিয়নের নামে কাজ করা যেতো না। তাই ‘অগ্রদূত’ নাম ব্যবহার করে কাজ করতেন। হোস্টেলে, ক্লাসে, কলেজে তার শাখা গঠন করতে থাকেন। প্রকাশ্যে কোনো সভা-সমাবেশ করতে পারতেন না। কলেজে একটি শহীদ মিনার ছিল বটে। কিন্তু সেখানে কাউকে ফুল দিতে দেয়া হত না। ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে গেরিলা কায়দায় শহীদ মিনারে ফুল দেন।

ঢাকা কলেজ এবং নটরডেম কলেজের ১৫-২০ জন বন্ধু মিলে সে সময় তারা ‘সত্যাশ্রয়ী’ নামে একটি পাঠচক্র খুলেন। সেখানে যারা অংশ নিতেন তাদের অনেকেই এখন সমাজের পরিচিত মুখ। পাঠচক্রে কার্ল মার্ক্স থেকে শুরু করে আইনস্টাইনের মতবাদ সবই আলোচনা হতো। মার্ক্সবাদকে জানা এবং বোঝার জন্য প্রতিযোগিতা চলত।

এইচএসসি’র মাঝামাঝি সময়ে সরকারি কলেজগুলোতে বেতন আড়াই টাকা থেকে বাড়িয়ে সোয়া তিন টাকা করা হলো। তাদের মতো স্ট্যান্ড করা ছাত্রদের বেতন দিতে হতো না, উল্টো স্কলারশিপ পেতেন। কিন্তু বেতন বৃদ্ধির প্রভাব গোটা দেশের শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ল। ইতিপূর্বে শরীফ কমিশন, হামিদুর রহমান কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। দেখা গেল যে সরকার গোপনে আবারো শিক্ষামূল্য বাড়িয়ে শিক্ষা সংকোচননীতি অনুসরণ করার প্রয়াস চালাচ্ছে। ছাত্র সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদে সারাদেশে ধর্মঘট আহ্বান করল। ঢাকা কলেজে ধর্মঘট হবে, এটি কেউ চিন্তাও করতে পারত না। কিন্তু তারা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন, যেকোনো মূল্যে ঢাকা কলেজে ধর্মঘট পালন করা হবে। তিনি তখন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং সিটি কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। ধর্মঘটের ব্যাপারে বিকালে মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তারা ধর্মঘট পালনে সফল হোন।

সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তাদের চারজনকে ঢাকা কলেজ থেকে টিসি দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। তারা চারজন গিয়ে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হোন। তখন জগন্নাথ কলেজ ছিল রাজনৈতিকভাবে নিগৃহীত ছাত্রদের শেষ আশ্রয়স্থল। পরীক্ষায় তারা চারজন প্রত্যাশামতো অনেক ভালো রেজাল্ট করেই বের হলেন। জগন্নাথ কলেজে এরকম ভালো রেজাল্ট আগে কখনো হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবি সম্বলিত ৬-দফা উত্থাপন করেন। এ দাবির স্বপক্ষে হরতাল পালন করতে গিয়ে তিনি গ্রেপ্তার হলেন। এক মাসের জেল হলো তার। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হোন।

১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর গোপন কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্যপদ লাভ। ছাত্র ইউনিয়নের একাদশ জাতীয় সম্মেলনে সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত। ১৯৭০ সালে একাদশ জাতীয় সম্মেলনে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত। প্রলঙ্ককর জলোচ্ছ্বাসে কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে নোয়াখালীতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৩ ডিসেম্বর ২০০ জনের গেরিলা দল নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে মার্চ।

১৯৭২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে তার নেতৃত্বে ‘শিক্ষানীতি কমিটি’ প্রস্তাবনা খসড়া উপস্থাপন করেন তিনি। ত্রয়োদশ জাতীয় সম্মেলনে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হোন। মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সেলিম স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) প্রথম সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাজধানীতে এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ওই বছরের ৪ নভেম্বর প্রথম যে মিছিল হয় তার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সেলিম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স করেন। ১৯৭৬ সালে ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ওই বছরের ১৮ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন। দুই বছরের বেশি সময় বিনা বিচারে নিরাপত্তা বন্দী হিসেবে কারারুদ্ধ থাকেন। একই সময় প্রায় দুই মাস সেনা নিয়ন্ত্রিত বন্দী শিবিরেও নির্যাতন ভোগ করেন।

ছাত্র জীবন শেষে সেলিম পার্টি-জীবনকে বেছে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ক্ষেতমজুরদের সংগঠিত করার কাজে মনোযোগ দেন। তিনি বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হোন। বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে শুরুর দিক থেকে সেলিম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রাজনৈতিক কারণে প্রায় আট বছর কারাবরণ ও আত্মগোপনে ছিলেন এই নেতা। ২০১৩ সালে তিনি ১৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের জনসভায় অতর্কিত হামলায় আহত।

১৯৯০ সালে ঐতিহাসিক ‘তিন জোটের রূপরেখা’র প্রথম খসড়া তৈরি করেন।

১৯৭৯ সালে নাসিমা সুলতানার সাথে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়। ব্যক্তিগত জীবনে সেলিম এক মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানের জনক। রাজনৈতিক কর্মকান্ডের অংশ হিসেবে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন।

‘রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ’, ‘মার্কসবাদ একটি চিরায়ত দর্শন’, ‘বিকল্পের কোনো বিকল্প নেই’সহ বিভিন্ন গ্রন্থের প্রণেতা। এছাড়া রাজনীতির ফাঁকে ফাঁকে তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় কলামও লিখছেন।

কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের জন্ম হীরক জয়ন্তিতে আমরা তার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। মাথার উপর বটগাছ থাকা বলে একটা কথা আছে—তিনি বাংলাদেশের বামরাজনীতির কিংবদন্তিরূপে বেঁচে থাকবেন, তাঁর সমগ্রজীবনে বৈচিত্র্যময় চরিত্রে। নির্মাণ করা কালজয়ী সব ঘটনাসমূহের মধ্য দিয়ে।

তার প্রতি আমাদের বিনম্র ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা অনন্তকাল।

সূত্র : বৈঠকি আলাপে কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

লেখক: রাজনীতিবিদ

সারাবাংলা/এজেডএস/এসবিডিই

মত-দ্বিমত মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম হাবিব ইমন

বিজ্ঞাপন

নতুন ইসির শপথ রোববার দুপুরে
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:২৩

আরো

সম্পর্কিত খবর