বিচার না পাওয়া, বিচারে বিলম্ব, ধীরগতির কথা শুনতে–শুনতে কানের শক্তিতেও অকুলান। এককথায় এগুলোকে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ নামে সম্বোধন করা হয়। এই সংস্কৃতিও এখন চাপা পড়ে যেতে বসেছে ‘বিচার চাই না’ নামের নতুন সংস্কৃতির ধামায়? তা কী বার্তা দিচ্ছে সমাজকে? ছোটখাটো ঘটনায়ও কারো কারো মধ্যে ‘বিচার চেয়ে কী হবে’ ধরনের প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার প্রবণতা। সেইসঙ্গে রয়েছে আল্লাহর কাছে বিচার দেওয়ার নামে বদদোয়ার সংস্কৃতিও। সর্বোপরি তা বাজে লক্ষণ। কারো জন্যই শুভবার্তা নয়।
‘আমি কোনো বিচার চাই না; শুভ বুদ্ধির উদয় হোক’—ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যার পর বছর কয়েক আগে উপরোক্ত বাক্য দু’টি বলেছিলেন তার বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। চিন্তাজগতের উচ্চতর অবস্থান থেকে এমন উচ্চমার্গের কথা বলেছিলেন বরেণ্য এই শিক্ষক-লেখক-বুদ্ধিজীবী বাবা। এখন অতি সাধারণ বাবাদেরও সেই মানেরই উক্তি। ভাষা অধ্যাপক আবুল কাশেমের মানের নয়। সাদামাটা। অর্থ একই বা আরও বেশি কিছু। মাত্র ক’দিন আগে রাজধানীর শাজাহানপুরে মেয়ে প্রীতিকে হারিয়ে বাবা জামাল উদ্দিন বলে দিলেন, ‘মামলা করলে কী হবে? এখানে কোনো বিচার নাই, আল্লাহ একজন আছেন তিনিই দেখবেন।’ সম্প্রতি সেই তালিকায় যোগ হলেন আরেক বাবা। ঢাকার নিউমার্কেটে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও দোকান কর্মচারীদের’ সংঘর্ষে হত্যাকাণ্ডের শিকার নাহিদ হাসানের বাবা নাদিম হোসেনের সোজাসাপ্টা ভাষা: কারও কাছে বিচার চাই না। বিচার চেয়ে কী হবে। কার কাছে বিচার চাইব। মামলাও করতে চাই না।’
বিচার না চাওয়ার এমন মানসিকতা কেবলই অসহিষ্ণুতার? ভরসাহীনতার? বিচার চেয়ে না পাওয়ার পর আল্লাহর কাছে বিচার দেয়ার কাজটি অনেকেই করেন। পারলে নিজে–নিজে শোধ নেন। না পারলে ওপরঅলার কাছে বিচার দেন। এখন বিচারই না চাওয়ার সংস্কৃতি! তাও আবার একেবারে ঘোষণা দিয়ে। এ কথাও সত্য। বিচারের পথটা মসৃণ নয়। বিচার চাইতে গেলে ভোগান্তি-হয়রানি কখনো একদম ছিল না, তা নয়। রয়েছে খরচাপাতির বিষয় আসয়। সময়ক্ষেপণও আছে। এর মাঝে ৯৯৯ এ ফোন করে অভিযোগ দিয়ে উল্টো পুলিশের মার খাওয়ার নজির। বাড়িতে গিয়ে ভুক্তভোগীকেই পেটানো ও উল্টো আসামী বানিয়ে চালান দেয়া।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের রোমানও বলে আসছেন, তারাও বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় নির্মমভাবে খুন হওয়া কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মাও বলেছেন, মেয়ে হত্যার বিচার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
এ ধরনের ঘটনাকে একেবারে বিচ্ছিন্ন বলার অবস্থা নেই। আবার এ ধরনের কিছু ঘটনাই সব ঘটনা নয়। এগুলোই বাংলাদেশ নয়। তাই বলে বিচারই না চাওয়া? মানে কী? দেশে কোনো বিচারই হচ্ছে না? নাহ, ঘটনা মোটেই এমন নয়। কিন্তু, কিছু ঘটনাদৃষ্টে এমন আবহ তৈরি হচ্ছে যেন দেশ অবিচারে-বিনাবিচারে ভরে গেছে। মামলাজট পড়েছে সত্য। কম-বেশি ফয়সালাও হচ্ছে। বর্তমানে দেশে বিচারাধীন মামলা ৪০ লাখ বলে একটি প্রচার বেশ প্রতিষ্ঠিত। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২ লাখ অনিষ্পন্ন মামলা যুক্ত হচ্ছে। বানরের পিচ্ছিল বাঁশে ওঠানামার অংকের মতো মামলা বা বিচারের সংখ্যা। যোগ ফলে তা কেবল বাড়ে। দায়িত্ববানদের চিন্তাজগতে গুরুত্ব না পেলে এর ফয়সালা আশা করা দুরাশারই নামান্তর। যে যা-ই বলুক সন্তানহারা বাবারা দেশের শাসন ব্যবস্থা, সরকার আর বিচার বিভাগকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। সন্তান হারানোর পর তাঁদের প্রতিক্রিয়াগুলো কি কেবল তাদেরই কথা? ‘বিচারই চাই না’ বলা কেবল আইন ও বিচার ব্যবস্থার ওপর অনাস্থা নয়। ক্রোধ, ক্ষোভ, জেদের বিষয়ও। আগামীর জন্য ভয়েরও। আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে বিচার পাওয়া যাবে না—এমন গোস্যা সংস্কৃতির মধ্যে চলে গেলে রাষ্ট্রকাঠামোর স্বীকৃতি-অস্তিত্বে আঘাত পড়ে। ভয়-শঙ্কা বেশি সেখানেই।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন