Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জীবন ছাপিয়ে যাওয়া এক দেশপ্রেমিক

রা’আদ রহমান
২৮ এপ্রিল ২০২২ ১৫:৩৩

মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাদের সদাসতর্ক বন্দীত্বের বেড়াজাল থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। মুজিব বাহিনীতে (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস, বিএলএফ) প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। এমন একসময়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে লড়ছিলেন এই কিশোর, যখন তার পিতা জনগণের অবিসংবাদী নেতা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শত্রুর দুর্ভেদ্য কারাগারে বন্দী অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, বড় ভাই আরেক ফ্রন্টে প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধে আছেন, মা-দুই বোন শত্রুর হাতে বন্দী। আপনজনদের কে কোথায় কিভাবে আছে জানার উপায় নেই তার, শুধু জানেন যেভাবেই হোক দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লং কোর্সের প্রথম ব্যাচের কমিশন্ড অফিসার। বঙ্গবন্ধুর মেজ ছেলে অকুতোভয় দেশপ্রেমিক শেখ জামাল জন্মেছিলেন ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল, ১৫ আগস্টে ঘাতকের বুলেটে থেমে যাওয়া ক্ষণস্থায়ী জীবনে রেখে যাওয়া চমৎকার সব সম্ভবনা এখনো আফসোসে পোড়ায় আমাদের।

বিজ্ঞাপন

ভাষা আন্দোলনের দুই বছর পরে পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়াতেই জন্ম নিয়েছিলেন জামাল। ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা জামাল একইসাথে ছিলেন সঙ্গীতপ্রেমী, গিটারের প্রতি আগ্রহ ছিল তার। ছিলেন বড় ভাই শেখ কামালের মতই ক্রীড়ানুরাগী। একাত্তরের ২৫শে মার্চ কালরাতে বঙ্গবন্ধু যখন গ্রেফতার হলেন, নরমাল কমনসেন্স হয়তো বলে, তখন পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে কামালের উচিত ছিল পরিবারকে পাকিস্তানীদের হাত থেকে রক্ষা করা। কিন্তু একাত্তরের বিভীষিকা পাল্টে দিয়েছিল এমন অনেক হিসেব। আরো অসংখ্য পরিবারের বড় সন্তানের মতো কামালও পরিবারকে অমোঘ নিয়তির হাতে ফেলে চলে গিয়েছিলেন বাড়ি ছেড়ে, শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন বলে। দেশকে যে শত্রুমুক্ত করতে হবে। কামাল বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বাকি সদস্যরা পাকিস্তানীদের হাতে গ্রেফতার হবার আগেই।

বিজ্ঞাপন

মে মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানী সেনাদের চোখ এড়িয়ে শেখ কামাল, তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য ইলিয়াস চৌধুরী এবং তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা শেখ শহীদুল ইসলাম গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী হয়ে মুকসুদপুর হয়ে যশোর সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যান। এরপর ভারতের বেলুনিয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিশিয়ালি প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট হিসেবে শেখ কামালের পাসিং আউট হয়। ১০৫ দিনের ট্রেনিং শেষে এসব তরুণ অফিসাররা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার মুহুর্তে কামাল সেকেন্ড লেফটেনেন্ট ওয়ালির এক ছোট ডায়েরীতে তাদের অটোগ্রাফ দিয়েছেন।

ওয়ালি ছিলেন প্রথম কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদেরই একজন। সেখানে শেখ কামালেরও একটা অটোগ্রাফ আছে। তিনি লিখেছিলেন- ‘তোমার সফলতা কামনা করছি’। শেখ কামালুদ্দিন ৯.১০.৭১ ৮, থিয়েটার রোড কোলকাতা।

ট্রেনিং শেষ করার পর সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট শেখ কামালকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্ণেল এম এ জি ওসমানীর এডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়। যুদ্ধের বাকি সময়টা তিনি সর্বক্ষণ ছিলেন প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সাথে, দায়িত্ব পালন করেছেন তার এডিসি হিসেবে। শেখ কামাল কেবল মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না, ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম কমিশন্ড প্রাপ্ত অফিসারদের একজন। দেশ স্বাধীন হবার এই মুক্তিযোদ্ধা দেশ গড়ার দায়িত্ব কাঁধে নিতে অবসর নেন সেনাবাহিনী থেকে, সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট হিসেবেই।

অন্যদিকে শেখ জামালের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ছিল আমাদের জন্য একটা বিশেষ ট্যাকটিক্যাল মুভ। তার ভাগ্য কামালের মতো ভালো ছিল না। বড় ভাই পালাতে পারলেও জামাল পালাতে পারেননি, পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে গ্রেফতার হন পাকিস্তানী সেনাদের হাতে। কামাল পালিয়ে যাওয়ায় শেখ জামাল ছিল পাকিস্তানীদের চূড়ান্ত নজরদারির মধ্যে, তারা কোনভাবেই জামালকে চোখের আড়াল হতে দিত না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রক্ত বইছে যার ধমনীতে, তাকে কিভাবে আটকে রাখবে পাকিস্তানীরা?

একাত্তরের আগস্টের একদিন সকালে মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব আবিষ্কার করলেন, তার সন্তান জামালকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্বামী এবং এক সন্তানকে আদৌ আর কখনো দেখতে পাবেন কিনা জানেন না, প্রতিদিনই পাকিস্তানী সেনারা হুমকি-ধমকি আর মানসিক অত্যাচার করছে, বেগম মুজিব এমনিতেই প্রচন্ড যন্ত্রণায়, এর মধ্যেই হঠাৎ আরেক সন্তান শেখ জামালকে খুঁজে না পেয়ে চরম আতংকিত এবং উদ্বিগ্ন ফজিলাতুন্নেন্সা মুজিব তার সন্তানকে অপহরণের অভিযোগ তুললেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।

তার এই অভিযোগ আলোড়ন তুললো সারা বিশ্বে, অনেকগুলো বিদেশী পত্রিকা নিউজ করলো, পাকিস্তানীরা গুম করেছে বন্দী শেখ মুজিবের মেজ ছেলেকে। আসল ঘটনা হচ্ছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে পালিয়েই শেখ জামাল সরাসরি চলে গিয়েছিলেন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে। তারপর ট্রেনিং শেষে যোগ দিয়েছিলেন মুজিব বাহিনীর সাথে। সেখানেই যুদ্ধের বাকি সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন জামাল। কিন্তু জামালের এই খবরটা সঙ্গত কারণেই একেবারে চেপে যায় স্বাধীন বাঙলা প্রবাসী সরকার, কারণ এই ইস্যুতে প্রবাস সরকার এবং ভারত সরকারের তীব্র চাপে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচন্ড বেকায়দায় পড়েছিল পাকিস্তান সরকার। এটি ছিল মূলত সাইকোলজিক্যাল গেইমে এক কার্যকরী অস্ত্র!বিব্রত পাকিস্তানীরা কোন উত্তরই দিতে পারছিল না।

বন্দী অবস্থায় তাদের হেফাজত থেকে শেখ মুজিবের ছেলের গায়েব হয়ে যাওয়ার খবরটা প্রচন্ড সমালোচনার মুখে ফেলেছিল পাকিস্তানীদের। এরপর ২রা ডিসেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের যে সব আলোকচিত্র ছাপা হয়েছিল, তার একটিতে সীমান্তের ১০ মাইল ভেতরে সাবমেশিনগান হাতে জামালকে যুদ্ধ করতে দেখা যায়। ভারতে পৌঁছে আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে তিনি উত্তর প্রদেশের কালশীতে মুজিব বাহিনীর ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এরপরে যুদ্ধ করেছেন ৯ নম্বর সেক্টরে, বিজয়ী হয়ে দেশে ফিরেছেন দেশ শত্রুমুক্ত হবার দুদিন পর ১৮ ডিসেম্বর। সেদিন বিকেলে শত্রুমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সম্মিলনে যোগ দেন জামাল।

একাত্তরের পরে ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রীয় সফরে আসা যুগোস্লোভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো তাকে যুগোস্লাভ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। জামালের সেনাবাহিনীতে যোগদানের বেশ আগ্রহ ছিল, তাই এই প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হয়ে জামাল চলে যান যুগোস্লাভিয়ায়, যোগ দেন যুগোস্লাভ মিলিটারি একাডেমীতে। সেখান থেকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক একাডেমি গ্রেট ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্টে সামরিক প্রশিক্ষণ(The Royal Military Academy Sandhurst, RMAS or RMA Sandhurst) গ্রহণের লক্ষ্যে লন্ডনে গিয়ে পৌঁছান। এ সময় স্যান্ডহার্স্টের কমান্ড্যান্ট ছিলেন মেজর জেনারেল রবার্ট ফোর্ড।

১৯৭৫ সালের ২৭ জুন অনুষ্ঠিত হয় স্ট্যান্ডার্ড মিলিটারি কোর্স-৮ এর প্রার্থিত সভেরেইন’স (পাসিং আউট) প্যারেড। বিদেশি ক্যাডেটদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে কমিশন লাভ করেন তিন তরুণ অফিসার। তাঁদের মধ্যে ছিলেন—অফিসার ক্যাডেট আলাউদ্দিন মো. আবদুল ওয়াদুদ (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল) ও মাসুদুল হাসান (পরবর্তী সময়ে ক্যাপ্টেন), তৃতীয় তরুণের নাম শেখ জামাল। ১৯৭৫ সালের পহেলা আগস্ট থেকে স্যান্ডহার্স্টে রেগুলার ক্যারিয়ার কোর্স শুরু হবার কথা ছিল। শেখ জামাল এই প্রশিক্ষণে অংশ নেবার দুর্দান্ত এক সুযোগ পেয়েও অংশ নিলেন না, কারণ তার মায়ের কাছে ফিরতে হবে, সতীর্থ বন্ধুরাও ফিরে যাচ্ছে বাংলাদেশে। সেদিন যদি তিনি রেগুলার ক্যারিয়ার কোর্সে অংশ নিতে থেকে যেতেন লন্ডনে, মাত্র কয়েক মাস পরের বীভৎস হত্যাকান্ডে সপরিবারে নিহত হতে হত না তাকে।

স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে ফিরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের পোস্টিং হলো ঢাকা সেনানিবাসের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেনা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরীর স্বল্প সময়ে তিনি চমৎকার পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতার ছাপ রেখেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লং কোর্স এর প্রথম ব্যাচের কমিশন্ডপ্রাপ্ত অফিসার। ১৯৭৫ সালেই বিয়ে হয়েছিল তার এবং বড় ভাই শেখ কামালের। জামালের স্ত্রী রোজী জামাল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নী, গোলাপের মত অসম্ভব সুন্দর ছিলেন দেখে বঙ্গবন্ধু নিজেই তার নাম রেখেছিলেন রোজী। বিয়ে মাত্র ২৮ দিনের মাথায় রোজী জামালকে যখন পরিবারের বাকী সদস্যদের সাথে ব্রাশফায়ারে মেরে ফেলা হচ্ছিল, তখনও রোজীর হাতে বিয়ের মেহেদীর আলপনা ফুটে ছিল। কি অপরাধ ছিল তার? কি অপরাধ ছিল দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা শেখ জামালের?

আজ ২৮ এপ্রিল জন্মদিনে শেখ কামালের জন্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। দেশের জন্য অন্তঃপ্রাণ নিবেদিত জামাল মাত্র ২১ বছর বয়সে যে দেশপ্রেমটা বুকে চেপে চলে গেছেন চিরতরে, সেই দেশপ্রেম ছড়িয়ে পড়ুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে!

লেখক: অ্যাকটিভিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

মত-দ্বিমত রা'আদ রহমান শেখ জামাল: জীবন ছাপিয়ে যাওয়া এক দেশপ্রেমিক

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর