Thursday 28 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মে দিবসের শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ
১ মে ২০২২ ১৫:১৪

এখনকার সময় পত্রিকার পাতা উল্টালেই আউটসোর্সিংয়ে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখা যায়। একটি প্রথম শ্রেণির ইংরেজি দৈনিকে একটি সরকারি বিভাগের প্রশিক্ষণ একাডেমির জন্য লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছিল, যেখানে লোক সরবরাহের ঠিকাদারের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল- ‘ঠিকাদার কর্তৃক সরবরাহকৃত ব্যক্তি কর্মকর্তার ইচ্ছানুযায়ী যে কোন সময় কাজ করতে বাধ্য থাকবে, নইলে চুক্তি বাতিল করা হবে।’
মে দিবসে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিল্স) এর কর্মক্ষেত্রে অসন্তোষ নিয়ে যে জরিপ বের হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে- কর্মক্ষেত্রে অসন্তোষের ৩৩% ঘটেছে ওভারটাইম বিল পরিশোধ না করার জন্যে। এই ওভারটাইম হচ্ছে ৮ঘন্টার অতিরিক্ত যে কাজ করা হয় তার বিল। ওই জরিপে দেখা যায়, শ্রমিক ওভারটাইম করছে কিন্তু সময়মত পাওনা পাচ্ছেনা, কিংবা একেবারেই পাচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

যে দুটি ঘটনা উল্লেখ করলাম তার একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঘটনা এবং অন্যটি আইনের আওতায় পরিচালিত বেসরকারি খাতের চিত্র। যখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে মে দিবস পালিত হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তারা রাষ্ট্রঘোষিত ছুটি ভোগ করছেন তখন দেশের অনেক কর্মক্ষেত্রেই শ্রমিকরা বাধ্য হচ্ছে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে এবং সেই কাজের মজুরি না পেয়ে আন্দোলনে নামতে।

সরকারও বেছে নিয়েছে শ্রমবঞ্চনার পথ। তাই নিজে স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ না করে ঠিকাদার দিয়ে শ্রমিক সরবরাহ করিয়ে নিচ্ছে এবং তাতে শর্ত জুড়ে যাচ্ছে- ‘কাজের কোন নির্দিষ্ট সময় থাকবেনা’।

এতো গেলো যেখানে আইন প্রয়োগযোগ্য সেখানকার কথা। আমাদের দেশে আইনী বাধ্যবাধকতার বাইরেই রয়েছে ৮০ভাগ শ্রমিক, যাদের জন্য নেই কোন নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা, নেই কোন মজুরি নির্ধারণের মানদ। নেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বালাই।

সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র বিল্স এ ইন্টার্ন হিসেবে প্রান্তিক কিছু শ্রমিকের তথ্য সংগ্রহ করেন, যার মধ্যে একটি ছিল শ্যামপুরের একটি আগরবাতি তৈরির কারখানা। যেখানে একজন নারী শ্রমিকের মাসিক মজুরী ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা। তথ্যটা দেখে আমাদেরও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল কিন্তু এটিই বাস্তবতা এবং এর তালিকা দীর্ঘ করা যাবে।

বাংলাদেশে অনেক সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা আছে যেখানে মূল কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কাজ দৈনিক ভিত্তিতে এবং অনেকের দৈনিক মজুরি ৫০ থেকে ৭০ টাকা (কিছু ব্যতিক্রম বাদে)। সরকারের যে ৪৩টি সেক্টরের নিম্নতম মজুরি নির্ধারিত আছে ভিন্নভিন্ন ভাবে, তার মধ্যে দু-তিনটি বাদে সবগুলোই সরকারি কর্মচারীদের জন্য পে-কমিশন নির্ধারিত সর্বনিম্ন মজুরির তিনভাগের একভাগ। সুতরাং সরকারের কাঠামোর মধ্যেই বৈষম্য বিদ্যমান।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ শ্রম আইন কিন্তু কৃষি শ্রমিক ও গৃহশ্রমিকসহ প্রায় ৮০ভাগ শ্রমিককে আইনের আওতার বাইরে রেখেছে। একজন গৃহশ্রমিকের মজুরী নির্ধারিত হয় প্রতিবেশী কত দেয় তার উপর। গৃহশ্রমিককে ঘুমের সময়ও সবসময় সতর্ক থাকতে হয় কখন বাড়ির সবচেয়ে ছোট সন্তানটি ডেকে পানি চায়। এমনিভাবে যে দেশের মুক্তি সংগ্রামে শ্রমজীবী মানুষের বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল, ছিল আত্মত্যাগ, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও সেই শ্রমিকশেণির নিপীড়ণের চিত্র আজ অহরহ দৃশ্যমান। এই লড়াইয়েরই ফসল যে সংবিধান, সে সংবিধানের ধারা-১৫ তে শ্রমজীবী মানুষের যে অধিকার বাস্তবায়নের উল্লেখ আছে, বর্তমান পরিস্থিতি তা লঙ্ঘনের ইঙ্গিত করে কিনা, বিশেষজ্ঞরা ভেবে দেখতে পারেন-

Article-15: It shall be a fundamental responsibility of the State to attain, through planned economic growth, a constant increase of productive forces and a steady improvement in the material and cultural standard of living of the people, with a view to securing to its citizens –
(a) the provision of the basic necessities of life, including food, clothing, shelter, education and medical care;
(b) the right to work, that is the right to guaranteed employment at a reasonable wage having regard to the quantity and quality of work;
(c) the right to reasonable rest, recreation and leisure; and
(d) the right to social security, that is to say, to public assistance in cases of undeserved want arising from unemployment, illness or disablement, or suffered by widows or orphans or in old age, or in other such cases.

গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা পর্যায়ের প্রায় ২০০০ কর্মচারী গত ১৫-১৮ বছর ধরে ২৪ ঘন্টা করে সপ্তাহে ৭ দিন কাজ করছেন। রাতে তারা নৈশ প্রহরী, সকালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং দিনে তারাই মেসেঞ্জার (চিঠি আদান-প্রদানকারী) হিসেবে কাজ করছেন। এনিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলনও করছেন তারা, সরকারের দপ্তরে দপ্তরে ধর্ণা দিয়েছেন, এমনকি ব্যাংকের সামনে অনশনও করেছেন। কোন সুরাহা হয়নি।

বাংলাদেশকে এখন বলা হয় শিক্ষিত তরুণদের দেশ। এই শিক্ষিত তরুণরা বিভিন্ন ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন শিক্ষানবীশ কর্মকর্তা, সুপারভাইজার ও জুনিয়র অফিসার হিসেবে। বিপুল সংখ্যক এই শিক্ষিত তরুণ বাংলাদেশের সব ধরনের আইনী সুরক্ষার বাইরে। এদের অনেককেই যোগদানের সময় মুল সার্টিফিকেট জমা রেখে ৫ বৎসর নিরবিচ্ছিন্ন কাজ করার বন্ড দিয়ে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের পদবি এমনভাবে ঠিক করা হয়, যার ফলে স্টাফ হওয়া সত্বেও তারা অফিসার হিসেবে শ্রম আইনের আওতার বাইরেই থাকেন।

উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকের ক্যাশিয়ারকে বলা হয় ক্যাশ অফিসার বা গার্মেন্টস এর শ্রমিককে জুনিয়র অফিসার। অন্যদিকে, শ্রম আইনের প্রত্যেকটি সংশোধনীতে শ্রমিক ও মালিকের সংজ্ঞায় এমনভাবে সংশোধনী আনা হয়, যাতে করে একজন সাধারণ কর্মচারীও অফিসার পদবীবলে শ্রম আইনের আওতার বাইরে চলে যান। এদের নেই সংগঠিত হওয়ারও কোন সুযোগ।

আউটসোর্সিং, ঠিকাদারের নিয়োগ, কৃত্রিম পদবি- সব মিলিয়ে স্থায়ী/নিয়মিত শ্রমের জগৎটাকে ক্রমশই ছোট করে নিয়ে আসা হচ্ছে। দেশের অনেক বহুজাতিক কোম্পানিতে এখন স্থায়ী শ্রমিকের চেয়ে মাস্টাররোল শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি, যাদেরকে বছরের পর বছর চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে কাজ করে যেতে হয়। টু শব্দটি করলেও মূহুর্তের মধ্যেই তাদের বিদায় করে দেয়া সম্ভব।

নির্মাণশিল্প (রিহ্যাব) এখন দেশের অন্যতম একটি শ্রমঘন খাত। কিন্তু এই খাতে একজন শ্রমিকও নেই, আছে শুধু ঠিকাদার। বিল্ডার্সসমূহ প্রতি শ্রমিক বাবদ যে অর্থ বরাদ্দ দেয়, তা থেকে ঠিকাদাররা নারী প্রতি ২০০টাকা এবং পুরুষ প্রতি ১০০টাকা করে কেটে নেয়। এমনিভাবে একজন শ্রমজীবি মানুষকে দিয়ে এখন দুইজন মুনাফা করছে- নিয়োগকারী ও সরবরাহকারী।

সাত কোটি শ্রমজীবি মানুষের জন্য নেই কোন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী। শ্রম আইনের আওতায় যারা কাজ করে তারা এক লক্ষ টাকা জীবনের দাম হাতে নিয়ে কাজে যায়। অবশ্য মন্ত্রণালয় থেকে ঠিক করা হয়েছে, এবার থেকে ক্ষতিপূরণ হবে দুই লক্ষ টাকা।

কিন্তু সেখানেও বৈষম্য। ধরুন অগ্নিকাণ্ডে যেসব গার্মেন্টস শ্রমিক নিহত হয়েছেন, মালিক তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেন এক লক্ষ টাকা করে। আর সিলেটে পাথর তুলতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই যারা নিহত হচ্ছেন, তাদের কেউ মনে রাখছে না, কারন আইন অনুযায়ী তারা শ্রমিক না।

এসব কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ও এগিয়ে যাওয়ার জন্য শ্রমজীবী মানুষের একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন। আইনসিদ্ধ হলেও প্রক্রিয়া এতটাই জটিল, সে বাধা অতিক্রম করে একদল সাধারণ শ্রমিকের পক্ষে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলা প্রায় দুঃসাধ্য। এখন দেশে শ্রম অসন্তোষ নিরসনে শ্রম অধিদপ্তরের চেয়ে শিল্প পুলিশ, এবং ক্ষেত্রবিশেষে পুরো পুলিশ বিভাগের তৎপরতা বেশি দেখা যায় যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজ, শান্তিপূর্ণ শিল্প-সম্পর্ক উন্নয়ন ও শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নের পথের পুরোপুরি পরিপন্থি।

বিশ্বায়নের কথা বলে ব্যাবসা বাণিজ্যে সরকারের দায়বদ্ধতা যতই হ্রাস করা হোক একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা, অপেক্ষাকৃত সুবিধাপ্রাপ্তদের দ্বারা অধিকাংশ মানুষ যাতে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার না হয়, এবং দেশের উন্নয়নে সবার ভূমিকার স্বীকৃতি দেয়া ও উন্নয়নের সুফলে সবার ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিৎ করার দায়িত্ব সরকারের।

রাষ্ট্রের এই ভূমিকার ব্যত্যয় হয়েছিল বলেই মে দিবসের ঘটনা ঘটেছিল। শুধুমাত্র সরকারি ছুটি ঘোষণা করে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুষ্ঠানাদি পালনের মাধ্যমে মে দিবসের প্রতি সম্মান জানানো হয় না। মে দিবসের অঙ্গীকার ও আমাদের পবিত্র সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী সকল শ্রমজীবী মানুষের জন্য শোভন কাজ তথা নির্দিষ্ট ৮ ঘন্টা কাজ, বিশ্রাম, সামাজিক নিরাপত্তা ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারসহ আইএলও শোভন কাজের মানদ- বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যা একই সাথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের অংশ।

আমাদের সরকারকে মনে রাখতে হবে, যে বাংলাদেশ আইএলও-এর সদস্য এবং আইসিইএসসিআর এর সাক্ষরদাতা দেশ, যেগুলো তৈরিই হয়েছিল মে দিবসের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য। ৮ঘন্টা কাজ, ৮ঘন্টা বিশ্রাম ও ৮ঘন্টা সামাজিক ও সাংগঠনিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত থাকার মাধ্যমে শ্রমিক শুধু তাদের শ্রম লাঘবেরই দাবি তুলেনি, মুলত পুরো মানবজাতিকে শ্রমদাসের গণ্ডি থেকে বের করে একটি সৃজনশীল ও উৎপাদনশীল মানব সমাজ গড়ার পথ দেখিয়েছে। যে পথে হেঁটে পৃথিবীর অনেক দেশ উন্নয়নের পথে বহুদুর এগিয়ে গিয়েছে। সত্যিকারের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেতে হলে আমাদেরকেও ঐ পথে হাঁটতে হবে।

আজ আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হয়েছি, এসডিজি অর্জনে নানাবিধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। মনে রাখতে হবে এসডিজির ৮নং লক্ষ্য ‘শোভন কাজ’। শ্রমিককে বঞ্চিত রেখে, দমিয়ে রেখে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবেনা। তাই যে কোনো মূল্যে শ্রমিক বঞ্চনা রোধ করতে হবে। শ্রমিককে দিতে হবে উপযুক্ত শ্রমের প্রকৃত মূল্য। আজ আমরা আরেকটি মে দিবস চাই না। মে দিবসের শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।

লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

মত-দ্বিমত মে দিবসের শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর