মে দিবস, শ্রমজীবীর যে লড়াই আজও প্রাসঙ্গিক
১ মে ২০২২ ১৫:৩০
মেহনতি মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যে তারিখটি জড়িয়ে রয়েছে, সেটি পহেলা মে। মহান মে দিবস নামে দাপ্তরিকভাবে দিনটি পরিচিত। প্রশ্ন উঠতেই পারে, মজদুরের জন্য যেখানে প্রতিদিনই সংগ্রামের- সেখানে এই বিশেষ দিনটি কেন অনন্য? এর উত্তরও রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আজ থেকে ১৩৬ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে হে মার্কেটের সামনে শ্রমিক আন্দোলনের সূত্র ধরে বিশ্বব্যাপী এই দিনে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসাবে। শ্রমজীবি মানুষের অধিকার আদায়ে এই দিন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল শতবছর আগের ওই আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য। আট ঘন্টা শ্রম দিয়ে দিনের বাকি সময় ঘুম-শারিরীক বিশ্রামসহ পারিবারিক-ব্যক্তিগত কাজের সময় চেয়ে শ্রমিকরা সেদিন আন্দোলনে নেমেছিলেন। শ্রমিকরা স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচতে চেয়েছিলেন। কল-কারখানা গিলে খাচ্ছিল শ্রমিকের গোটা জীবন। অসহনীয় পরিবেশে প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা কাজ করতে হতো। সপ্তাহজুড়ে কাজ করে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ভেঙে যাচ্ছিল। শ্রমজীবী শিশুরা হয়ে পড়েছিল কঙ্কালসার। যৌক্তিক দাবি উঠেছিল, কল-কারখানায় শ্রমিকের গোটা জীবন কিনে নেওয়া যাবে না। সুস্থ মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে গেলে দিনে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করা উচিত নয়।
দৈনিক কর্মঘন্টা আট ঘন্টা প্রতিষ্ঠার উদেশ্য নিয়েই মে দিবসের এই লড়াইয়ের সূত্রপাত। ৮ শ্রমঘন্টার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনের সময় ওই বছরের ১লা মে শ্রমিকরা ধর্মঘট আহবান করে। প্রায় তিন লাখ মেহনতি মানুষ হে মার্কেটের সামনে সেদিন ওই সমাবেশে অংশ নেয়।
শিল্পীর তুলিতে হে মার্কেটের সামনের শ্রমিক বিক্ষোভের ছবি
১৮৮৬ সালের পহেলা মে, সেদিন হে মার্কেটের সামনে আন্দোলনরত ক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের ঘিরে ছিল পুলিশ। একপর্যায়ে পুলিশের দিকে এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে পুলিশ। এতে ঘটনাস্থলেই ১০ জন শ্রমিক নিহত হন, আহত ও গ্রেফতার হন আরও অনেকে। পরবর্তীতে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে গ্রেফতার করা শ্রমিকদের মধ্য থেকে ছয়জনকে এই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে সেদিনের যৌক্তিক আন্দোলনকে মেরে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকরা তাদের দাবী থেকে কখনোই সরেননি, ভয়াল দিনটিকে কখনোই তাদের মন থেকে মুছে ফেলা যায়নি।
আঠারশ ছিয়াশির পর থেকে থেকে পহেলা মে দিনটিকে বিভিন্ন আঙ্গিকে পালন করে আসছিলেন শ্রমজীবীরা। ১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে শ্রমিকদের প্রথম আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন শ্রমিক নেতা রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালে সংগঠনটির দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এরপর ১৮৯৪ সালের মে দিবসে দাঙ্গার অরেকটি ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রিদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দিবসটি পালন উপলক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আটঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবী আদায়ে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পহেলা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজনে সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহবান জানানো হয়। একই সম্মেলনে মে মাসের ১ তারিখকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবী জানানো হয়। এরপর অনেক দেশেই এটা পর্যায়ক্রমে কার্যকরী হয়। এখন বিশ্বের প্রায় ৮৫টি দেশে পহেলা মে জাতীয় ছুটির দিন। আরও অনেক দেশেই এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়।
শিল্পীর তুলিতে হে মার্কেটের সামনের শ্রমিক বিক্ষোভের ছবি
শতবর্ষ আগের সেই দিনে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা তাদের শ্রমের নায্য অধিকার আদায় করেছিলেন। ইউরোপ, আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের নায্য অধিকার। কিন্তু অনুন্নত দেশগুলোতে আজও শ্রমিকদের যৌক্তিক এই অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। অনুন্নত দেশগুলোর কলকারখানা মালিকরা কাগজে-কলমে আট ঘণ্টা কাজের দাবি মানলেও বাস্তবে তা বিরাজ করে না। শ্রমিকদের শত বছর আগের আন্দোলন দাবির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করলেও আজও অনেক দেশ যেন হাঁটছে পেছনের দিকে। আমাদের দেশেও অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমজীবীর যৌক্তিক অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি।
আজও জীবনকে সচল রাখতে যে জীবিকার প্রয়োজন সেই জীবিকাই যেন খেয়ে ফেলে জীবনের পুরোটা। শুধু শ্রমিকরাই নন যারা তথাকথিত উচ্চ বেতনে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠাগুলোতে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রেও শ্রম আইনের অনেক নিয়মই পালন করা হয় না। মানুষকে স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে চিন্তা করার ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছে অনেক প্রতিষ্ঠানই। বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতি সাধারণ শ্রমিক তো বটেই, উঁচু বেতনের কর্পোরেট শ্রমিকের জীবন থেকেও স্বাভাবিক বিশ্রাম ও বিনোদন কেড়ে নিয়েছে। মে দিবসের ভূমিকা ও তাৎপর্য আজও অনেক শ্রমজীবীর জীবনেই সত্য বলে প্রতীয়মান হয় না। তবে পরিস্থিতির উত্তোরণের সুযোগ রয়েছে অনেক। তাই শিকাগোর হে মার্কেটের সেই আন্দোলনের সফলতার শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও মে দিবস আজও প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক মে দিবসকে সামনে রেখে শ্রমজীবীর লড়াইটাও।
লেখক: ডেপুটি এডিটর, সারাবাংলা ডট নেট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মত-দ্বিমত মে দিবস - শ্রমজীবীর যে লড়াই আজও প্রাসঙ্গিক সন্দীপন বসু সন্দীপন বসুর কলাম