Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রয়োজন সাংস্কৃতিক জাগরণের, আমরা সচেষ্ট ইসলামী জাগরণে

সুমন জাহিদ
২ মে ২০২২ ১৫:৩৭

মাহে রমজান শেষ হয়ে এলো। এক সময় রমজানকে স্বাগত জানিয়ে হোটেল, রেস্তোরাঁ বন্ধের দাবিতে দেশ ছেয়ে যেত শিবিরের পোস্টারে। পবিত্রতা রক্ষার নামে মিছিল, র‍্যালির মাধ্যমে মৌলবাদের আবাদ চলতো দেশ জুড়ে। দৃশ্যত দেশে এখন শিবির নেই, কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় জেলা প্রশাসন, পৌর প্রশাসন এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক অঙ্গ সংগঠনকে মাহে রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় স্বাগত র‍্যালি করতে দেখা যায়।

আওয়ামী লীগ ও তার যত অঙ্গ, সহযোগী সংগঠন আছে প্রত্যেকটির যত সাংগঠনিক ইউনিট রয়েছে সেগুলোতে নিয়মিত সম্মেলন, বিভিন্ন রাজনৈতিক/সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালন করা হোক বা না হোক প্রতিবছর প্রতিটি ইউনিটে ব্যাপক আয়োজনে ইফতার পার্টি করা যেন বাধ্যতামূলক। প্রতিটি ইফতার পার্টিতে প্রথাগত রাজনৈতিক সভার মতোই প্রধান অতিথি, সভাপতি সবই থাকে; একই রকম তৈলাক্ত বক্তৃতাবাজি চলে। সকল প্রকার ইফতার পার্টিতে অবধারিতভাবেই দোয়া-মোনাজাত হবে। এই দোয়া মোনাজাত পরিচালনাকারী হুজুরদের মনে হয় যে একজন আরেকজনের চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার। রাজনৈতিক নেতারা বক্তৃতার প্রারম্ভে নেতৃত্বের পদসোপান ও গুরুত্ব অনুযায়ী যেভাবে উপমার পর উপমা লাগিয়ে অযাচিত গুণকীর্তন করে, মোনাজাতে হুজুরগণ তার চেয়েও নির্ভুল ও নিখুঁতভাবে দেশপ্রেমিক নেতাদের জন্য সুর-ছন্দে বিশেষ দোয়া প্রার্থনা করে। রাজনৈতিক মোনাজাত ইতিহাসে আগেও ছিল। কিন্তু দল ও ব্যক্তিবন্দনাময় মোনাজাতের এমনতর কাস্টমাইজড ভার্সন কবে যে আমাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হলো, আমরা তা টেরই পেলাম না। আরও দৃষ্টিকটু বিষয় হচ্ছে, প্রায় সব জায়গায় ভিআইপিদের জন্য আলাদা জায়গায় স্পেশাল মেন্যুর ব্যবস্থা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

যদিও কিছু সংগঠন অসহায় মানুষদের জন্য ফ্রি ইফতারের আয়োজন করে। এবার ‘সেহারিওয়ালা’ নামে ফ্রি সেহরির আয়োজন করতে দেখা গেছে চট্টগ্রামে। ঢাকায়ও এবার দেখতে পেলাম কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ মধ্যরাতে সেহেরি বিতরণ করছেন। ধর্মপ্রাণ দেশে এমন আয়োজন মানবতার জন্য কল্যাণকর।

শঙ্কা হলো অন্য জায়গায়। আওয়ামী লীগের সিংহভাগ কর্মী এখন শিবিরের চেয়েও বেশি ধর্মান্ধ। কর্মীরা সোশাল মিডিয়ায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা যতটা না প্রচার করে তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি প্রচার করে ধর্মীয় বাণী ও নানা অপব্যাখ্যা। বেহেশতে যাওয়ার শর্টকাট পদ্ধতি জাতিকে জানানোই যেন তাদের প্রধান কাজ। নারীকে শয়তানরূপী ও বিধর্মীকে কাফের ও মুক্তমনাকে নাস্তিক/মুরতাদ প্রমাণে প্রাণান্ত চেষ্টায় থাকে কর্মীরা। অশিক্ষাপ্রসুত অপসংস্কৃতি খেয়ে ফেলছে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক সত্ত্বাকে। কর্মীরা না হয় অবুঝ, কিন্তু নেতারাও ক্রমাগত হিপোক্রেট হয়ে যাচ্ছেন।

দেশে এখন দরকার সাংস্কৃতিক জাগরণ, কিন্তু সবাই সচেষ্ট ইসলামী জাগরণে। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে, ধর্মনিরপেক্ষ আত্মমর্যাদাশীল উন্নত দেশ গড়তে চায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন অসাম্প্রদায়িক মননের নেতা-কর্মী খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। এমন কোনো আওয়ামী নেতা নেই যিনি দু’চারবার ওমরাহ করেননি এবং ওমরাকালীন ছবি ফেসবুকে প্রচার করেন না। আওয়ামী ড্রেসকোড এখন দাড়ি-টুপি-পাঞ্জাবী, উপরে মুজিব কোট। নারী কর্মীরা তেমন না মানলেও সকল নেতার স্ত্রীগণ ইতোমধ্যেই হেজাবি হয়ে গেছেন। সন্তানদের নামকরণে আধুনিকতা দেখাতে গিয়ে এমনসব জটিল আরবি শব্দ খুঁজে বের করা হয়, যা শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে এলেম থাকতে হয়। নেতা-কর্মীরা পারস্পারিক সম্বোধনে আরবি সংস্কৃতি এমনভাবে রপ্ত করেছেন, কথায় কথায় বিভিন্ন আরবি টার্ম ব্যবহার করেন কিন্তু সালাম বা খোদা হাফেজ এর আগে পরে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করতে ভীষণ দ্বিধান্বিত। ‘জাযাকাল্লাহ খাইরান’, ‘ওয়া ইয়্যাকা বা ওয়া ইয়্যাকুম’ এর মতো নিত্যনতুন জটিল আরবি টার্ম ব্যবহারে নেতাদের উৎসাহ বেশি। নিজের নামের আগে আলহাজ্ব বা হাজী লাগানোর প্রচলন তো সেই বোম্বাই হাজীর যুগ থেকেই চলে আসছে।

বিজ্ঞাপন

পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র; শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে কর্মক্ষেত্র, প্রায় সকল সিস্টেম ও প্রতিষ্ঠানে ইসলামীকরণ চলছে এবং সেটা আগের মতো নীরবে নয় সরবে, সগৌরবে। আউল-বাউল, পীর-ফকিরের যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, উগ্র ওহাবিজম তাকে গিলে ফেলছে। জঙ্গিবাদের পাগলা ঘোড়া ও নাস্তিক্যবাদের ঔদ্ধত্য বাংলাদেশকে বারবার ক্ষতবিক্ষত করেছে। জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের সাময়িক সাফল্য মৌলবাদ নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কাজে আসবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইসলামীকরণ প্রতিহত করা না যাবে। একমাত্র ভরসার জায়গা আওয়ামী লীগ, কেননা জাতিসত্তা বিনির্মাণ থেকে স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণের একক কৃতিত্ব তার। এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই যদি ইসলামীকরণে উৎসাহী হয়, সংগঠন যদি তা প্রতিরোধে উদ্যোগী না হয়ে নীরবতা পালন করে তবে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত সাপ দেশকে দংশন করবেই, ছোবলের হাত থেকে আপনি আমি কেউই রেহাই পাবো না।

আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিকে ধর্মের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ধর্মব্যবসায়ীদের নানা কিসিমে’র ফতোয়ার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর যে সহজ-সরল ও শক্ত অবস্থান ছিল, সেখান থেকে আওয়ামী লীগ ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন শুদ্ধ বাঙালি, যুগপৎভাবে একজন খাঁটি মুসলমান। বঙ্গবন্ধুর বাঙালিত্ব বা ইমানি শক্তির লিগ্যাসি বর্তমান নেতারা যুগপৎ ধারন তো দূরের কথা, ধারণেও সক্ষম বলে মনে হয় না।

গত শতাব্দীর মধ্যসময়ে মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ, সেখান থেকে আওয়ামী লীগের যে গৌরবময় ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রা, একবিংশে এসে সেই দলের উল্টো যাত্রা যেন আওয়ামী লীগকে, আওয়ামী মুসলিম লীগে পরিণত করছে। ভোটের রাজনীতিতে হেফাজতকেও তোয়াজ করতে হয় এটা বাস্তবতা, কিন্তু আওয়ামী নেতারা ধর্মপ্রাণ জনগণের কাছে নিজেকে খাঁটি মুসলমান হিসেবে প্রমাণ করতে যেভাবে ধর্মচর্চা প্রচার করে ইসলামের দৃষ্টিতে তাকে ‘রিয়া’ বলে। শরিয়তের আলোকে ‘রিয়া’ কবিরা গুনাহ ও প্রচ্ছন্ন শিরক; তরিকতের দৃষ্টিতে রিয়া হলো শিরকে আকবর (বড় শিরক)। এভাবে চলতে থাকলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ তো দূরের কথা, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মত একটি হেফাজতি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হবে দেশ, সেখানে কিন্তু মদিনা সনদও বাস্তবায়ন সম্ভব না!

কৈফিয়ত:
আমি একটি সংগঠনের সম্পাদকীয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত। সংগঠনে আমার সম্পাদকীয় বিভাগটি নতুন এবং দায়িত্বপালন আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা হলেও প্রথম যৌবন থেকেই এটি আমার প্যাশন। রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ নিয়েই আমার ধ্যান জ্ঞান। আমি মনে করি সংগঠনের যে কোনো পর্যায়ের যে কোনো পদে যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত তার অবশ্যই দায়বদ্ধতা আছে এবং সর্বক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতার উপলব্ধি থাকাটা জরুরি। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত মতামতেরও সীমাবদ্ধতা আছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মতো একটি উন্মুক্ত মাধ্যমে সংগঠনের সমালোচনা করার ঔদ্ধত্য/অধিকার আমি রাখি কি-না, এই প্রশ্নটি যে কেউ করতে পারে, কেননা তারও অধিকার আছে মতামত দেওয়ার। কিন্তু এটি সমালোচনা বললে অসম্পূর্ণ বা অসত্য বলা হবে। কেননা আমার উদ্দেশ্য একটাই—চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষতগুলো চিহ্নিতকরণ ও নিয়ন্ত্রণ—যার লক্ষ্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির উৎকর্ষতা। যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার সক্ষমতা আমার নেই, তাই প্রাথমিক প্রশিক্ষণের একটা এক্সপেরিমেন্টাল সোশ্যাল মডিউল হিসেবেই এই ধারাবাহিক লেখাটি শুরু করেছি যা যৌক্তিক বলে মনে করি।

লেখক: প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

দু’দিনে ভারতে ৯৯ টন ইলিশ রফতানি
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৪

সম্পর্কিত খবর