কোটা সংস্কার আন্দোলন, কোন পথে প্রজন্ম
১৭ এপ্রিল ২০১৮ ১৯:২০
।। এফ এম শাহীন ।।
কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে জল গড়িয়েছে বহুদূর। নানাজন নানা মতামত তুলে ধরেছেন। সামাজিক যোগাযোগ কিংবা দেশের নামকরা গণমাধ্যমও সরব ভূমিকা রাখছে এই ইস্যু নিয়ে। যৌক্তিক সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন দেশের সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ।
প্রথমদিকে এই আন্দোলনটি ছিল অহিংস। এই আন্দোলনের মধ্যে হঠাৎ যোগ হয় সহিংসতা ও তাণ্ডব। গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে আগুন দেয়া হয়। যে তাণ্ডবলীলা মিডিয়ার মাধ্যমে সকল দেশবাসী দেখেছি। বলা যেতে পারে, প্রশিক্ষিত একটি গ্রুপ এটি ঘটিয়েছে এবং ভিসিকে হত্যা চেষ্টা বললেও ভুল হবে না। ঐদিন রাতেই চারুকলায় মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনে হামলা করা হয়। এরপর আন্দোলনকারীদের পেইজ থেকে টানা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করা হয়। যেখানে আন্দোলনকারীদের একাংশ নিজেদের মেধাবী দাবী করে স্লোগান দেয় ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই!’ এরপর পুলিশের সঙ্গে বিভিন্নসময়ে ধাওয়া পালটা ধাওয়া হয়েছে আন্দোলনকারীদের। পুলিশের পিটুনিতে আহত হওয়ার মতোও ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই সারাদেশে প্রশ্ন ওঠে, কোটা বাতিল বা সংস্কারের নামে যারা রাস্তায় নেমেছে তাদের উদ্দেশ্য কি? সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা কি তবে দেশবিরোধী কোনো অপশক্তির ইন্ধনে জড়িয়ে পড়ছে! এরপর বিভিন্ন সময়ে ছড়ানো হয়েছে গুজব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে এমন গুজব রটিয়ে উস্কানি দিয়ে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছ। আরেকটি গুজব কোটা সংস্কার আন্দোলনের দ্বিতীয় দিন রাতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, ছাত্রলীগ নেত্রী এশা এক সাধারণ শিক্ষার্থীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছেন। পরে জানা যায় এই ঘটনা সর্বৈব মিথ্যা।
মোট কথা কোটা সংস্কার আন্দোলনের কয়েকদিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষত ফেসবুক পরিণত হয়েছিল গুজবের আখড়ায়। এই ধরণের গুজব কয়েক বছর আগে কুখ্যাত রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে ছড়ানোর নজির রয়েছে। সবশেষ এই কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে বিদেশে পলাতক আসামি তারেক রহমানের ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর দেশবাসী বুঝতে পারে কোটা সংস্কারে আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরের তীব্র চেষ্টা ছিল একটি মহলের।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, আন্দোলনকারীদের দাবীতে সরকারও যৌক্তিক সংস্কারের জন্য এক মাস সময় দেয়। আন্দোলনকারীরা তা মেনে নিয়ে আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করে। কিন্তু কয়েক ঘন্টা বাদে তাদেরই একটি গ্রুপ বিদ্রোহ করে দাবী করে প্রধানমন্ত্রীর তরফে একটি সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসতে হবে। এরপরই পরিস্কার হতে থাকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাত থেকে এই যৌক্তিক আন্দোলন ছিনতাই হওয়ার চিত্র। এর একদিন পর প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন সংসদে কোটা পদ্ধতি বাতিলের। ঘোষণার পর আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে বক্তব্য আসে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আইনসম্মত কিনা তারা তা পর্যালোচনা করে প্রতিক্রিয়া জানাবে। এর পরদিন সকালে আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে মিছিল করে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনের এ ক’দিনে এবং পরেও ব্যক্তিগতভাবে অনেক ‘মেধাবী’ দাবী করা আন্দোলনকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তাদের কিভাবে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সরকারি চাকরিতে কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বৈষম্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা প্রথমে বোঝানো হয়। জেনেছি কারা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যেতে ইন্ধন জুগিয়েছে। কারা মিথ্যা গুজব রটিয়ে সাধারণ ছাত্রদের উত্তেজিত করেছে। তাদের অনেকের কাছে আজ এই মুখ ও মুখোশগুলো পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে।
তবুও যারা এখনো বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি- গত ১২ এপ্রিল চ্যানেল আইয়ের টকশো তৃতীয় মাত্রায় অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও সরকারি কর্মকমিশনের ( পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. সাদত হোসাইন কোটা পদ্ধতি, এর প্রয়োগ ও কোটা সুবিধায় নিয়োগের প্রক্রিয়াটি ব্যখ্যা করেন। সেখানে তিনি বলেন, কোটা প্রয়োগ করা হয় সবরকম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মেধা তালিকার ভিত্তিতে। পরীক্ষায় কোনো কোটা সিস্টেম নেই। প্রার্থীরা প্রিলিমিনারী, লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী মেধা তালিকা প্রস্তুত করা হয়।
এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যনীয়- দুই থেকে আড়াইলাখ পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে কমবেশি পাঁচ হাজার মেধা তালিকায় স্থান পায়। তারপর সেই তালিকা থেকে ৪৪ শতাংশ মেধা কোটায় নিয়োগ দেয়া হয়। তারপর জেলা কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ও অন্যান্য কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়ে থাকে। অনেক সময় এই মেধা তালিকার একদম নীচের দিক থেকে পালি, উর্দু এমনকি অংকশিক্ষকও নিয়োগ দেয়া হয়।
ড. সাদত হোসাইন বলেন, প্রাথমিক মেধা তালিকায় আসতে সবাইকে পরীক্ষায় মেধার স্বাক্ষর রেখেই আসতে হয়। কোটা থাকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে। তবে জেলা কোটার সাথে অন্যান্য কোটার সমন্বয় একটি জটিল প্রক্রিয়া। যেমন কোন জেলায় যদি কোটা বরাদ্দ থাকে দুজন আর সেই জেলায় তিনজন প্রার্থী মেধা তালিকায় ১,২,৩ নম্বর সিরিয়ালেও থাকে তবে তৃতীয়জন চাকরী পাবেন না। কারণ তৃতীয় জনের আগেই সেই জেলা কোটা পূর্ণ হয়ে গেলে সেই জায়গায় হয়তো ২০০তম মেধাক্রমের কেউ চাকরি পেয়ে যাবেন যদি তার জেলায় কোটা খালি থাকে। মুক্তিযোদ্ধা কোটার মাধ্যমে প্রশাসনে অমেধাবীদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে তৃতীয় মাত্রা অনুষ্ঠানে এমন প্রচারণার প্রতিবাদ করেন ড. সাদত। তিনি বলেন, আড়াইলাখ পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে পাঁচ হাজার যারা উত্তীর্ণ হন তারা অত্যন্ত মেধাবী হিসেবেই মেধা তালিকায় আসেন।
এখানে উল্লেখ্য, ৩৬তম বিসিএসের প্রার্থী সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২১ হাজার ৩২৬ জন। প্রিলিমিনারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১৩ হাজার ৮৩০ জন লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন মোট ৫ হাজার ৬৩১জন। এ ফলাফলে ২ হাজার ৩২৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। ক্যাডারের বাইরে উত্তীর্ণ ৩ হাজার ৩০৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে নন-ক্যাডার হিসাবে পরবর্তীতে মেধার সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট, কোটা ব্যবস্থা থাকার পরেও সরকারি চাকরিতে কোনো অমেধাবীর নিয়োগ পাওয়া সম্ভব নয়। বিসিএস কারিগরি কোটায় অর্থাৎ শিক্ষা, চিকিৎসা, পুরোকৌশল ইত্যাদি ক্যাডারের নিয়োগে প্রচুর কোটাভিত্তিক পদ খালি থাকে বলে সেসবে সাধারণ মেধাভিত্তিক নিয়োগই দেয়া হয়। গত ২১, ২২ ও ২৫তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটার যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮, ২ দশমিক ২ ও ৫ দশমিক ২ ভাগ পূর্ণ হয়। মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ও পেশাগত ক্যাডারে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০টি এবং ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি পদ খালি ছিল। পরে এসব পদে নিয়োগ দিতে ৩২তম বিশেষ বিসিএস হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে সম্প্রতি কোটা পদ্ধতির এ বিষয়টি সংস্কার করে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করা হয়েছে। ৩৩তম বিসিএসে মেধাভিত্তিক ৭৭ শতাংশ, ৩৫তম বিসিএসে মেধাভিত্তিক ৬৭ শতাংশ ও ৩৬তম বিসিএসে মেধাভিত্তিক ৭০ শতাংশ নিয়োগ হয়েছে।
আরো একটি বিষয় লক্ষ্যনীয়, গণতান্ত্রিক দেশে যে কোনো দাবি নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলন করতেই পারেন। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের আড়ালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে হত্যাচেষ্টা কেন? এই হত্যাচেষ্টাকারা কারা? তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এছাড়া জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান, অপমান করার অধিকার কারো নেই। আর এসব দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নিয়েই কোটা সংস্কারের বিষয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে। আর এ কাজে জেনে না জেনে সহযোগিতা করছে আদর্শহীন কিছু ছাত্র। যত যা-ই হোক আদর্শহীন কাউকে আমরা নিশ্চয়ই মেধাবী বলতে পারি না।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন এই সময়ে যদি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটুক্তি করা হয় তাহলে বুঝে নিতে হবে সামনে মহাসঙ্কট অপেক্ষা করছে। যদিও চোখের সামনেই আওয়ামী লীগে স্বাধীনতাবিরোধী চেতনা ধারণকারীদের অনুপ্রবেশ দেখছি অহরহ! টাকার বিনিময়ে দলে কিংবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে রাজাকার, আল-বদর, আল সামসদের অনুসারী ও তাঁদের বংশধরদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হলে দ্রুত জামায়াত, শিবির ও রাজাকারের সন্তানদের চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। আওয়ামী লীগে ভেড়ানো বন্ধ করতে হবে। স্বাধীনতা বিরোধী যারা সরকারি চাকরিতে বহাল থেকে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত করছেন, মুক্তিযুদ্ধ, সরকার ও দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন, তাদের খুঁজে বের করে চাকরি হতে অপসারণ করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের সব অস্থাবর-স্থাবর সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালে আন্দোলনের নামে যারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেছে এবং বেসরকারি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে, স্পেশাল ট্রাইবুন্যাল গঠন করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ক্ষুন্নকারী ও মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষকারীদের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের হলোকাস্ট বা জেনোসাইড ডিনাইল ল’র আদলে আইন প্রণয়ন করে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। কোটা সংস্কারের নামে হত্যার গুজব ছড়িয়ে উস্কানি দিয়ে যারা অরাজকতা সৃষ্টি করেছে, তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে নতুনভাবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। মিথ্যা ও গুজবের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায় একটি চক্র। তাদের দ্রুত চিহ্নিত না করা গেলে এর ফল শুভপ্রদ হবে না। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা মটিতে রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের কোনো জায়গা হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র মেনে নেয়া হবে না। সকল ষড়যন্ত্র আমরা রুখে দেব ঐক্যবদ্ধভাবে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক- ‘গৌরব ৭১’
সারাবাংলা/ এসবি