আমদানি নির্ভরতা নয়, তৈলবীজের উৎপাদন বাড়ানো জরুরি
৪ মে ২০২২ ১৯:৫৮
দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৫২ লাখ টন। এর অধিকাংশই আমদানি নির্ভর। বছরে ৪৮ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়। ফলে প্রতি বছর ২৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ চলে যায় বিদেশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে গুরুত্বারোপ করেছেন। ভোজ্যতেলে আমদানি নির্ভরতা নয়, তৈলবীজের উৎপাদন বাড়ানো জরুরি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৭-১৮ সালে দেশে তৈলবীজের মোট উৎপাদন হয়েছিল ১০ দশমিক ২৬ লাখ টন, যা ওই বছরের মোট চাহিদার মাত্র ৩৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন হয়েছিল ৯ দশমিক ৭২ লাখ টন, যা ওই বছরের মোট চাহিদার মাত্র ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বাকিটা আমদানি করে বাজারে সরবরাহ করা হয়। কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য এত বেশি পরিমাণ আমদানিনির্ভর হলে তা যেকোনো সময় সংশ্লিষ্ট পণ্যের বাজারকে অস্থিতিশীল করতে পারে। এ বিষয়ে এখনই বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সময়োপযোগী নির্দেশনাটিই দিয়েছেন।
দেশে মোট তৈলবীজ উৎপাদনের সক্ষমতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় উফশী জাতের সরিষার বেশকিছু জাত আবিষ্কার হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বারি সরিষা-৯, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৬ ও বারি সরিষা-১৭ এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিনা সরিষা-৫, বিনা সরিষা-৭, বিনা সরিষা-৯ ও বিনা সরিষা-১০। এছাড়া রয়েছে রাই সরিষা ও টরি ৭। এগুলোর হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার কেজি এবং এগুলোর উৎপাদন সময়কাল গড়ে ৮০-১১০ দিন।
তৈলবীজ হিসেবে সয়াবিনের গুরুত্ব কোনোভাবেই কম নয়। দেশে উৎপাদিত সয়াবিনের জাতগুলো হলো বারি সয়াবিন-৫ ও বারি সয়াবিন-৬, সোহাগ, বিনা সয়াবিন-১, বিনা সয়াবিন-২, বিনা সয়াবিন-৩, বিনা সয়াবিন-৪, ইট সয়াবিন-১ ও বাংলাদেশ সয়াবিন ৪(জি২)।
চীনা বাদাম থেকেও তেল পাওয়া যায়। এগুলোর জাতের মধ্যে রয়েছে বারি চীনা বাদাম-৫, বারি চীনা বাদাম-৬, বারি চীনা বাদাম-৭, বারি চীনা বাদাম-৮ ও বারি চীনা বাদাম-১০। বিনা উদ্ভাবিত জাত হলো বিনা চীনা বাদাম-৬। এছাড়া রয়েছে ঢাকা-১, ডিজি-২, ডিএম-১ ও ঝিঙ্গা বাদাম। এগুলো থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদিত হয়।
সূর্যমুখী থেকে স্বল্প পরিমাণে ভোজ্যতেল উৎপাদিত হয়। দেশে কৃষক পর্যায়ে বারি সূর্যমুখী-২-এর পরিচিতি রয়েছে এবং এলাকাভেদে কৃষক সূর্যমুখীর আবাদ করেন। ইদানীংকালে ভোজ্যতেল হিসেবে সূর্যমুখী তেলের কদর বেড়েছে।
ভোজ্যতেলের একটি পরিচিত উৎস হলো তিল, যা কৃষক বংশপরম্পরায় বহু বছর ধরে আবাদ করে আসছেন। দেশে উৎপাদিত জাতের মধ্যে বারি তিল-২, বারি তিল-৩, বারি তিল-৩, বারি তিল-৪, বিনা তিল-১, বিনা তিল-২, বিনা তিল-৩, বিনা তিল-৪ উল্লেখযোগ্য। তিলের উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কেজি এবং উৎপাদন সময়কাল গড়ে ৯০-১০০ দিন।
দেশে তৈলবীজের উৎপাদন বাড়ানো গেলে আমদানি হ্রাস করা সম্ভব এবং এতে বছরে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ভোজ্যতেল আমদানির অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। দেশের সরকারপ্রধান বিষয়টি আমলে নিয়ে গুরুত্বসহকারে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ সভায় আলোচনা করেছেন এবং আমদানিনির্ভরতা কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে যথাযথ নির্দেশনা দিয়েছেন। এটি একটি সময়োপযোগী গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কৃষি অর্থনীতির একজন গবেষক হিসেবে আমি এটাকে স্বাগত জানাই। আশা করছি কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং জাতীয় কৃষি গবেষণা সংস্থার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় দেশে তিল উৎপাদনে ব্যবহূত জমি এবং উৎপাদনের পরিমাণ উভয়ই কমেছে, সরিষার ক্ষেত্রে কিছুটা বেড়েছে, চীনা বাদাম ও তিসির ক্ষেত্রে কমেছে, সয়াবিনের ক্ষেত্রে ধীরগতিতে বেড়েছে এবং নারকেল ও সানফ্লাওয়ারের ক্ষেত্রে তা কমেছে। এই যখন চিত্র তখন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্প গ্রহণ ব্যতীত তৈলবীজের দেশীয় উৎপাদন রাতারাতি খুব একটা বাড়বে—এটি খুব বাস্তবসম্মত নয়।
দেশের বেশির ভাগ মানুষ তাদের রান্নাবান্না ও দৈনন্দিন ব্যবহারে সরিষার তেল পছন্দ করে এবং দেশে এর উৎপাদনও বেশি পরিমাণে হয়। দেশের মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ু সরিষা চাষের জন্য উপযোগী। সরিষা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি যেসব জেলায় সরিষা ভালো হয়, সেগুলোয় যাতে সরিষার আবাদ বাড়ানো হয় তার ওপর জোর দিতে হবে। যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলায় আবাদি জমি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে নতুন জাত উদ্ভাবন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং এজন্য মানসম্মত গবেষণা এবং গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এও খেয়াল রাখা দরকার, গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ালে তার সুফল পেতে বেশ কয়েক বছর লাগবে কিন্তু এখনই শুরু করা না গেলে ভোজ্যতেল আমদানিতে নির্ভরতা দীর্ঘস্থায়ী হবে—এতে কোনো সন্দেহ নেই।
নারকেল উৎপাদনে জোর দেয়া যেতে পারে। তবে আমাদের দেশের মানুষ নারকেল তেল খেতে অভ্যস্ত নয় অথচ শ্রীলংকায় ভোজ্যতেল হিসেবে নারকেল তেলই বেশি ব্যবহূত হয়। বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে সেটির ব্যবহার বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
দেশে সয়াবিন উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ সবচেয়ে বেশি। সেক্ষেত্রে সয়াবিন উৎপাদনে প্রযুক্তি সুবিধা সৃষ্টি এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সয়াবিন থেকে তেল উৎপাদন করতে বিশেষায়িত শিল্প স্থাপন করা দরকার। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি বা ব্যক্তি পর্যায়ে ওই ধরনের শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
ভোজ্যতেলের আমদানির চিত্র বিশ্লেষণ করাও আবশ্যক। কারণ ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে প্রধান জোগান হয় আমদানির মাধ্যমে। আবারো গত তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ বিভিন্ন প্রকৃতির অপরিশোধিত ভোজ্যতেল মোট আমদানি করা হয়েছিল ১৯ দশমিক ৩৪ লাখ টন, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১২ দশমিক ২৪ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ সালে এ আমদানির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৭২ দশমিক ৯৫ লাখ টন, যার আর্থিক মূল্য ৩৯ দশমিক ৬১ হাজার কোটি টাকা। বছরপ্রতি আমদানি মূল্য গড়ে প্রায় ১১১ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে (তথ্যসূত্র: কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ ২০১৯-২০)।
ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ আমদানিনির্ভর খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ পর্যায়ে নিয়ে আসতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের বহুলব্যবহূত সরিষার উৎপাদন রবি মৌসুমেই হয়, যা বোরো ধানেরও উৎপাদন সময়। তবে আমাদের দেশে আমন ধান উৎপাদন হয় এমন জমিতে পরবর্তী ফসল হিসেবে সরিষা আবাদ করা হলে তা মোটেও বোরো ধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না। এক্ষেত্রে সরিষার জাত ও উৎপাদন সময়কাল অপেক্ষাকৃত কম এমন জাতের সরিষাবীজ প্রয়োজন। আউশ মৌসুমে তিলের আবাদ ভালো হয়। কৃষক ভাইয়েরা আউশ ধান, আখসহ অনেক ফসলের সঙ্গে তিল আবাদ করেন। রবি মৌসুমে মসুরের সঙ্গে তিসির আবাদ করলে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে। উন্নত জাতের তৈলবীজ উদ্ভাবনের নিমিত্ত জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে নিবিড়ভাবে গবেষণা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট গবেষকদের প্রণোদনার প্রয়োজন হলে সেটাও করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে কৃষকদের প্রযুক্তি সুবিধা, প্রশিক্ষণ ও ঋণ সুবিধা এবং ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে উৎসাহিত করতে হবে। সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে অদূরভবিষ্যতে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে।
দেশে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে এলাকাবিশেষে কোন জমিতে কী ধরনের ফসল ভালো হয়, তা জানা জরুরি। এটি জানা সম্ভব হলে ক্রপ মডেলিংয়ের মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে। পৃথিবীর বহু দেশ যেমন চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, নেদারল্যান্ডস, ভিয়েতনামসহ বহু দেশে ক্রপ মডেলিংয়ের ব্যবহার রয়েছে। সব ধরনের তৈলবীজ উৎপাদনে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে আবাদযোগ্য এলাকা বৃদ্ধি এবং উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের চাহিদা মেটাতে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, অন্যথায় তীব্র আমদানি নির্ভরতায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর দ্বারা ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ হলে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
আমদানি নির্ভরতা নয়- তৈলবীজের উৎপাদন বাড়ানো জরুরি ড. মো. সাইদুর রহমান মত-দ্বিমত