সিজারিয়ান অপারেশনে পশুডাক্তার: কসাইর হাতে ছুরি
৮ মে ২০২২ ১৬:৫৭
পশুডাক্তার হলেও আবুল কাশেম কিছু দিন ধরে নেত্রকোনার বারহাট্টায় গরু-ছাগলের পাশাপাশি মানুষের চিকিৎসাও দিচ্ছেন। কখনো ফ্রি, কখনো কম খরচে। এতে কিছু মানুষ তার নিয়মিত কাস্টমার হয়ে গেছে। বিপত্তিটা বাধে ঈদের পরদিন বুধবার। চন্দ্রপুর নিজ বাড়িতেই প্রসূতি শরীফা আক্তারের সিজারিয়ান অপারেশন করতে গিয়ে মা ও নবজাতক দুজনকেই মেরে ফেলেন। এতে স্থানীয়রা তার ওপর ক্ষেপেছে। উত্তম-মধ্যম দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করতে চায়। তার পক্ষেও দাঁড়ায় মানুষ নামের কিছু প্রাণি। ‘যা হবার হয়ে গেছে’, ‘বজ্জাত হলেও মানুষ ভালো’ –ধরনের যুক্তি দিয়ে তারা তাকে বাড়ির পেছন দিয়ে চম্পটের সুযোগ করে দেয় তারা। আপাতত ঝামেলা শেষ। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনও করেছেন এই পশু ডাক্তার। হারার পর তিনি মানুষের চিকিৎসায় ব্রত হন।
চিকিৎসার নামে ছুরি হাতে নেওয়া এ কসাইর পক্ষে সাফাই গাওয়া লোকেরা বলছে, তার হাত যশ ভালো। বড়-বড় রোগবালাইও ভালো করে ফেলেছে। প্রসূতির সিজারে যাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গেছে। নিয়মিত করলে হাত এসে যেতো। এই হচ্ছে বিচার-বিবেচনাবোধ। ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন হলেও, ঝানু-ঝানু ডাক্তারের হাতে প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুর আরো ঘটনা ঘটলেও তা আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং কিছু মানুষের বোধ-বুদ্ধির একটা নমুনা কি ইঙ্গিত করছে না?
ঈদে অবস্থায় আরেকটু ভিন্নতা। করোনার দুই বছরের ৪ ঈদে ডাক্তার-কর্মচারীদের ছুটি নেয়ার সুযোগ হয়নি। এবার এক ঈদে চার ঈদের ছুটি ভোগ বা গরহাজির থাকার প্রতিযোগিতা বসেছে। এক একটি হাসপাতালে কী দশা যাচ্ছে তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যদের উপলব্ধির বাইরে। কেবল ঈদ ও এর পরদিন দুদিনেই রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় ১৩ রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বজনদের অভিযোগ, এই দু’দিনে কোনও চিকিৎসক ওয়ার্ডে রোগী দেখতে যাননি। দেননি ব্যবস্থাপত্রও। দুয়েকবার রাউন্ড দিয়েছেন নার্স আর ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। তারা রোগীদের স্যালাইন ও কিছু মুখস্থ ওষুধ লিখে দিয়ে সরে গেছেন। অথচ হাসপাতালটিতে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, রেজিস্ট্রার, সহকারী রেজিস্ট্রার পদধারী চিকিৎসক একেবারে কম নন। গোটা দেশেও সংখ্যা গুনলে ডাক্তার অনেক। এটি একটা উদাহরণ মাত্র। দেশের অন্যান্য হাসপাতালের অবস্থা এর চেয়ে বেশি উত্তম নয়। এমন কি বেসরকারি বা নামকরা প্রাইভেট হাসপাতালেরও।
এবারের ঈদে সংখ্যায় বা ধরনে বড় রকমের সড়ক দুর্ঘটনা এখন পর্যন্ত কম হলেও হতাহতের যোগফল একেবারে কম নয়। ঈদের পূর্বাপরে ৪দিনে ছোটখাট দুর্ঘটনায় হাজারের মতো আহত ব্যক্তির ঠাঁই হয়েছে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে। কারো কারো আঘাত গুরুতর। এ আহতের বেশিরভাগই ঈদ আনন্দ করতে গিয়ে বেপরোয়া বাইক, সিএনজি বা অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার। বাস ও ট্রাকের দুর্ঘটনা কম। এমনিতে দৈনিক ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ জন রোগী ভর্তি হয় হাসপাতালটিতে। কিন্তু, এবার ঈদের দিনই ৩০০ রোগী ভর্তি হয়েছে। ঈদের আগের দিন ১৯৭জন, পরের দিন ২৩৫ জন। বেশিরভাগেরই আঘাত মাথায় এবং হাত-পায়ে। প্রাণে বাঁচাতে বেশ কয়েকজনের হাত-পা কেটে ফেলতে হয়েছে। কিছু ডাক্তার-নার্স ঈদের ছুটিতে থাকায় সেখানে রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম অবস্থা।
সরকারি স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত মোট চিকিৎসক ২৫ হাজার ৬১৫ জন। সেইসঙ্গে নার্স-কর্মচারী মিলিয়ে সরকারি হাসপাতাল কর্মীবল ৭৮ হাজার ৩০০ জন। ঈদে তারা কিভাবে চিকিৎসা দেবেন, কতোজন ছুটি নেবেন-এ সংক্রান্ত সরকারি দিকনির্দেশনাও ছিল। বলা হয়েছিল এবার ঈদ উপলক্ষে সরকারি হাসপাতালগুলোর ৫০% চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর বেশি যেন ছুটি না নেন। সব ধরনের হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। বহির্বিভাগ ঈদের ছুটির তিন দিনে একদিন খোলা থাকবে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের সেবা যথারীতি চলবে। তা কতোটা মানা হয়েছে এ প্রশ্ন থাকা উচিৎ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল ৬৫৪টি । এসব হাসপাতালে মোট বেড ৫১ হাজার ৩১৬টি। আর ৫০৫৫টি বেসরকারি হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ৯০ হাজার ৫৮৭টি। এর বাইরে উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যন্ত সরকারি-অসরকারি, এনজিও চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে। রোগীর তুলনায় বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল হলেও উপরোক্ত সংখ্যাগুলো ছোট নয়। এগুলোতে যথাযথ চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত হলে কসাইর হাতে ছুরি-চাকু যাবে না। মানুষ টোটকা চিকিৎসা বা ঝাড়ফুঁকে যাবে না। অন্তত গরু-ছাগলের ডাক্তারের কাছে মানুষের চিকিৎসার কুচিন্তা কমতে বাধ্য।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মত-দ্বিমত মোস্তফা কামাল সিজারিয়ান অপারেশনে পশুডাক্তার: কসাইর হাতে ছুরি