শেখ হাসিনা যদি দেশে না ফিরতেন?
১৬ মে ২০২২ ২৩:৪৪
১৭ মে, সাল ১৯৮১, কেমন ছিল দিনটি। সারাদিন ঝড় আর বৃষ্টি। সকাল খেকে রাত পর্যন্ত শুধু মিছিল আর মিছিল। ১৯৮১ সালের এই দিনে ছ’বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন। বিমানবন্দরের বাইরে অসংখ্য মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। অগণিত ট্রাকে-বাসে লাখো জনতা শহর থেকে এগার মাইল দূরে অবস্থিত কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান।
পুলিশ প্রথম থেকেই বিমানবন্দরের ভিতরে ও বাইরে নিয়ম-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। তারা জনতাকে অতি অল্প সময়ের জন্য বিমানবন্দরের কাছাকাছি আসা থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়। বিকেল তিনটার সময় জনতা বিমানবন্দরের সামনের পুলিশ ব্যারিকেড ভেংগে ফেলে। তিনটা বিশ মিনিটে তারা দেওয়াল টপকে ভিআইপি লাউঞ্জের সামনে বিমানবন্দরের ভেতর ঢুকে পড়ে। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা শত চেষ্টা করেও তাদের সরাতে পারেননি।
বিকেল সাড়ে তিনটার সময় বাংলাদেশ বিমানের একটি বোয়িং আকাশে দেখা যায়। এই সময় হঠাৎ করে হাজার হাজার মানুষ বাইরে থেকে ভিতরে ঢুকে একেবারে বিমানবন্দরের রানওয়ে পর্যন্ত চলে যায়। আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আহমদ ও মোহাম্মদ হানিফ জীপে করে মাইক দিয়ে তাদের রানওয়ে ও টারম্যাক থেকে সরে যাওয়ার জন্য অসংখ্যবার অনুরোধ করার পর জনতা রানওয়ে থেকে সরে যায়। কিন্তু বিকেল সাড়ে চারটায় সত্যি সত্যিই যখন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৭৩৭ বোয়িংটি আকাশে দেখা গেল, তখন সমস্ত নিয়ন্ত্রণ আর অনুরোধ-আবেদন অগ্রাহ্য করে হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরের ভিতরে ঢুকে যায়।
অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই বিমানটি ল্যান্ড করে। টারম্যাকে পৌঁছে ইঞ্জিন বন্ধ করার সাথে সাথে অগণিত মানুষ তিনদিক থেকে ছুটে গিয়ে বিমানটিকে ঘিরে ধরে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সমসাময়িক ইতিহাসে নজীরবিহীন। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মচারী ও পুলিশের নীরবে দৃশ্য অবলোকন করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। জনতা একেবারে বিমানের কাছে চলে যায়। বিমানের চারদিক ঘিরে এত লোক ছিল যে শেখ হাসিনাকে বয়ে আনার জন্য যে ট্রাকটি নেয়া হয়েছিল তা বিমানের কাছাকাছি নেয়াই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বহু চেষ্টার পর জনতার স্রোতকে কিছুটা সরিয়ে ট্রাকটি বিমানের ককপিটের দরজার একেবারে সামনে নেয়া হয়। দরজা খোলার সাথে সাথে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক মালা হাতে ট্রাক থেকে লাফিয়ে বিমানের ভিতরে গিয়ে দলীয় সভানেত্রীকে মাল্যভূষিত করেন। এই সময় শেখ হাসিনা ভিতর থেকে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। এরপর ট্রাক থেকে বিমানের দরজার সাথে একটি ছোট কাঠের সিঁড়ি পর্যন্ত লাগানো হয়। অস্বাভাবিক ভীড়ের জন্য বিমানে সিঁড়ি পর্যন্ত লাগানো সম্ভব হয়নি। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে বিমানের ভেতর থেকে দলীয় প্রেসিডিয়ামের সদস্য আবদুস সামাদ আজাদ ও পরে কোরবান আলী ট্রাকে নেমে আসেন। প্রেসিডিয়ামের এই দু’জন সদস্য নয়াদিল্লী থেকে দলীয় সভানেত্রীর সাথে ছিলেন।
চারটা বত্রিশ মিনিটে শেখ হাসিনা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে বিমান থেকে ট্রাকে নেমে আসেন। এই সময় লাখো জনতার কণ্ঠে ছিল গগনবিদারী শ্লোগান, “শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব,” “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু”, “শেখ হাসিনা, স্বাগত শুভেচ্ছা।”
অনেকের চোখেই ছিল অশ্রুধারা। বিমান থেকে নামার আগে আবদুর রাজ্জাক যখন হাসিনার গলায় মালা দেন, তখন তিনি কাঁদছিলেন। কলকাতা বিমানবন্দরে এবং ঢাকা আসার পথে পাঁচ-ছ’বার হাসিনা অঝোরে কেঁদেছেন।
বিমান থেকে ভিআইপি লাউঞ্জ পর্যন্ত হাসিনাকে নিয়ে আসতে ট্রাকটির পনের মিনিট সময় লাগে। সামনে-পিছনে বিপুল জনতা। তার পরনে ছিল সাদা রঙের উপর কালো প্রিন্টের মোটা শাড়ী। মাথায় ঘোমটা দিয়ে ঢাকা হাসিনা হাত নেড়ে দু’পাশের জনতাকে অভিনন্দন জানান। বিমান থেকে নামার সময় থেকেই তাকে অত্যন্ত বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। ট্রাকে তার ডান দিকে ছিলেন ফুফাত ভাই শেখ সেলিম এবং বামদিকে আইভি রহমান ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
বিকেল চারটার দিকে আকাশে কালো মেঘ ছিল। পৌঁনে পাঁচটায় শেখ হাসিনকে নিয়ে মিছিল শুরু হওয়ার পরপরই চারদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি শুরু হয়। মুষলধারে বৃষ্টি ঝরে একটানা রাত আটটা পর্যন্ত। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেই সাথে তীব্র ঝড়। প্রকৃতির ভয়াল রুদ্রমূর্তি। এরই মাঝে ট্রাকে ও রাস্তার দু’পাশের জনতার কণ্ঠে গগনবিদারী শ্লোগান, “মাগো তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব।”
বর্ষণসিক্ত হাসিনা ঝড়ের মধ্যেও দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে নেড়ে যাচ্ছিলেন বনানী হয়ে শেরেবাংলা নগর। বনানীতে শেখ হাসিনা মায়ের ও নিহত পরিজনের কবর জিয়ারত করেন। কবরস্থানে তিনি আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েন, “মা, আমাকে কেন রাখিয়া গেলে?”
কুর্মিটোলা থেকে শেরেবাংলানগর পর্যন্ত আট মাইল রাস্তা পার হতে সময় লাগার কথা বেশী হলে ৩০ মিনিট। প্রায় তিন ঘন্টায় শেখ হাসিনা শেরেবাংলা নগরে পৌঁছালেন। ঝড়-বৃষ্টিতে নগরজীবন তখন প্রায় বিপন্ন, রাস্তাঘাটে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে শেরেবাংলা নগরে অপেক্ষায় থাকেন লাখ কয়েক লোক। হাসিনাকে তারা দেখবেনই। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তিনি গণসংবর্ধনা সভার মঞ্চে এলেন।
মানিক মিয়া এভিনিউতে আয়োজিত গণসংবর্ধনায় ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী বাস্তবায়ন ও শোষনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমি জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু পাবার নেই। সব হারিয়ে আমি এসেছি আপনাদের পাশে থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য।
নেত্রী বলেন, আমি বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ পরবর্তীকালের বিভিন্ন হত্যাকান্ডের বিচার চাই। বিচার চাই বাংলা জনগণের কাছে, আপনাদের কাছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিচার করবে না। ওদের কাছে বিচার চাইবো না। আপনারা আমার সাথে ওয়াদা করুন, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করবো।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে “সিস্টেম” (পদ্ধতি) চালু করতে চেয়েছিলেন, তা যদি বাস্তবায়িত হতো তাহলে বাংলার মানুষের দুঃখ আর থাকতো না। সত্যিকার অর্থেই বাংলা সোনার বাংলায় পরিণত হতো।
শেরেবাংলা নগরে অনুষ্ঠিত লাখো জনতার গণসংবর্ধনাটি ছিল আনন্দঘন ও হৃদয়বিদারক। দলীয় নেত্রীর আগমনে নেতা ও কর্মীদের মধ্যে ছিল আনন্দ, উল্লাস আর উচ্ছ্বাস। অন্যদিকে আপনজনহারা নেত্রীর দুঃখ আর বেদনার কথা আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের মধ্যে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি করে।
বক্তৃতাকালে শেখ হাসিনা বার কয়েক কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরো অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোন দিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।”
শেখ হাসিনা আরও বলেন, “বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসি নি। আপনাদের বোন হিসাবে, মেয়ে হিসাবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসাবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।”
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে নিহত হন, তখন তার জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু জামাতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ও বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহেনা তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। বিদেশে ছিলেন বলেই তারা রক্ষা পেয়েছিলেন। ‘হাসিনা : এ ডটারস টেল’ ডকুফিল্মটা যারা দেখেছেন তারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ আন্তরিক সহযোগিতায় তারা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন। সে সময়কার ইতিহাস অনেক অনেক নির্মম, অনেক অনেক কষ্টের। যে রাতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল ঠিক সে সময়টাতে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাসহ বঙ্গবন্ধুর জামাতা বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় রাতের খাবারের আমন্ত্রণে গিয়েছিলেন। সে ইতিহাসও ভীষণ নিষ্ঠুর ও হৃদয়বিদারক। তৎকালীন জার্মান রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ও তার সহধর্মিনীর আন্তরিক সহযোগিতা না পেলে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো।
১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে অবস্থানকালে শেখ হাসিনা ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে সভানেত্রী নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পর এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি শীঘ্রই দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারের জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তুলবেন। বাঙ্গালি জাতির মুক্তির জন্যে বঙ্গবন্ধু জীবন দিয়েছেন; বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করাই তার মূল লক্ষ্য।
ওরকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দেশে ফেরা তার পক্ষে নিরাপদ হবে কি না জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। আমি হয়তো একটু ঝুঁকি নিচ্ছি। কিন্তু আমার বাবা যে আদর্শের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন তা বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই ঝুঁকি নিতেই হবে।’
বাংলাদেশ সরকার তার প্রত্যাবর্তন কী চোখে দেখবে জিজ্ঞেস করা হলে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেছিলেন , “তা আমি কী করে জানব? দেশে এখন সামরিক শাসন রয়েছে। যে কোনো কিছু ঘটতে পারে।”
আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমে শেখ হাসিনা খুবই দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, “আদর্শের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো দৈন্য নেই। কারণ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছে তা-ই আমাদের দিকনিদের্শক। সেই পথ ধরেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ-বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কর্মকান্ডকে সফল করে তুলব।”
দীর্ঘ ৪০ বছরের শেখ হাসিনার ক্রমাগত সংগ্রাম ও ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে পেয়েছি এক আত্মপ্রত্যয়ী, সমৃদ্ধির বাংলাদেশ।
২.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের একটা লেখা এই পরিসরে সংযুক্ত করছি।
“১৯৬৮ সালে শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রথম বর্ষ বিএ (অনার্স) শ্রেণিতে ভর্তি হন। তখন আমি তাকে ছাত্রী হিসেবে পেয়েছিলাম। আমাদের ব্যবস্থায় শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রী বেছে নেন, ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষক বেছে নিতে পারে না। এখন অনেক বিকল্প পঠন পাঠনের ব্যবস্থা থাকায় কোনো কোনো শিক্ষককে এড়িয়ে যাওয়া যায়। তখন এমন সুযোগ ছিল না। সুতরাং আমি যে হাসিনার শিক্ষক বনে গেলাম, সে দোষ তার নয়, দোষ তার ভাগ্যের। সেটা ছিল এক ঝোড়ো সময়। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের দশ বছরপূর্তি উপলক্ষে সরকারিভাবে নানা তোড়জোড় চলছে চারিদিকে। এদিকে তার অপশাসনের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ ফুঁসছে। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাঙালির মুক্তিসনদ’ বলে আখ্যায়িত ছয় দফা দাবিনামা উত্থাপন করেন। তার প্রতি মানুষের সাড়া ক্রমাগত বাড়ছে। ১৯৬৮ সালে সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। অল্পকাল পরেই তাঁকে প্রধান আসামি করে রুজু করা হয় দেশদ্রোহমূলক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। পূর্ব বাংলায় শুরু হয় অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান। সেই চাপে শেখ মুজিব মুক্ত হন, জনগণ তাঁকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করে; আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহৃত হয়, আইয়ুব খানকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়। তখন ক্লাস শেষে শেখ হাসিনার সাথে কথা হতো তাদের পারিবারিক অবস্থা নিয়ে, শেখ মুজিবের কুশল সম্পর্কে এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে। আশা-নিরাশার দোলায় অনেকদিন কাটার পর আমরা আনন্দের সন্ধান পাই। তারপরই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে যাই। শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা আপাতত স্থগিত রাখে। তার সঙ্গে আবার যখন সাক্ষাৎ হয়, ততদিনে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেছে, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, তার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি ঘটে গেছে। দীর্ঘকাল প্রবাসজীবন যাপনের পর সে স্বদেশে ফিরে এসেছে। চট্টগ্রামে গিয়েছিল দলীয় কর্মসূচিতে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে আমার সাথে সাক্ষাৎ করে গেছে। আমি গভীরভাবে আপ্লুত হয়েছি। তারপর সে যাই করেছে, তা হয়ে গেছে ইতিহাসের অঙ্গ। স্বৈরাচারী আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা, বিরোধী দলীয় নেত্রীর দায়িত্ব পালন করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সফল আন্দোলন করা, প্রধানমন্ত্রী হওয়া। তার ওপরে আবার বিরোধী দলের নেত্রী, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এবং আবার প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হওয়া। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে শেখ হাসিনার তিনটি সাফল্যের কথা বলতে পারা যায়: খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, গঙ্গার পানিচুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা। এবারে প্রধানমন্ত্রীর আসনে স্থির হয়ে বসতে না বসতেই বিডিআরের ঘটনা। এই দুঃখজনক অধ্যায়টিও সে বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছে। দেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশা তার কাছে। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রে গণতন্ত্র পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করবে, এই আশা মানুষের। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সমাধা হবে তার উদযোগ। এর কোনটাই যে সহজ কাজ নয়, তা জানি। তবু সেই কঠিন কাজটিই তার জন্যে অপেক্ষা করছে। তাকে তা করতে হবে। এই কঠিন কাজে সে সফল হোক, এই কামনা, এই শুভেচ্ছা রইল।”
৩.
শেখ হাসিনা দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ আত্মমর্যাদাশীল জাতি। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোর একটি। ২০৩০ সাল নাগাদ আমরা হয়ে যাব ২৪তম অর্থনীতির দেশ। তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বলেই বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ, খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশ স্যাটেলাইট উৎক্ষেণকারী দেশ, নিজ দেশের অর্থে পদ্মাসেতু নির্মাণ করতে পারে, পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পথে অগ্রসর হতে পারে। সৌদি আরবকে এখন আমরা বলতে পারি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসুন।
কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার লাইন দু’খানি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। করোনার অভিঘাতে সারা বিশ্বের অর্থনীতি ভয়ংকর সংকটের মধ্যে পড়তে চাছে তখন ‘দ্য ইকোনোমিস্ট’ বলছে বাংলাদেশর অর্থনীতি চীন, ভারতের চেয়ে বেশী সামলে নিতে পারবে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেই সারা বিশ্বে বাংলাদেশ মানবিক বাংলাদেশ বলেই পরিচিত। শেখ হাসিনাই বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা আদায় করার সব ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন।
শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন বলেই বাংলাদেশ নিজের টাকায় জাতীয় বাজেট করতে পেরেছে। জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়ার অর্থমন্ত্রী বাজেটের আগে প্যারিস কনসোর্টিয়াম বৈঠকে ভিক্ষার আবেদন করতেন। আজ বাংলাদেশ নিজের অর্থে বাজেট তৈরী করতে পারে। শেখ হাসিনাকে ‘মানবিক বিশ্বের প্রধান নেতা’ বলেছে ‘অক্সফোর্ড নেটওয়ার্ক অব পিস’ নামক একটি সংস্থা। শ্রীলঙ্কার গার্ডিয়ান পত্রিকা তুলনা করে ‘জোয়ান অব আর্ক’-এর সঙ্গে।
কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার লাইন, ‘শেখ হাসিনা, ‘আপনার বেদনা আমি জানি, আপনার প্রত্যাবর্তন আজও শেষ হয়নি’। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল, বিশ্বের বিস্ময়। মাননীয় মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের কবিতা দিয়ে এই লেখা শেষ করতে চাই।
“বেদনার তরী বেয়ে একদিন
ছুঁয়েছিলে স্বদেশের মাটি,
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে পিতার ভালোবাসা
মানুষের কাছে নিলে টানি।
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্র সময়
কেটে গেছে বহু কাল,
তারপর তারপর স্নেহময়ী নদী হয়ে
নির্ভীক দাঁড়িয়েছ মানুষের পাশে।
চারিদিকে নাগিনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাস
পিতার পতাকা হাতে তবু অবিচল,
খরস্রোতা নদী হয়ে অবিরাম বয়ে চলা
মানুষের মুক্তিটা গড়ে দেবে বলে।
বেদনার তরী বেয়ে একদিন
ছুঁয়েছিলে স্বদেশের মাটি।
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে পিতার ভালোবাসা
মানুষের কাছে নিলে টানি॥”
লেখক: সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই