ইতিহাস পুনঃনির্মাণের একটি দিন
১৬ মে ২০২২ ২৩:২৫
বাঙালির নিহত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা প্রায় ছয় বছর প্রবাসে শরণার্থীর মতো জীবন কাটিয়ে এক ঝড়ো সন্ধ্যায় দিল্লী হতে ঢাকার বিমান বন্দরে অবতরণ করেছিলেন। সেদিনটি ছিল ১৯৮১ সালের ১৭ মে। আজ থেকে ঠিক ৪১ বছর আগে। তার পিতা শেখ মুজিব নিজের জীবনের বেশিরভাগ সময় পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন অনেকবার। বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্ম দিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর সেই দেশে ফিরতে তারই কন্যাকে ছয় বছর শরণার্থী জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে।
শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর জন্য জিয়াউর রহমান সরকারের উদ্যোগে ‘শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠন’ করা হয়েছিল যার আহ্বায়ক ছিলেন জিয়ার সংসদের স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ। এর আগে শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন জানতে পেরে জিয়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (তখন রবিবার) ৩ মে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেন, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না । বৈঠক শেষে জিয়ার প্রধানমন্ত্রী রাজাকার শাহ আজিজ সাংবাদিকদের বলেন ‘শেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে আমরা দেশে বিশৃঙ্খলার আশংকা করছি।’ পরদিন ৪ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন ‘জননিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না।’ এই মোস্তাফিজুর রহমান, যিনি এক সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, তিনি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে আইও (Interrogation Officer) ছিলেন । তার মূল দায়িত্ব ছিল অভিযুক্তদের কাছ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে জোরপূর্বক নানাভাবে স্বীকারোক্তি আদায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা জানিয়ে দেন তাকে যদি হত্যার চেষ্টাও করা হয়, তা হলেও তিনি দেশে ফিরবেন এবং কথা রেখেই ১৭ মে ১৯৮১ সালে ফিরেছিলেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় তখন শুধু একজন ব্যক্তি বা তার পরিবারকে হত্যা করা হয়েছিল তা নয়। খুনীদের উদেশ্য ছিল বাংলা নামের দেশটি যে উদেশ্য নিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সেই দেশটিকে হত্যা করে আবার একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তর করা। আর যারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল তারা ১৯৭৫ সাল হতে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই কাজটিই করে গেছে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি সায়েমের হাত ঘুরে যখন নাটের গুরু জিয়া সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেন তখন বাংলাদেশ এক অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছে। প্রথমে জিয়া যে সকল রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেছিল তাদের রাজনৈতিক জীবন শুরু করার অনুমতি দিয়েছিল তার নিজ প্রয়োজনে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু এই সব ধর্মাশ্রয়ী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়া তাদের রাজনীতিতে ফিরে আসাকে জায়েজ করার জন্য এক সামরিক ফরমান বলে সংবিধানের ওই ধারা বাতিল করেন।
জামায়াত, মুসলীম লীগ, নেজামে ইসলামীর আবার পূনঃজন্ম হয়। জামায়াতের আমির একাত্তরের খুনিদের প্রধান গোলাম আযমকে বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুমতি দেন জিয়া। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ জি তোয়াবকে পশ্চিম জার্মানি হতে ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেন। তোয়াবকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ঘাতক শরিফুল হক ডালিমের।
জিয়ার শাসনামল শুরু হয়েছিল রাত্রিকালিন কারফিউ জারির মাধ্যমে দেশশাসনের বিচিত্র ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত নার্ভাস কিন্তু নিষ্ঠুর রাষ্ট্রপ্রধান। কোন ব্যক্তিকে তিনি তার শাসনের প্রতি হুমকি মনে করলে তিনি তাকে নানা অজুহাতে ফাঁসিতে ঝুলাতেন। তার আমলে উনিশটি অভ্যূত্থানের চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সব অভ্যূত্থানের সাথে যারাই জড়িত ছিলেন বলে তিনি সন্দেহ করেছেন তিনি তাদের বিনা বিচারে নিজ ক্ষমতা বলে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। এরা সকলে ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য। এই ধরণের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা দুই হাজারের উপর। সামরিক ফরমান বলে নিষেধ করা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া (৪ আগস্ট ১৯৭৬ ‘ব্যক্তিপূজা বা ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম প্রচার নিষিদ্ধ থাকিবে’)। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দেয়া অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। জিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইতে। তিনি ক্ষমতা দখল করলে বাংলাদেশে এই কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা বেশ সক্রিয় হয়ে উঠে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে মদদ দিতে।
জিয়া আওয়ামী লীগের ধর্ম নিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে ইসলামকে দাঁড় করিয়ে দেন। ঢাকা শহর পবিত্র কোরানের আয়াত লেখা বিলবোর্ডে ছেয়ে যায়। ভারতের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই বাংলাদেশ সফরে এলে রাতারাতি সেই সব বিলবোর্ড গায়েব হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ সরকারি পৃষ্টপোষকতায় সোহরোওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় ‘সিরাতুন্নবি সম্মেলন’। এই সম্মেলনে জমায়াত করা হয় সকল স্বাধীনতা বিরোধীদের। সেই সম্মেলনে যুদ্ধাপরাধী দেলওয়ার হোসেন সাঈদি দাবি করেন বাংলাদেশের নাম যেন ইসলামিক রিপাবলিক করা হয় । মাঠে আওয়াজ উঠে ‘তোয়াব ভাই, তোয়াব ভাই চাঁদ তারা মার্কা পতাকা চাই’। জিয়ার শাসনামলেই নির্বাচন জিনিসটিকে তিনি এক তামাশায় পরিণত করেছিলেন। নিজে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একক প্রার্থী হয়ে তার এককালীন বস জেনারেল আইয়ূব খানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ ভোটের আয়োজন করে নিজের জন্যই একশত ভাগ ‘হ্যাঁ’ ভোটের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই জিয়ার সাগরেদরাই এখন আবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি তুলে গলা ফাটান । জিয়ার আমলে শুরু হয় রাষ্ট্রায়ত্ব কলকারখানা নিজ দলের প্রতি অনুগত নেতাদের মাঝে পানির দরে বিক্রি করার যাত্রা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কালো টাকা সাদা করার সংস্কৃতি চালু করেছিলেন জিয়া এই বলে যে এই টাকা এই সব কলকারখানায় বিনিয়োগ করা হবে। হলো ঠিক উল্টো। সব টাকাই দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেল। যারা পানির দামে এইসব কল-কারখানা কিনেছিল তারাও তা অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেশত্যাগ করলো।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারা অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তি ক্ষমতা দখলকারি তারই ঘনিষ্ট সহকর্মী খোন্দকার মোশতাক ক্ষমতা দখল করেছিলেন । ৩ নভেম্বরের ঘটনার পর জিয়া সরাসরি ক্ষমতায় চলে আসে। মাঝখানে সাক্ষি গোপাল রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি, যার নিয়োগ বঙ্গবন্ধুর হাত দিয়ে, আবু সাদাত মোহাম্মাদ সায়েম । কিছু দিনের মধ্যেই জিয়া তাকে অত্যন্ত অপমানজনকভাবে বিদায় করে রাষ্ট্রপতির পদটি নিজে দখল করেছিলেন।
৩০ মে ১৯৮১ সালে এক সামরিক অভ্যূত্থানে জিয়ার মৃত্যু হলে ক্ষমতা দখল করেন আর এক সেনাশাসক হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। মাঝখানে কিছুদিন জিয়ার উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদ জিয়া হতে আর এক ধাপ এগিয়ে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। এর ফলে দেশের বাকি সকল ধর্মাবলম্বিরা সংখ্যালঘু নাগরিকে পরিণত হয়। এরশাদের আমলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের অন্যতম নেতা খন্দকার আবদুর রশিদের নেতৃত্বে সব ঘাতক মিলে গঠন করে ‘বাংলাদেশ ফ্রিডম পার্টি’। এই ঘাতকদের অন্যতম ফারুক রহমান (বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার দায়ে বিচারে ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছে) ১৯৮৬ সালে এরশাদের বিরুদ্ধে ফ্রিডম পার্টির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। এরশাদও জিয়ার পথে হেঁটেছেন। এরশাদের শুধু ক্ষমতা আর অর্থলোভই ছিল না তিনি একজন নারীলোভী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। জিয়ার সাথে যে সকল দুর্বৃত্তরা যোগ দিয়েছিল তাদের অনেকেই এরশাদের আশ্রয়ে চলে আসেন। এই দুই সামরিক শাসকের আমলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের নবযাত্রা শুরু হয়। দেশের ভবিষ্যৎ হয়ে উঠে অন্ধকারাচ্ছন্ন।
জিয়া এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রকৃত অর্থেই কোণঠাসা হয়ে উঠলেও দলের নিবেদিত নেতা-কর্মীরা কখনো দলের প্রতি আনুগত্য বিসর্জন দেননি। বঙ্গবন্ধুর আমলে যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন তারা কেউই ব্যক্তি স্বার্থে রাজনীতি করেননি। ১৯৭৫ সালে জেলের ভেতর চার জাতীয় নেতার মৃত্যু তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। তারা যদি ঘাতকদের কাছে আত্মসমর্পন করতেন তাহলে তাদের জীবন বাঁচতো। দল যখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেগম জোহরা তাজউদ্দিন, আব্দুল মালেক উকিল, জিল্লুর রহমান, সাজেদা চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী প্রমূখরা দলের হাল ধরে রাখেন। বঙ্গবন্ধু অনেক পণ্ডিতজনকে স্বাধীনতার পর তার সাথে দেশ গড়ার কাজে রেখেছিলেন। তাদের পরামর্শ নিয়েছিলেন। দেখা গেল তার মৃত্যুর পর তাদের অনেকেই দেশান্তরি হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ছায়া তলে যে ড. কামাল হোসেন রাজনৈতিক জীবন শুরু (ও শেষ) করেছিলেন সেই ড. কামাল হোসেন তো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। এই সময় দলের ভেতর এক ধরণের নেতৃত্বের টানাপোড়েন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা তখন সপরিবারে দিল্লীতে শরণার্থী জীবনযাপন করছেন।
১৯৮১ সালের ১৩ হতে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। এরই মধ্যে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় আওয়ামী লীগকে যদি টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে তার হাল ধরতে হবে বঙ্গবন্ধুর একজন উত্তরাধিকারীকে। সকলের সামনে দিল্লীতে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ্য কন্যা শেখ হাসিনা ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না। তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আছে। পিতার রাজনৈতিক জীবন খুব কাছ হতে দেখেছেন। দেখেছেন দেশের মানুষের জন্য তার ত্যাগ আর মমত্ব। হাসিমুখে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতেও দেখেছেন। সকলের মতৈক্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা গিয়ে দিল্লী হতে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে দলের সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরিয়ে আনলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করেন আক্ষরিক অর্থে হয়তো তারা এই দিনটির জন্য ছয় বছর অপেক্ষা করেছেন কিন্তু অনেকের জন্য তা ছিল ষাট বছরের সমান। তারা দেখেছেন কী ভাবে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তবিধৌত স্বাধীন বাংলাদেশ দুই সেনা শাসকের খপ্পরে পরে একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত হয়েছে। যে মানুষটি আজীবন বাংলা ও বাঙালির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার সৃষ্ট দেশেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। তারা দেখেছেন একাত্তরের পরাজিত শত্রু আর পঁচাত্তরের ঘাতকদের উল্লাস নৃত্য। সেই বিকেলে ঢাকা বিমান বন্দর আর সড়কের দুপাশে কত মানুষ সমবেত হয়েছিলেন তার কোন পরিসংখ্যান কখনও পাওয়া যাবে না। এমন একটি জনসমাগম মানুষ দেখেছে ১৯৭২ সালের ১০ জনুয়ারি যখন পিতা মুজিব পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরেছিলেন। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে জিয়ার নির্দেশে যে কমিটি করা হয়েছিল সেই কমিটি ভীত হয়ে তাদের কর্মসূচি স্থগিত করেছিল। জিয়া তার পূর্বের অবস্থান হতে ফিরে এসেছিলেন। তিনি জনগণের শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। বুঝেছিলেন আওয়ামী লীগ সকল ভেদাভেদ ভুলে এক হতে পারলে দলটি হয়ে উঠতে পারে অদম্য। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে বিদেশ যাওয়ার সময় যে শেখ হাসিনার সবকিছুই ছিল তিনি ফিরলেন অনেকটা এক শূন্য ঘরে। কিন্তু বাংলার মানুষ সেদিন তাকে ভালবাসা আর আবেগে সিক্ত করেছিল।
দেশে ফিরেই শেখ হাসিনা ঢুকতে চাইলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে, যে বাড়ি তার স্মৃতি বিজড়িত, যেখানে ঘাতকরা খুন করেছে তার বাবা মা আর পরিবারের সকল স্বজনদের। জিয়া সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছেন আগেই। সামনের রাস্তায় বসেই বাবা মা আর পরিবারের অন্যান্যদের জন্য দোয়া আর মিলাদ পড়েছেন শেখ হাসিনা। আশ্রয় পেলেন ফুফুর বাসায়। আওয়ামী লীগের মতো এক বিশাল একটি দলের ক্রান্তিকালে তার নেতৃত্ব গ্রহণ একটি দুঃসাহসী কাজ। তবে হাজার হলেও তো বঙ্গবন্ধুর কন্যা। পিতার কাছ হতে যে কটি গুণ পেয়েছেন তার মধ্যে একটি সাহস আর অন্যটি দৃঢতা। তিনি এও জানতেন তাকে দলের সভাপতি করা হয়েছে ঠিক কিন্তু কেউ কেউ চিন্তা করেছেন তিনি হবেন একটা সাক্ষি গোপাল সভাপতি আর তার দলের নেতৃত্ব থাকবে তাদের হাতে। তারা শেখ হাসিনাকে চিনতে ভুল করেছিলেন। সেই ভুল এখনও কেউ কেউ করে থাকেন।
যে সর্বহারা শেখ হাসিনা ৪১ বছর আগে এক ঝড়ো আবহাওয়ার মধ্যে দেশে ফিরেছিলেন তিনি এখন বাংলাদেশের টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। সর্বমোট চারবার। একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশকে তিনি আলোতে নিয়ে গেছেন। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচার করেছেন। ২০০৯ এ এসে ঘাতকদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন। অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া একটি দেশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির মহাসড়কে তুলেছেন। তার নেতৃত্বে দেশ এখন একটি মধ্যম আয়ের দেশ। সব ঠিক থাকলে ১৯৪১ সাল নাগাদ হতে পারে উন্নত অর্থনীতির দেশ। যখন দেশে ফিরেন তখনও বাংলাদেশ একটি রিলিফ নির্ভর দেশ। খাদ্য ঘাটতি মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়। দেশের ষাট ভাগ মানুষ নিরক্ষর। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি দূর্ভিক্ষপীড়িত সমস্যাসংঙ্কুল দেশ হিসেবে পরিচিত। এখানে রাষ্ট্রপতিকে খুন করলে খুনিদের বিচার বন্ধ করতে সংবিধান সংশোধন করা হয়। সেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বে পাঁচটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের একটি। দেশের মানুষকে দুবেলা খেতে পায়। ৭২ শতাংশ এখন অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। রিলিফ শব্দটি বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা। কোভিড মহামারি ব্যবস্থাপনায় তিনি বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এক সময়ের সর্বহারা শেখ হাসিনা বর্তমানে শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি এখন একজন বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনায়ক। মাঝে মাঝে তিনি বলেন, বয়স হয়েছে অবসরে যাবেন। আমরা বলি কোথায় যাবেন? আপনার বিকল্পতো দেখা যাচ্ছে না। আপনিই তো বাংলাদেশ। অনেকদূর যেতে হবে সেই আপনার প্রিয় রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার মতো। নেত্রী আপনি শতায়ু হোন। কথা শিল্পী শওকত ওসমানের ভাষায় শুধু ‘বাপের বেটা হয় না, বাপের বেটিও হয়।’
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক, ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান
সারাবাংলা/এসবিডিই