Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যদি…

অরুণ কুমার গোস্বামী
২১ মে ২০২২ ১০:৩০

গ্রাম বাংলায় একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘যদি-র কথা নদীতে’! এতদসত্বেও, ‘যদি’ বা ইংরেজি ‘ইফ’ একটি কল্পনা বা স্বপ্ন বা শর্তবাহী এবং যুগপৎ আশা ও হতাশা জাগানিয়া বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ। বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে ‘যদি’ শব্দটি ব্যবহার করে অনেক কাউন্টার ফ্যাকচুয়াল-এর প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। কথিত আছে, যত লোক নাকি ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে যুদ্ধ উপভোগ করেছে তারা ‘যদি’ জোরে চিৎকার করত অথবা একটা করে ঢিল ছুড়ত তাহলে ইংরেজরা ভয়ে পালাত! যদিও এটি একটি ওভারস্টেটমেন্ট ও কাউন্টার ফ্যাকচুয়াল কথা, তারপরেও ‘যদি’ শব্দ এবং ঘটনার তাৎপর্য বুঝানোর জন্য উল্লেখ করলাম।

ঐ সময়ের বাংলার জনগণ এই যুদ্ধের গভীরতা বুঝতে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছিলেন। এই ইতিহাস শুধু জড়তা আর নিষ্ক্রিয়তারই নয়, বেঈমানি আর বিশ্বাসঘাতকতারও বটে। ১৯৪৬ সালের ১০ জুলাই জওহরলাল নেহেরু ‘যদি’ ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা ভবিষ্যতে মেনে নেওয়ার ব্যাপারটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগুরুর ভোটে স্থির করার কথা না বলতেন, তা’হলে দেশভাগ কী উপেক্ষা করা যেত? ১৯৪৬ সালের ২৭ জুলাই মুসলিম লীগের সভায় ওই বছরের ১৬ আগস্ট ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পালন করার সিদ্ধান্ত ‘যদি’ না নিত। অথবা যদি জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতারা ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’-র এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য চরম পদক্ষেপ গ্রহণ না করতেন, তাহলে কী দেশ বিভাগ পরিহার করা যেত? এইসব ‘যদি’ কেন্দ্র করে ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে একবিংশ শতাব্দীর একটি উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন দাঁড়িয়ে আছে ‘ক্যান পার্টিশন বি অ্যাভয়ডেড?’ ‘যদি’ নির্ভর এই প্রশ্নের উত্তরগুলোও কাউন্টার ফ্যাকচুয়াল।

অন্যভাবেও ‘যদি’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে অবস্থিত। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া একটি বহুল আলোচিত নৈতিক স্খলন ও বেলেল্লাপনার জঘন্য শিকার হয়ে নিহত তরুণীর প্রতি এদেশের দুর্ভাগা ও অসহায় মানুষের এক ধরনের সহানুভূতিসিক্ত অভিব্যক্তি হচ্ছে, “‘যদি’ এই দুর্ঘটনাটি না ঘটতো! তাহলে কি কারও কোন ক্ষতি হতো?’ এই কল্পনা ও প্রশ্নের সাথে আর একটি সম্পূরক প্রশ্ন এসে যায়, ‘এই দুর্ঘটনা এবং ক্ষতি কার উপকার বয়ে এনেছে?’ বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা কি এক পক্ষের ‘ক্ষতি’র বিনিময়ে আরেক পক্ষের ‘উপকার’ এর ধারণার উপর পুনঃগঠিত হচ্ছে? এ সমাজটাকে কী সবার জন্য রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী উপকারের ভিত্তিতে গড়ে তোলা সম্ভব নয়? যাকে ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে ‘উইন উইন সিচুয়েশন’! আহা, যদি প্রত্যেকের জয়ী হওয়া বা কল্যান তথা উপকার হওয়ার ধারণার ওপর আমাদের সমাজটা গড়ে উঠতে পারত? এভাবে ‘যদি’ শব্দকে কেন্দ্র করে অসংখ্য আশা, নিরাশা, হতাশা ও প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছে এবং প্রাসঙ্গিক আখ্যায়িকা তৈরি হচ্ছে। ‘যদি’ কেন্দ্রীক আলোচনার জন্য এগিয়ে নেওয়া বিষয়গুলোর কোনটি সাহিত্যের অঙ্গ, কোনটি বিজ্ঞানের সখা, আবার কোনটি রাজনীতির বন্ধু।

সাহিত্য, বিজ্ঞান ও রাজনীতিসহ প্রায় সব বিষয়েই ‘যদি’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই আলোচনার কোন পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে, অনেক উদাহরণের মধ্য থেকে কিছু জগদ্বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম, তত্ত্ব ও রাজনৈতিক বক্তব্যের উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে। ব্রিটিশ লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের ইংরেজি ‘ইফ’ কবিতাটি বিশ্বের সর্বাধিক অনুপ্রেরণাদায়ী কবিতাগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে সমাদৃত। জনপ্রিয় সাহিত্যিক আনিসুল হক এই কবিতাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন এবং ২০২০ সালে বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে বাংলা অনুবাদ প্রকাশের অনেক আগে থেকেই বিশ্বের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে এই কবিতাটির প্রতি বিরাট মাত্রার আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। এই ‘ইফ-’ বা ‘যদি’ কবিতাটির একটি লাইন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত উইম্বলডন কেন্দ্রীয় টেনিস কোর্টে খেলোয়াড়দের প্রবেশ দ্বারের উপরে উৎকীর্ণ করা আছে। যে লাইনগুলো এখানে প্রদর্শিত হয়েছে তা হলো, ‘If you can meet with triumph and disaster and treat those two imposters just the same.’ অর্থাৎ যদি বিজয় ও দুর্যোগের সাথে তুমি মিলিত হতে পারো এবং এই দুই চালবাজ-এর সাথে ঠিক একই আচরণ করতে পারো। ‘যদি’ বিজয় ও দুর্যোগ-এর মুখোমুখি হয়ে উভয়কেই সমানভাবে বিবেচনা করতে পারার অর্থ হচ্ছে সাদামাটাভাবে ঘটনা মেনে নেওয়া এবং যাই আসুক না কেন, জীবন চালিয়ে নেওয়া। এই ধরনের মানসিক প্রস্তুতি মানুষকে সফলতা ও ব্যর্থতা উভয়ের আপেক্ষিকতা মূল্যায়ন করতে শেখায়। কিপলিং কবিতা, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ লিখতেন, তবে তিনি ১৮৯৪ সালে তার লেখা ছোটগল্প সংগ্রহ ‘দ্য জাঙ্গল বুক’-এর জন্য খ্যাতি অর্জন করেছেন। ১৯০৭ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘ইফ’ বা ‘যদি’ কবিতার অমর কয়েকটি লাইন আমাদের মনে করিয়ে দেয় পরিপূর্ণতা অর্জন করার জন্য জীবনে অব্যাহতভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। এটি এমন যে সব শেষে ‘সদগুণ বা নৈতিক উৎকর্ষ বজায় রেখে জনতার সাথে মানুষ মিশতে বা কথা বলতে পারে, অথবা রাজাদের সাথে চলার সময়েও সাধারণের স্পর্শ তথা বোধশক্তি হারিয়ে ফেলা না হয়।’

বাঙালি কবি সুকুমার রায় ‘এমন যদি হতো’ কবিতায় তার ইচ্ছেগুলো প্রকাশ করেছেন। তিনি ‘প্রজাপতি হয়ে’ বিভিন্ন রঙের ফুলের উপর বসতে পারার কল্পনা করেছেন। একই সাথে তিনি ‘পাখি হয়ে’ উড়ে পাহাড় নদী, দেশ বিদেশ এবং সাত সাগর পাড়ি দেওয়ার আশা পোষণ করেছেন। এরপর তিনি ‘মন্দটাকে ধ্বংস’ করার পর ‘ভালোয়’ জগৎ ভরে দিতে চেয়েছেন। সুকুমার রায়ের এই কবিতাটি ‘এমন হবে কি?’ প্রশ্ন দিয়ে শেষ হয়েছে।

অপরপক্ষে, বিজ্ঞান বা গণিতের জগতে মূল্যসাম্যের জন্য ‘যদি এবং শুধু যদি’ পদবাচ্যটি একটি সংকেতবোধক শব্দ। এই আকারের একটি উপপাদ্য বা যুক্তির মাধ্যমে প্রতিপাদনকৃত সত্য প্রমাণ করতে, এটি অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে ‘ক’ এবং ‘খ’ সমতুল্য; অর্থাৎ, যখন ‘ক’ সত্য তখন ‘খ’ শুধু সত্য, তাই যখন ‘খ’ সত্য, ‘ক’ তখনই সত্য। ‘যদি এবং শুধু যদি’ নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে: ‘ক’ যদি ‘খ’ অর্থ হচ্ছে যদি ‘খ’ তবেই ‘ক’; ‘ক’ তখনই শুধু যখন ‘খ’ অর্থ হচ্ছে যদি ‘খ’ নয় তবে ‘ক’ নয়। এটি একটি যৌক্তিক আইন যে যদি ‘ক’ তাহলেই ‘খ’, সবসময়েই যদি ‘খ’ নয় তাহলে ‘ক’ নয়।

যখন ‘যদি এবং শুধু যদি’ সরাসরি প্রমাণ করতে হয়, তখন আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে, যে তুল্যতা আপনি প্রমাণ করছেন তা প্রমাণের সব পদক্ষেপে অটল আছে। এর অর্থ হচ্ছে যে প্রমাণের প্রতিটি পদক্ষেপকে অতি অবশ্যই হয় ‘যদি এবং শুধু যদি’ ব্যবহার করতে হবে অথবা ‘যদি এবং শুধু যদি’ সম্পর্কিত একটি উপপাদ্য ব্যবহার করতে হবে। আপনার উপপাদ্য সব পদক্ষেপে এটি ব্যবহার করেছে এটি নিশ্চিত করা খুবই কঠিন এবং কখনো কখনো অসম্ভব। সুতরাং এক্ষেত্রে একটি বিকল্প প্রমাণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়: আমরা শারীরিকভাবে ‘যদি এবং শুধু যদি’-এর প্রমাণ দু’টি প্রমাণে ভাগ করি, একটি ‘সম্মুখগামী’(ফরওয়ার্ড) এবং আর একটি ‘পশ্চাদগামী’(ব্যাকওয়ার্ড) প্রমাণ। ‘ক’ যদি এবং শুধু যদি ‘খ’ এই আকারের উপপাদ্য প্রমাণ করতে, আপনাকে প্রথমে প্রমাণ করতে হবে ‘যদি ‘ক’ তবে ‘খ’’, তারপরে আপনি প্রমাণ করতে পারবেন ‘যদি ‘খ’ তবেই ‘ক’’, এবং প্রমাণটি সম্পূর্ণ করতে এটিই যথেষ্ট। এই কৌশল প্রয়োগ করে, আপনি ‘যদি… তাহলে’ প্রমাণ ব্যবহার করতে পারেন একই সাথে ‘যদি এবং শুধু যদি’ প্রমাণগুলো আপনার নিজের প্রমাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারবেন।

‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, সংখ্যায় একজনও যদি সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব…’। ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা অন্বেষী মানুষ মাত্রই এই কথা শুনলে আশাবাদী হয়ে ওঠেন। আহা, এমনটিই যদি হত! কত ভালোই না হত! বোঝাই যাচ্ছে, ‘একজন’ হওয়ার কারণে সংখ্যার বিচারে সে অবধারিতভাবেই সংখ্যালঘু। ধর্মীয় পরিচিতিতে যে ধর্মেরই হোক না কেন, তার ভাষা বা জাতিগত পরিচিতি যাই হোক না কেন, একজন মানেই সে সংখ্যালঘু। ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার জন্য হাহাকারপূর্ণ মানবসমাজে ন্যায্য কথা বলার কারণে একজনকে মেনে নেওয়া সমাজের স্বপ্ন আমাদের মধ্যে মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার আশা জাগিয়ে তোলে! ধন্য সেই মহান নেতা যিনি এই অমর কথা উচ্চারণ করেছেন। বাংলাদেশের জনপ্রিয় একটি গণসঙ্গীত ‘যদি রাত পোহালেই শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই… ।’ এখানেও আছে ‘যদি’ এবং তা আশা ও হতাশা দুটোই উস্কে দেয়। শিল্পী তার মনের আকুতি দিয়ে চাইছেন এবং গাইছেন, ‘যদি’ রাত ভোর হওয়ার সাথে সাথেই শোনা যেত ‘বঙ্গবন্ধু’ মরেন নাই! তাহলে কী ভালোই না হতো, বিশ্ব একজন মহান নেতা পাওয়ার পাশাপাশি আমরাও আমাদের জাতির পিতাকে ফিরে পেতাম। কিন্তু পরক্ষণেই হতাশা হতে হয় যে শারীরিক দিক দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে বাঙালির চেতনায় বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব। আর সেই চেতনা ধারণ করেই আমরা বক্ষমান লেখাটির বক্তব্য তুলে ধরতে পারছি। সৈয়দ শামসুল হক যেমনটি প্রশ্ন করেছেন এবং উত্তরও দিয়েছেন তার ‘আমার পরিচয়’ শীর্ষক অমর কবিতায়। বলছেন, ‘…এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে, শুধাও আমাকে এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে?’

লেখক: ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, এবং চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অরুণ কুমার গোস্বামী মত-দ্বিমত যদি...


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর