Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ব্যয় কমানোর সময় এখনই, প্রচারণা পাক কৃচ্ছ্রসাধন

এমদাদুল হক তুহিন
২০ মে ২০২২ ১৭:৩৩

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এখন প্রকাশ্য। বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দার দিকে যাচ্ছে বিশ্ব। জ্বালানি তেলসহ খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধির কারণে দিশেহারা বিশ্ববাসী। বিশ্বের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য গমের সংকটের পড়েছে বাংলাদেশসহ বহু দেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব এটি। এর সঙ্গে রয়েছে জ্বালানি তেল।

বলা হয়ে থাকে, বিশ্বে যখন জ্বালানি তেল ও খাদ্যশস্য গমের সংকট দেখা দেয়, কিংবা এর সাপ্লাই চেইনে ব্যাঘাত ঘটে, অর্থনৈতিক সংকট তখন অনিবার্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে গম রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে বহু দেশ। নিজেদের জোগান নিশ্চিত করছে তারা। এমন পরিস্থিতে গমের মূল্য এখন আকাশচুম্বী। জ্বালানি তেল ও গমে ভর করে টালমাটাল হয়ে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি।

এই দুই পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি-নির্ভর দেশ হওয়ায় সংকটে পড়েছে বাংলাদেশও। আরও অনেক পণ্যই বাংলাদেশকে আমদানি করতে হয়। সেই আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে টান পড়েছে রিজার্ভে। একমাত্র লবণ বাদে দেশে প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দিশেহারা সাধারণ মানুষ। দফায় দফায় সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে, বেড়েছে আটার দাম। বাজার ব্যবস্থার সর্বত্র এখন এর প্রভাব। রেস্টুরেন্ট-হোটেলে খাবার খরচ বেড়েছে। টিস্যু ব্যবহারেও খরচ বেড়ে গেছে। গত এক মাসে দাম কিছুটা হলেও কমেছে কিংবা গত এক বছরে দাম কমেছে— বাজারে এমন পণ্যই খুঁজে পাওয়া কষ্ট হবে।

বৈশ্বিক এই সংকটে বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি হাতে নিয়েছে। দেশের সরকারপ্রধান সবাইকে মিতব্যায়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদরাও এই মুহূর্তে ভোগ-বিলাস কমিয়ে আনার পক্ষে। রিজার্ভ কমে যাওয়া, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, ক্রমশ বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি এবং টালাটাল এই অর্থনীতিতে ব্যয় সংকোচন আলোচনার অগ্রভাগে। কেননা, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যয় সংকোচনের প্রকৃত সময় এখনই।

আরও পড়ুন- বিলাসপণ্যে বাড়তে পারে কর, ৩ প্রতিষ্ঠানকে রূপরেখা তৈরির নির্দেশ

সরকার এমন পরিস্থিতিতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের বিষয়ে পরিপত্র জারি করেছে। পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘করোনা পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে পুনরায় আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত এক্সপোজার ভিজিট, শিক্ষাসফর, এপিএ এবং ইনোভেশনের আওতামুক্ত ভ্রমণ ও ওয়ার্কশপ বা সেমিনারে অংশগ্রহণসহ সব ধরনের বৈদেশিক ভ্রমণ বন্ধ থাকবে। এ আদেশ উন্নয়ন বাজেট ও পরিচালন বাজেট উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অবিলম্বে আদেশটি কার্যকর হবে।’

পরে আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরেও এমন বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের সফর সংকোচন করতে আলাদা করে আদেশ জারি করেছে ব্যাংক-বিমাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও।

জেনে রাখা ভালো, বিদেশ ভ্রমণ একেবারেই বন্ধ করা হয়নি। কেবল বিশেষ ও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। এখানে ‘বিশেষ প্রয়োজনে’র ফাঁক-ফোঁকড় রয়েছে। আবার সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ একেবারে বন্ধ করে দিলেও রাষ্ট্র চলতে পারবে না। বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে সবাইকেও। একইসঙ্গে কেবল ‘ট্যুর’ করতেই সরকারি কর্মকর্তারা যেন বিদেশে যেতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে আমলাদেরই। এক্ষেত্রে কর্মকর্তারা যেন নৈতিক স্খলন না ঘটান, সেটিই এখন খুবই জরুরি।

এক বিদেশ ভ্রমণে কৃচ্ছ্রসাধন বা ব্যয় সংকোচন হবে, তা নয়। সেজন্য এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে দামি গাড়ি ও নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আমদানি কমানোর চেষ্টাও দেখাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনায় দামি গাড়ি ও নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলার সময় এখন ৭৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম জমা দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া শিশুখাদ্য, খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, ওষুধ, কৃষি ও রফতানিমুখী শিল্প ছাড়া সব আমদানিতে ৫০ শতাংশ অর্থ আগে দিতে হবে। আগে ২৫ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েই পণ্য আমদানি করা যেত। সম্প্রতি এ বিষয়ে কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করে আপাতত এসব পণ্য আমদানি না করার অনুরোধ জানিয়েছেনি তিনি।

আরও পড়ুন- সব পণ্যের দাম বেড়েছে, ‘ব্যবহার কমানো’তে জোর

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বৈশ্বিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীকে মিতব্যায়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশবাসীকে আমি অনুরোধ করব, সবাই একটু সাশ্রয়ী হোন, মিতব্যয়ী হোন। ব্যবহারের দিক দিয়ে সবাই একটু সচেতন হলে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’

একইসঙ্গে বর্তমানে প্রয়োজন নেই— এমন প্রকল্প এখনই হাতে না নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সরকারপ্রধান বলেন, ‘যেটা এখনই প্রয়োজন, সেটা করব। যেটা আমাদের এখনই প্রয়োজন নয়, সেটা একটু ধীর গতিতে করব। আমাদের অর্থনীতির ওপর চাপটা যেন না আসে। সারাবিশ্বেই মন্দা। বিশ্ব একটি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে। এজন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। অহেতুক সম্পদ ব্যয় না করি। সংরক্ষণ নীতিতে চলতে হবে। আমরা যদি খুব ভালোভাবে হিসাব করে চলতে পারি, তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না— এটি আমি বিশ্বাস করি।’

সবশেষ বৃহস্পতিবার (১৯ মে) মন্ত্রিসভার বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী বিলাসদ্রব্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করাসহ চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ডলারের বিপরীতে টাকার দরপাতন পরিস্থিতি মোকাবিলায় মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে সংশ্লিষ্ট এই তিন প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছে, বিলাসদ্রব্যে বাড়তি কর আরোপ করলে এগুলোর আমদানি কমবে। সেক্ষেত্রে ডলারের ওপর চাপ কমবে। এছাড়া আর কী কী পদক্ষেপ নিলে বাজার ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা যায়, সেসব বিষয়েও দুই-তিন দিনের মধ্যে রূপরেখা প্রণয়ন করতে বলা হয়েছে। স্পষ্টতই এক্ষেত্রেও সরকার ব্যয়সংকোচন নীতিকেই গুরুত্ব দিতে চাইছে।

অর্থাৎ সরকারের পক্ষ থেকে কৃচ্ছ্রসাধনে এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চলমান বাজার পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের প্রতি, বিশেষ করে স্বচ্ছল নাগরিকদের ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার কমানোর আহ্বান জানাচ্ছেন। সব মিলিয়েই মানুষকে সচেতন করতে, আপাতত ভোগ-বিলাস কমাতে, এখন ব্যাপক অর্থে কৃচ্ছ্রসাধনের প্রচার-প্রচারণা জরুরি বলে মনে করি।

বলে রাখা ভালো— সরকারের পক্ষে ব্যয় সংকোচনের এমন পদক্ষেপ এবারই নতুন নয়। এর আগে ২০০৯ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের আওতায় বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। তখন বাজেটের বাড়তি খরচের জোগান দিতে অপ্রয়োজনীয় পদ পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত করে সরকারি কর্মচারীর মোট সংখ্যা ১০ শতাংশ কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এছাড়াও যানবাহন কেনা, আপ্যায়নসহ সরকারি বিভিন্ন খাতে অপচয় কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে এক পরিপত্র জারি করা হয়েছিল।

ওই সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন সদ্যপ্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত। জোরেশোরেই বেশ কিছু ব্যয় কমানোর পদক্ষেপ নিতে পেরেছিলেন তিনি। তবে উদ্যোগ নেওয়া হলেও বরাবরাই কৃচ্ছ্রসাধনের এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে গড়িমসি দেখা যায়। এবারও কৃচ্ছ্রসাধনে সরকার পুরো সফল হবে, তা বলা যায় না। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ থেমে নেই, সেই আলোচনাও সামনে এসেছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যয় কমানোর আলোচনার এই সময়ে প্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে অর্থ পাচারের বিষয়টিও। আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে কি না, তাও খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। দেশে অবৈধভাবে কেউ বিপুল পরিমাণ ডলার মজুত করছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।

মূলত কৃচ্ছ্রসাধনের এই সময়ে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। সরকারি কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে গাড়ি আমদানি একেবারেই বন্ধ করা যেতে পারে। বন্ধ করা যেতে পারে সোনার আমদানি। প্রসাধনী সামগ্রী বা বিদেশি মদ আমদানিতেও কৃপণতার আশ্রয় নেওয়া হোক। সরকারিভাবে আয়োজিত বিভিন্ন দিবস-কেন্দ্রিক অনুষ্ঠানগুলোর আনুষ্ঠানিকতা সাময়িক সময়ের জন্য প্রায় বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে। আপাতত কমানো যেতে পারে পর্যটনকেন্দ্রিক বিদেশ ভ্রমণ।

এছাড়া সম্প্রতি চালু করা যাবে না কিংবা কাজ মাত্র শুরু হয়েছে, সুফল পেতে সময় লাগতে পারে— সরকারি এমন প্রকল্পের কাজও বন্ধ করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, কৃচ্ছ্রসাধন মানেই সবকিছু স্থবির করে ফেলো নয়। অর্থনীতি সচল রাখতে হবে। কেবল অপ্রয়োজনীয় কিংবা বিলাসী ব্যয়গুলোকে ছেঁকে ছেঁকে বাদ দিতে হবে।

সারাবাংলা/টিআর

এমদাদুল হক তুহিন কৃচ্ছ্রসাধান টপ নিউজ ডলারের বিপরীতে টাকার মান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর