Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চলে গেলেন দেশের প্রথম গাইনি ক্যানসার বিশেষজ্ঞ

অধ্যাপক ডা. মোঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন
২১ মে ২০২২ ১৮:৫৩

চলে যাওয়ার বয়স কি হয়েছিলো তাঁর? মানুষ হিসেবে আমার এ প্রশ্ন অবান্তর। আল্লাহ্‌ জানেন সবকিছু। কিন্তু আমরা ধূলির ধরার ক্ষুদ্র মানুষ তাই কিছু আপন মানুষের চলে যাওয়ায় কষ্ট পাই। মনে হয় আর কিছুূদিন থাকতেন আমাদের মধ্যে!

ডা. খুরশীদ জাহান মাওলা ৫৭ বছর বয়সে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ২০০৯ সালে। খুব কি বেশি বয়স হয়েছিলো খুরশীদ আপার? চলতি বছর গাইনি অনকোলজি সোসাইটির সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল আপার। সেই উপলক্ষে মাত্র কয়েকদিন আগে তার নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবিত কমিটি গঠনের জন্য সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রফেসর টিএ চৌধুরী স্যারসহ মিটিং করলাম সাবজেক্ট কমিটির। কমিটি হওয়ার আগেই চলে গেলেন আমাদের খুরশীদ আপা।

১৯৯৩ সালে আমিসহ ১৮ জন তরুণ ডাক্তার জয়েন করলাম ক্যানসার ইনস্টিটিউটে। তখনও প্রতিষ্ঠানের নামের আগে ‘জাতীয়’ পরিচয় যোগ হয়নি। বেডসংখ্যা পঞ্চাশ। আর চিকিৎসক সব মিলিয়ে চল্লিশ জনের মত। রোটারির বানিয়ে দেওয়া তিনতলা ভবনের নীচতলায় আউটডোরে বসি তখন। পরিচালকের দফতর, প্যাথলজি, রেডিওলজি, ওটি এই ভবনে। পঞ্চাশ বেডের ইনডোর অন্য একটি চারতলা ভবনে, এখন যেটি প্রশাসনিক ভবন বা বি ব্লক। অপারেশনের পর পোস্ট অপারেটিভে কিছুটা সময় রেখে রোগীকে স্ট্রেচারে করে ইনডোরে আনা হতো!

নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে এরকম পরিবেশেও অপারেশন হতো। দেশের প্রথম গাইনি অনকোলজিস্ট খুরশীদ আপা অসীম মমতায় দূরদূরান্তের জরায়ুমুখসহ বিভিন্ন ধরণের ক্যানসার রোগীদের জটিল অপারেশন করতেন কত ঝুঁকি নিয়ে!

ক্যানসার ইনস্টিটিউটের অর্গানোগ্রামে একটি বড় জটিলতা ছিল আর তা হল আমার ডিপার্টমেন্ট ক্যানসার ইপিডেমিওলোজিসহ পাঁচটি বিভাগে অধ্যাপক পদ থাকলেও সহযোগী অধ্যাপকের পদ ছিল না। পিএসসির মাধ্যমে প্রমোশন হতো তখন। পদ ছাড়া প্রমোশনের সুযোগ নেই বলে এখানে অনেক চিকিৎসকই আসতে চাইতেন না।

সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল গাইনি অনকোলজিতে। একটিই সহকারী অধ্যাপকের পদ ছিল তখন, এবং তা শুধুমাত্র ক্যানসার ইন্সটিটিউটেই। তাই এই বিভাগে আসা মানে জীবনে আর পদোন্নতি না হওয়ার সম্ভাবনা মেনে নেওয়া। আমি এই ঝুঁকি নিয়েছিলাম, তবে তা একটু পরে। কিন্তু খুরশীদ আপা অনেক আগেই এই ঝুঁকি নিয়েছিলেন। বড় ডিগ্রি নিতে পারেননি। পাননি বড় কোন পদ। চলতি দায়িত্বে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবেই অবসরে যেতে হয়েছে গাইনি অনকোলজি বিভাগের পথিকৃত এই চিকিৎসককে। তবে তাঁর এই ত্যাগের বিনিময়েই ধীরে ধীরে গাইনি অনকোলজি সাবজেক্ট হিসেবে গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে। বিভাগীয় পর্যায়ে ৮টি স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্রে থাকছে এই বিভাগ।

খুরশীদ আপার কথা মনে আসলেই ফিরে যাই অতীতে। সেই শুরুর দিকে অর্থাৎ নব্বই দশক যখন ক্যানসার হাসপাতাল এত বড় হয়নি। হাসপাতাল ছোট হলেও সারাদেশ থেকে আসা রোগীর চাপ বাড়ছে। আমি ২০০৩ সাল পর্যন্ত বহির্বিভাগে মেডিকেল অফিসার ও চিফ মেডিকেল অফিসার ছিলাম। একদিন অন্তর টিউমার বোর্ড হতো। আমার একটা চেষ্টা থাকতো, দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীদের চিকিৎসা শুরু করতে একটা দিন যেন অতিরিক্ত না লাগে। ৩০/৪০ জন রোগী রেডি করে টিউমার বোর্ডে নিয়ে যেতাম। টিউমার বোর্ডে তখন তারকা চিকিৎসকের সমাহার। পরিচালক অধ্যাপক এমএ হাই, মেডিকেল অনকোলজির অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মিয়া, রেডিয়েশন অনকোলজির অধ্যাপক সমীর কুমার সাহা, হিস্টোপ্যাথলোজির অধ্যাপক এজেই নাহার রহমান, সাইটোপ্যাথলোজির ডা. এইউএম মুহসিন, সার্জিক্যাল অনকোলজির ডা. আব্দুল হাকিম, গাইনি অনকোলজির ডা. খুরশীদ জাহান মাওলা, ইএনটি অনকোলজিতে ডা. একে আজাদ, রেডিওলোজির ডা. মজিজুল হক। আমার একগাদা রোগীর ফাইল দেখে সবাই আঁতকে উঠলেও ধৈর্য ধরে দেখে অলোচনা করে চিকিৎসার প্ল্যান দিতেন।

কিন্তু এর আগে আমাদের কিছু প্রস্তুতি নিতে হতো। রোগীর হিস্ট্রি নিয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নীরিক্ষা করিয়ে, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হতো। রোগী হয়তো নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে এসেছেন। সাথে আসা একাধিক স্বজনসহ একদিন বেশি ঢাকায় থাকতে হবে। খুরশীদ আপার কাছে ফাইল ও রোগী নিয়ে চলে যেতাম। ফিরিয়ে দিতেন না। বড় জোর একটু অনুযোগ করতেন, এত দেরিতে কেন তালুকদার? গাইনি অনকোলজির রোগী দেখতে একটু সময় লাগে। পারভ্যাজাইনাল পরীক্ষা, সাথে প্যাপ বা ভল্ট স্মেয়ার সংগ্রহ। কারও আবার ইইউএ অর্থাৎ এনেস্থিসিয়া দিয়ে পরীক্ষা। প্রচুর রোগী দেখতে হতো আপাকে। এর বাইরে অপারেশন তো ছিলই। একটি মাত্র ওটি। দুপুরেই স্ট্রেচারে করে অন্য ভবন অর্থাৎ ইনডোরে শিফট করার আগে পোস্ট অপারেটিভ চেকআপটা ভালো করে দেখে যাওয়া। জটিলতা দেখা দিলে চিকিৎসক হিসেবে বাসায় ফেরার সময় অনিশ্চিত।

হ্যাঁ। এভাবেই একটা নতুন সাবজেক্ট গড়ে ওঠে কারও না কারও হাত ধরে। কারও শ্রমে-ঘামে-ত্যাগে। পরে যারা আসেন তাদের চলার পথটা একটু করে মসৃণ হয়। আর পথিকৃৎগণ পরে হয়ত ন্যূনতম স্বীকৃতিটুকুও পান না।

সেসময় তরুণ চিকিৎসক হিসেবে আমরা যারা যোগ দিয়েছিলাম, অনেকেই সহযোগিতা করেছেন আমাদের। খুরশীদ আপা আমাদের সবার বড় বোন হয়ে উঠেছিলেন। আমাকে ডাকতেন তালুকদার। বড় মায়ামাখা ডাক ছিল। আপার কাছে আমার কোন দাবি কখনও অগ্রাহ্য হয়নি।

শুধু ইনস্টিটিউট কেন? নারীর ক্যানসার সেবায় যেখানে পেরেছেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

সেই তরুণ বয়সে ক্যানসার প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করার নেশায় পড়ে যাই। বহির্বিভাগে দেরিতে আসা রোগীদের করুণ হাল দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছি, শুধু চিকিৎসা দিয়ে হবে না। প্রয়োজন ব্যাপক গণসচেতনতা। এক ক্যানসার ইনস্টিটিউট দিয়ে হবে না। বেসরকারি পর্যায়ে ক্যানসার হাসপাতাল গড়ে তুলতে হবে। ডেল্টা মেডিকেল সেন্টার ছিলো ধানমন্ডিতে। এর কর্ণধার প্যাথলজির অধ্যাপক সৈয়দ মোকাররম আলী স্যার মিরপুরে বাংলা কলেজের পাশে দারুসসালামে স্থানান্তর করলেন ক্যানসার ইউনিটসহ। জেনারেল হাসপাতাল দিয়ে শুরু বলে আমরা এটাকে বিশেষায়িত হিসেবে না ধরে ঠিক করলাম, একটা বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতাল বানাবো। আহসানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালের মিরপুর ইউনিটও তখন চালু হয় নি। তহবিল সংগ্রহ চলছে। এয়ারপোর্টে বেশ কয়েকটি দানবাক্স বসেছে। সেই সময়ের কথা। আমি তখন মেডিকেল অফিসার। ঢাকায় উদ্যোগ নেওয়ার সাহস নেই। গাজীপুরে আমাদের নিজস্ব দুটো প্লট ছিল একটি বেসরকারি হাউজিংএ। পৈতৃক অনেক জমির বিনিময়ে পাওয়া দুটি টুকরো। আমার আবেগ আর জেদ বরাবরই বেশি। টিনশেড বিল্ডিং বানিয়ে প্রথমে কনসালটেশন সেন্টার, পরে দশ শয্যার হাসপাতাল চালু করলাম। খুরশীদ আপাসহ কয়েকজন সহকর্মী বিশেষজ্ঞ সপ্তাহে একদিন গাড়ির তেল পুড়িয়ে এখানে আসতেন ক্যানসার রোগীদের পরামর্শ দিতে। আসতেন সার্জিকেল অনকোলজির সহকারী অধ্যাপক ডা. আহমেদ সাইদ, রেডিয়েশন অনকোলজির সহকারী অধ্যাপক ডা. হাফিজুর রহমান আনসারী ও ডা. কাজী মনজুর কাদের, ইএনটির অধ্যাপক ওয়াজির আহমেদ চৌধুরীর মত ব্যক্তিত্বরা। ১৯৯৯ সালের ২৯ অক্টোবর ক্যানসার কেয়ার সেন্টার নামে গাজীপুর চৌরাস্তার নলজানিতে দশ বেডের হাসপাতালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যানারে শ্লোগান লেখা ছিলো ‘দেশের প্রথম বেসরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল’। ক্যানসার ইন্সটিটিউটের তৎকালীন, প্রাক্তন ও ভবিষ্যৎ কয়েকজন পরিচালক উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন গাজিপুরের ডিসি, সিভিল সার্জনসহ গণ্যমান্য অনেকেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া। আমাদের মাঝে প্রবল উত্তেজনা। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার কথা না ভেবে ঢাকার সংসার গুটিয়ে গাজীপুর চলে গেলাম। সেখান থেকে বলাকা বাসে করে মহাখালিতে কাজে আসি।

খুরশীদ আপার উৎসাহ আমার চাইতে কম নয়। সপ্তাহে একদিন গাড়ির তেল পুড়িয়ে এসে রোগী দেখার পাশাপাশি প্যাপটেস্ট করা শুরু করলেন। স্লাইডগুলো কপলিং জারে করে ঢাকায় পরীক্ষা করিয়ে আনা হতো। প্রাথমিক রোগীদের ইলেক্ট্রোকটারি করে দিতেন।

তো আমার মত আবেগী মানুষ আরও বেশি সেবা দিতে চেয়ে বড় একটা ভুল করে ফেললাম। দুই-একজনের পরামর্শে গাজীপুর থেকে ঢাকায় শিফট করে ফেললাম হাসপাতাল। প্রথমে গ্রিনরোড, পরে সেখান থেকে লালমাটিয়ায়। খুরশীদ আপা সবসময় পাশে থেকেছেন। আমার স্ত্রীকে ছোটবোন বানিয়েছিলেন। সৌরভের শত প্রশংসা আপার মুখে।

ক্যানসার চিকিৎসা ও সেবায় আরেকজন পথিকৃতের কথা না বললেই না। তিনি খুরশীদ আপার জীবনসঙ্গী অধ্যাপক ডা. এম এ সালাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এর ইউরো-অনকোলজি বিভাগের প্রথম চেয়ারম্যান। খুরশীদ আপাকে কখনও আপা, কখনও ম্যাডাম বললেও সালাম স্যারকে সব সময় স্যার ডাকি। শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসে। নিজ পেশায় অনন্য উচ্চতার পাশাপাশি তারুণ্য ও নতুন উদ্যোগের প্রতি কি প্রবল স্নেহ ও উৎসাহ তাঁর! আমার কাজকে, আমাকে এত গুরুত্ব দিয়ে আসছেন সদা-সর্বত্র, আমি মাঝে মাঝে বিব্রত হয়ে যাই স্যারের বদান্যতায়। কোন অনুষ্ঠানে, তা যত ছোটই হোক, আমি ডেকেছি অথচ এই জুটি আসেননি, এমন হয় নি কখনও। বক্তৃতা দিয়েছেন, বেহালা বাজিয়েছেন। চোখ জুড়ানো ভালোবাসায় মাখামাখি এক অনন্য জুটি।

এর মাঝে অনেক চড়াই-উৎরাই গেল। পরিবর্তিত নামে ক্যানসার ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ওয়ান ইলেভেনের সময় একদিনের মধ্যে দখল হয়ে গেল। ২০০১ সালে হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আমি দশ হাজার প্ল্যাটেলেট কাউন্ট দেখে মৃত্যুকে খুব কাছে অনুভব করে মহান আল্লাহর কাছে ওয়াদা করেছিলাম, তুমি যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখো, ক্যানসার নিয়ে কোন বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সাথে জড়াবো না। যদি পারি, সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়বো। যেখানে নিশ্চয়তা থাকবে গরীব রোগীদের সেবা পাওয়ার। আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেলাম। একটা ট্রাস্ট হলো। স্বল্প খরচে চিকিৎসা শুরু হলো। পনের হাজার টাকায় স্তন ক্যানসারসহ বিভিন্ন মেজর অপারেশন। ভালো সাড়া পড়লো।

২০০৪ সালে স্তন ক্যানসার সেবা সপ্তাহ নাম দিয়ে আয়োজন করলাম সম্ভবতঃ দেশের প্রথম স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম। এরপর জরায়ুমুখের ক্যানসার সেবা সপ্তাহ। এটাও বেসরকারিভাবে আয়োজিত প্রথম স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম। পরিকল্পনা ও আয়োজন আমার। স্ক্রিনিং সেবার দায়িত্ব খুরশীদ আপা একা সামাল দিলেন। কোন ক্লান্তি নেই। নেই আগ্রহের সামান্য কমতি।

হাসপাতাল দখল হয়ে গেল ওয়ান ইলেভেনের ঘোলাটে পরিস্থিতির সুযোগে। নিজের সঙ্গী সাথীদের মধ্যেই কয়েকজনে কান্ডটা ঘটালো। মনোভাবটা এমন, আরও কিছুদিন ব্যবসা করতে হবে, দান করার বয়স হয়নি এখনও!

গাজিপুরে বাড়ি বানানোর জায়গা বিক্রি করে অতি-আবেগী আমি এই বাড়িটা ভাড়া নিয়ে দিয়েছিলাম। সেই বাড়ির একটা রুম, বারান্দা আর একটা গ্যারেজের মধ্যে ১০ বেডের অলাভজনক হাসপাতাল কোনমতে চলে। বিকেলে আমার স্ত্রী হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, কর্মচারীদের নিয়ে ব্যানার হাতে মানববন্ধন করে। ডা. অমুকের দখল থেকে…
এমনি অবস্থায় খুরশীদ আপা বেদখল হাসপাতালে রোগী দেখতে আসেন। সৌরভকে, যাকে ছোটবোন বানিয়েছিলেন, রোদের মধ্যে ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। এই অবস্থায় তোমাকে দেখবো বলে গাজীপুরে তোমার ডাকে চলে যেতাম! এত কষ্ট করেছো এই পরিণতির জন্য!

সেই দুঃসময়ে খুরশীদ আপার হৃদয় ছোঁয়া আবেগ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহস জুগিয়েছিল।

দুঃখের ভাগী যেমন, আনন্দের ভাগাভাগিতেও খুরশীদ আপা আমার বড় অংশীদার ছিলেন সহকর্মী হিসেবে। আউটডোরে আমি বসতাম নীচতলায়। দোতলায় একটা রুমে খুরশীদ আপা বসতেন, রোগী দেখতেন। প্রায় একডজন চিকিৎসকের জন্য গাইনি অনকোলজির সাকুল্যে একটা রুম। সবাই বসতেন খুরশীদ আপার সেই রুমেই। কোনদিন আগেভাগে কাজ শেষ করতে পারলে আপার রুমে ও ব্যাগে হানা দিতাম। আপা ব্যাগ থেকে কাজুবাদাম, আখরোট বের করে দিতেন। মজা করে খেতাম। আরও আছে। আপার সহকারীদের মাঝে ছিলেন ডা. ফারহাত হোসেন, ডা. ফওজিয়া সোবহান, ডা. নাসিম জাহান। পরে ডা. জোনাকি, ডা. শাহানা। এরা পরে সবাই প্রফেসর হয়েছেন কিন্তু আপা হতে পারেন নি।

ফওজিয়া আপা আর নাসিম আপা খুব ভালো গান গাইতেন। কাজ শেষে মাঝে মাঝে দরজা বন্ধ করে আমরা গান গাইতাম। আপা প্রশ্রয় দিতেন। নিজেও গুনগুন করতেন।

করোনাকালে অফুরন্ত সময় কাটাতে প্রতি রাতে ফেসবুকে লাইভ অনুষ্ঠান করতাম। নারীর ক্যানসার পর্বে এসময়ের বিখ্যাত কয়েকজন গাইনি অনকোলজিস্টের সাথে আপাকেও ডেকে নিয়েছিলাম। পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন। আরেকটি পর্ব করেছিলাম সালাম স্যারকে নিয়ে। সেদিন স্যারকে বললাম তাঁর সুযোগ্য জীবনসঙ্গীকে ডেকে দিতে। অনলাইন কারিগরিতে আপা তেমন অভ্যস্ত ছিলেন না। এক ক্যামেরাতেই দুজনকে আনলাম। দেশে ক্যানসারের দুটি বিষয়ের পথিকৃৎ দুজনে।

করোনা আমাদের সবাইকে কেমন দূরে ঠেলে দিল! খুব অনুশোচনা হচ্ছে মাঝে যোগাযোগ অনিয়মিত হয়ে যাওয়ায়। কঠিন একটি বাস্তবতার কথা বলবো শেষ করার আগে। ১৫ মে এশার নামাজের পর নিকেতনে যখন আপার জানাজা হচ্ছিল, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যোগ দিতে পারলাম না। কারণ সেই সন্ধ্যায় রোটারি ক্লাব অব বনানী, ঢাকা আমি ছাড়াও পাঁচ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলো। আমি একা হলে যেতে পারতাম। আরও পাঁচজন ছিলেন, তাই যেতে পারলাম না। অথচ এই সম্মাননা, এই ডা. রাসকিন হওয়ার পেছনে খুরশীদ আপার অনেক অবদান। নিকেতনের বাসায় আপার কুলখানিতে যোগ দিয়ে ফেরার পথে ভাবছিলাম এটাই বোধ হয় জীবনের কঠিন বাস্তবতা। মহান আল্লাহ খুরশীদ আপাকে সম্মানিত করুন। আমিন।

অধ্যাপক ডা. মোঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন
বিভাগীয় প্রধান
ক্যানসার রোগতত্ত্ব বিভাগ
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

সারাবাংলা/আরএফ/

অধ্যাপক ডা. এম এ সালাম অধ্যাপক ডা. মোঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন ক্যানসার প্রতিরোধ জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ডা. খুরশীদ জাহান মাওলা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর