বিএনপি-গণসংহতি বৈঠক: বামপন্থীদের অহেতুক তর্কযুদ্ধ
৩ জুন ২০২২ ১৫:১২
বেশ কিছুদিন ধরেই এ ভূখন্ডের বাম শিবিরে মেঘের তীব্র গর্জন! হঠাৎ করেই গর্জনটা আরো বেড়েছে, ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রতিপক্ষের দিকে যেন মেঘনাদ একের পর এক তার তীক্ষ্ণ বান ছুঁড়ছেন। আলোচনা-সমালোচনায় অনলাইন জগৎ প্রায় সয়লাব। এতো এতো গর্জনের হেতুটা তাহলে কি? হেতু হলো বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম শরিক গণসংহতি আন্দোলন এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির বৃহত্তর ঐক্যের লক্ষ্যে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত। এমনকি জোট শরিকদের নানামুখী বিতর্কে দল দু’টি বাম গণতান্ত্রিক জোট থেকে নিজেদের সদস্যপদ স্থগিত রেখেছেন। সদস্যপদ স্থগিত হওয়ার পরবর্তী বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধি দল আবার তাদের সাথে যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে তাদের অফিসে গিয়ে আলোচনায় বসেছেন।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা ২০০২ সালে। সে অনুযায়ী দলটি দুই দশক পার করেছে মাত্র। অর্থাৎ শৈশব এবং কৈশোরের দিনগুলো পার করে রাজনীতিতে টিকে গেছে গণসংহতি আন্দোলন। নিজেদেরকে হাজির করেছে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর যোগ্য রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে। বরাবরের মতো দলটি বক্তব্য দিয়ে এসেছে জনগণের বাইরে তাদের দ্বিতীয় আর কোন স্বার্থ নেই। পাশাপাশি বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের আকাঙ্খা এবং রাজনৈতিক নানা সংকটের কারণে রাজনৈতিক এ দলটির ভূমিকা অত্যন্ত উজ্জ্বল। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারকে ভিত্তি ধরে তরুণ সব স্বপ্নবাজ সদস্যদের সমাগম। জনগণের কাছে পৌঁছতেও এ সকল কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো। দলটি বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভিত্তি পেলেও নেতৃত্বদের যাত্রাটা অনেক পুরোনো; মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ ও কমিউনিস্ট নেতা বদরউদ্দিন উমরের হাত ধরে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি ধারা গড়ে তোলা যাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। সর্বজন শ্রদ্ধেয় কমিউনিস্ট তাত্ত্বিকের সাহচর্যে নেতৃত্বের পত্তন ঘটলেও গণসংহতি আন্দোলন নিজেকে কখনোই সমাজতন্ত্রী, বামপন্থী বা মার্কসবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রকাশ করেনি। বরং বারবারই মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খার বাস্তবায়ন, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক এবং সর্বাগ্রে বাংলাদেশপন্থী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সময়ের প্রয়োজনে জনগণের স্বার্থে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিতে যুক্ত ছিলো। প্রগতিশীল রাজনৈতিক অবস্থান থেকে অপরাপর প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক এবং বামশক্তির সাথে জোটভুক্ত হয়েছে।
পর পর একটানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ সরকার। পৃথিবীর ইতিহাসে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যা অত্যন্ত বিরল। আওয়ামী রাজনীতির বিরোধীতায় দাঁড়িয়ে বিগত দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি হুমকি দিয়ে এসেছে ‘ঈদের পরেই আন্দোলন’। কিন্তু রাজনীতিতে দমন-পীড়নের ভারসাম্যে ভাটায় থাকা বিএনপির পক্ষে সেরকম উল্লেখযোগ্য কোন আন্দোলনই আর আলোর মুখ দেখেনি। গেলো রোজার ভিতরেও মহাসচিব এবং দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ ঈদ পরবর্তী তুমুল আন্দোলনের হুঁশিয়ারী দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ শূন্য। ঈদ শেষ হয়েছে প্রায় মাসখানেকের মতো হতে চললো, তবে ছাত্র রাজনীতির দু’একটা মৃদু হৈ চৈ ছাড়া আপাতত দৃশ্যগত কোন পার্থক্য নেই। জনগণের অংশগ্রহণে গণআন্দোলনেরও কোন মৌলিক লক্ষণ বা বিন্দুমাত্র রেখাটিও অনুপস্থিত। বরঞ্চ বিএনপির বাইরে সাত দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চ গঠনের উদ্যোগ লক্ষণীয়। যার উদ্যোগে আছে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জেএসডি, গণসংহতি আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং সংস্কারে মঞ্চটির বৃহত্তর ঐক্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আবার বিএনপিও বহু পূর্বে বৃহত্তর ঐক্যের আহ্বান করেছিলো; যদিও তাদের আহ্বান তেমন একটা হালে পানি পায়নি। গণতন্ত্র মঞ্চের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাওয়া লক্ষ্য করে বিএনপিও তাদের বৃহত্তর ঐক্যের আহ্বান নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে, তারা সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে চালিয়ে যাচ্ছেন সংলাপ।
মে মাসের শেষ দিনে বিএনপির প্রতিনিধি দল গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসেছে, অন্যান্যদের অফিসেও যাচ্ছে। রাজনৈতিক শিষ্টাচারের ভিত্তিতে গণসংহতিও বিএনপির প্রতি উদারতা দেখিয়েছে, যুক্তিতর্ক উত্থাপন করেছে; রাষ্ট্রের নানা বিষয় সংস্কারের মতামত রেখেছে। পরিশেষে গণমাধ্যমের কাছে গণসংহতি উপস্থাপিত সংস্কার প্রস্তাবের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। কথা হয়েছে দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলনের এবং সেটা রাজপথে। প্রশ্ন থাকতে পারে গণসংহতি আন্দোলন কি এমন দাবি বা যুক্তিতর্ক উত্থাপন করেছে? স্পষ্ট করে বললে গণতন্ত্র কায়েম, সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ বাতিল, জনগণের মৌলিক অধিকার খর্বকারী আইন রহিতকরণ, নির্বাচন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, সংখানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার। মোটাদাগে বললে রাষ্ট্রের জনগণ, প্রাণ-প্রতিবেশের অধিকার রক্ষা এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির আলোকপাত। এই বিষয়গুলোর সাথে গণতান্ত্রিক যে কোন শক্তি সংহতি জানানোর কথা। অথচ বামপন্থী সদস্যরা বরাবরের মতো নিম্নমানের শিষ্টাচারসুলভ ও অরাজনৈতিক আক্রমণ শুরু করেছেন।
বামপন্থী বন্ধুরা বিএনপি-গণসংহতির মতবিনিময় কে মন বিনিময় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তারা আখ্যায়িত করেছেন গণসংহতি বিএনপির চক্রে ঢুকে যাওয়ার। অথচ বামপন্থী বন্ধুরা একটিবারও ভাবলেন না বিএনপি গণসংহতির কার্যালয়ে এসেছে, গণসংহতি আন্দোলন বিএনপির কার্যালয়ে যাননি। দ্বিতীয়ত গণসংহতি কারো সাথে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা করছে না বা কোন ধরনের বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির জোটেও যাচ্ছে না। কেননা গণসংহতি এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র মঞ্চ গঠনের উদ্যোগেই অটল।
যা হোক ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির কথা বাদই দিলাম, ক্ষমতাসীন সরকারি দলের প্রতিনিধি কেউও যদি গণসংহতি কার্যালয়ে বৈঠক করার জন্য আসেন, সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চায় শিষ্টাচারের অংশ হিসেবে তাদের সাথে কি গণসংহতি বৈঠক করে গণসংহতির দাবি উত্থাপন করতে পারবে না? এমন সব অবান্তর বিষয় সামনে নিয়ে আসলে তারা কমিউনিস্ট হয় কি করে! তাহলে তো প্রশ্ন করতেই হয় যে, আমাদের বন্ধুরা কি জানেন না যে তাদের রাজনৈতিক দলও এক সময়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে সভা করেছিলেন? বামপন্থী সদস্যরা কেউ বলছেন গণসংহতি রসাতলে গেল, বিএনপি বৃত্তে ঢুকে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলছেন আওয়ামী লীগের হয়ে গণসংহতি এবার বিএনপিকে নির্বাচনের আনার ফন্দি এঁটেছে। দেখুন কত বড় সমন্বয়হীনতায় আমাদের বামপন্থীরা আছেন! সর্বোপরি গণসংহতি আন্দোলন যেহেতু নিজেকে কখনো বামপন্থী বা সমাজতান্ত্রী হিসেবে পরিচয়ই দেয়নি, কর্মীরা পর্যন্ত নিজেদের বামপন্থী স্বীকার করে না; তাহলে সমাজতন্ত্র কায়েমে গণসংহতিকেই কেন তুলোধুনো করতে হবে! যে দলটি কমিউনিস্ট না, সোজা কথায় গণতান্ত্রিক তাকে কেন কমিউনিস্ট আন্দোলন করতে হবে? নাকি প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে, একে অপরের দোষ বলে বেড়ানোর রোগে আমাদের বামপন্থীদের পেয়েছে!
যতদূর জানি গণসংহতি আন্দোলন বাম জোটের সাথে একত্রিত হয়েছিলো আন্দোলন সংগ্রামের একটা গতিপথে। কিন্তু আমাদের মূলধারার বামপন্থী দাবিদার বন্ধুরা রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। তারা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন তো করেছেনই না, উপরন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথেও বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তারা বাস্তবিকতার বিচারে জনগণের অধিকার আদায়ে জনগণের বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়ে ক্ষীণ ধারণা পোষণ করেন। ঐক্যের ব্যাপারে আটকে গেছেন শুধুমাত্র বাম ঐক্য এবং মন্দের ভালো গোলকধাঁধায়। অথচ একটু খোঁজ নিলে দেখা যায় যে আমাদের এই ভূখন্ডে বাম আন্দোলনের উর্বর ভূমি। এতো এতো স্বচ্ছ, সৎ, স্বপ্নবাজ ও মেধাবী তরুণের অংশগ্রহণ আর কোন দলের রাজনীতির তলানিতে। এমনকি আদর্শের লড়াইয়ে যে পরিমাণ রক্ত তারা ঝরিয়েছে যা দক্ষিণপন্থি বা মধ্যপন্থী ক্ষমতায় যারা ছিলো তাদেরও নাই। কিন্তু দিনশেষে এই বামপন্থীরাই তাদের নেতৃত্বের ভুলের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করলো, কর্মীরা পড়লো হতাশার গহ্বরে। হতাশাগ্রস্ত কেউ কেউ পরবর্তীতে বেছে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন বুর্জোয়া শ্রেণীর দলগুলোকে।
গণতন্ত্র কায়েম বা জনদাবির পক্ষে কথা বলা অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুদায়িত্ব। স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে এই গণতন্ত্রটা হতে হয় সর্বহারার গণতন্ত্র, নতুবা সাময়িক সময়ের জন্য কিছুটা মুক্তি আসলেও পরবর্তীতে জগদ্দল পাথর চেপে বসা অবশ্যম্ভাবী, নতুন সংকট সৃষ্টি হয়। জনগণের মুক্তি তখন গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকে। জনমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে এই নিয়ামকগুলো বিবেচনাপ্রসূত কার্যকলাপ। রাজনৈতিক দল হিসেবে গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোক্তারা হয়তো সেগুলোও বিবেচনায় রেখেছেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সামনে এনেছেন। সামনে এনেছেন সরকারের রূপরেখা। আলোচক-সমালোচকদের ভিতরে কেবল নিরর্থক তর্কযুদ্ধের লড়াই, ত্রিমুখী প্রশ্নের বান, অহেতুক কাদা ছোড়াছুড়ি। সকলের সুবুদ্ধি হোক।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ঢাকা
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
বিএনপি-গণসংহতি বৈঠক: বামপন্থীদের অহেতুক তর্কযুদ্ধ মত-দ্বিমত সজীব ওয়াফি