ছয় দফা: বিশ্বের শোষিত মানুষের মুক্তি সনদ
৭ জুন ২০২২ ১২:২২
৭ জুন ছয় দফা দিবস। ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ আসলেই ছয় দফা আমাদের স্বাধীনতার ভ্রুণ। ছয় দফা বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের দৃঢ় সেতুবন্ধ। কেন ৭ জুন ছয় দফা দিবস? একটু পটভূমি জানা দরকার।
১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর পর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। এর আগে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মিলিত বিরোধী দলের কনভেনশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। তবে কনভেনশনের সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা নিয়ে সেখানে বিস্তারিত আলোচনা করতে দেননি। শেখ মুজিব ১১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফা সম্পর্কে বিস্তারিত জনসমক্ষে তুলে ধরেন। ছয় দফা প্রচার ও প্রকাশের জন্য শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছয় সদস্য বিশিষ্ট উপকমিটি গঠন করা হয়। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ছয় দফা নিয়ে গোটা পূর্ব পাকিস্তান চষে বেড়ান শেখ মুজিব ও তার সহযোগীরা। ছয় দফার পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন দেখে ৮ মে প্রতিরক্ষা আইনে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। ছয় দফার পক্ষে জনসমর্থন এবং বন্দি নেতাদের মুক্তির দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ডাকে আওয়ামী লীগ।
১.
১৯৬৬ সনে জুনের সেই উত্তাল প্রথম সপ্তাহে কেমন ছিল পূর্ববাংলা? কি ঘটেছিল সেই দিনগুলিতে তা’ পাওয়া যাবে শেখ মুজিবের নিজের জবানিতে। মনে রাখতে হবে তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু হননি। আওয়ামী লীগের নেতা এবং ছয় দফার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে জেলে আটক শেখ মুজিব।
৬ জুন ১৯৬৬, সোমবার। কারাবন্দি শেখ মুজিব লিখেছেন: আগামীকাল ধর্মঘট। পূর্ববাংলার জনগণকে আমি জানি, হরতাল তারা করবে। রাজবন্দিদের মুক্তি তারা চাইবে। ছয়দফা সমর্থন করবে। তবে মোনায়েম খান সাহেব যেভাবে উস্কানি দিতেছেন তাতে গোলমাল বাধাবার চেষ্টা যে তিনি করছেন। এটা বুঝতে পারছি। জনসমর্থন যে তার সরকারের নাই তা তিনি বুঝেও, বোঝেন না। [কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৬৭ ]। দেশ জুড়ে টান টান উত্তেজনা। বন্দি শেখ মুজিব অস্থির, কিন্তু দেশের মানুষের প্রতি তার বিশ্বাসে অটল।
৭ জুন ১৯৬৬, মঙ্গলবার। শেখ মুজিব লিখছেন: ———— কি হয় আজ? আবদুল মোনায়েম খান যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয় কিছু একটা ঘটবে আজ। কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর আসলো দোকান—পাট, গাড়ি, বাস রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে। এই সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে। আবার সংবাদ পাইলাম পুলিশ আনসার দিয়ে ঢাকা শহর ভরে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই জনগণ বে—আইনি কিছু করবে না। শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষের রয়েছে। কিন্তু এরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে দিবে না।
আবার খবর এলো টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে। লাঠিচার্জ হতেছে সমস্ত ঢাকায়। আমি তো কিছুই বুঝতে পারি না। কয়েদিদের কয়েদিরা বলে। সিপাইরা সিপাইদের বলে। এই বলাবলির ভিতর থেকে কিছু খবর বের করে নিতে কষ্ট হয় না। তবে জেলের মধ্যে মাঝেমধ্যে প্রবল গুজবও রটে। অনেক সময় এসব গুজব সত্যই হয়, আবার অনেক সময় দেখা যায় একদম মিথ্যা গুজব। কিছু লোক গ্রেপ্তার হয়ে জেল অফিসে এসছে। তার মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চাই বেশি। রাস্তা থেকে ধরে এনেছে। ১২ টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে। জনগন স্বতস্ফূর্র্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয় দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, কৃষকের বাঁচার দাবি তারা চায়— এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।
এ খবর শুনলেও আমার মনকে বুঝাতে পারছি না। একবার বাইরে একবার ভিতরে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। বন্দি আমি, জনগণের মঙ্গল কামনা ছাড়া কি করতে পারি! বিকালে আবার গুজব শুনলাম গুলি হয়েছে, কিছু লোক মারা গেছে। অনেক লোক জখম হয়েছে। মেডিকেল হাসপাতালেও একজন মারা গেছে। একবার আমার মন বলে, হতেও পারে, আবার ভাবি সরকার কি এতো বোকামি করবে? ১৪৪ ধারা দেওয়া নাই। গুলি চলবে কেন? একটু পরেই খবর এলো ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, মিটিং হতে পারবে না। কিছু জায়গায় টিয়ার গ্যাস মারছে সে খবর পাওয়া গেল। বিকালে আরও বহু লোক গ্রেফতার হয়ে এলো। প্রত্যেককে সামারী কোর্ট করে সাজা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাহাকেও একমাস, কাহাকে দুই মাস। বেশির ভাগ লোকই রাস্তা থেকে ধরেএনেছে শুনলাম। অনেকে নাকি বলে রাস্তা দিয়া যাইতে ছিলাম ধরে নিয়ে এল। আবার জেলও দিয়ে দিল। সমস্ত দিনটা পাগলের মত কাটলো আমার। তালাবদ্ধ হওয়ার পূর্বে খবর পেলাম নারায়ণগঞ্জ, তেজগাঁ, কার্জন হল ও পুরনো ঢাকার কোথাও কোথাও গুলি হয়েছে, তাতে অনেক লোক মারা গেছে। বুঝতে পারি না সত্য কি মিথ্যা! কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারি না। সেপাইরা আলোচনা করে, সেখান থেকে কয়েদিরা শুনে আমাকে কিছু কিছু বলে। তবে হরতাল যে পালন হয়েছে সে কথা সবাই বলছে। এমন হরতাল নাকি কোনদিন হয় নাই। এমনকি ২৯শে সেপ্টেম্বরও না। তবে আমার মনে হয় ২৯শে সেপ্টেম্বরের মতোই হয়েছে হরতাল। গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শুধু পাইপই টানছি— যে এক টিন তামাক বাইরে আমি ছয়দিনে খাইতাম, সেই টিন এখন চারদিনে খেয়ে ফেলি। কি হবে? কি হতেছে? দেশকে এরা কোথায় নিয়ে যাবে, নানা ভাবনায় মনটা আমার অস্থির হয়ে রয়েছে। এমনিভাবে দিন শেষ হয়ে এল। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা জেলে আছি। তবুও কর্মীরা, ছাত্ররা, শ্রমিকরা যে অন্দোলন চালাইয়া যাইতেছে, তাদের জন্য ভালবাসা দেওয়া ছাড়া আমার দেবার কিছু নাই। মনে শক্তি ফিরে এল এবং আমি দিব্যচোখে দেখতে পেলাম ‘জয় আমাদের অবধারিত’। কোন শক্তি আর দমাতে পারবে না।—[কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৬৯/৭০]।
৭ জুন কি ঘটেছিল তার এক পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর ৮ জুন লেখা ডায়েরির পাতায়।
৮ জুন ১৯৬৬, বুধবার। শেখ মুজিব লিখছেন— ভোরে উঠে শুনলাম সমস্ত রাতভর গ্রেপ্তার করে জেল ভরে দিয়েছে পুলিশ বাহিনী। সকালেও জেল অফিসে বহুলোক পড়ে রয়েছে। প্রায় তিনশত লোককে সকাল ৮টা পর্যন্ত জেলে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ বৎসর বয়স থেকে থেকে ৫০ বছর বয়সের লোকও আছে। —এরা জেলে আসার পর খবর এল ভীষণ গোলাগুলি হয়েছে, অনেক লোক মারা গেছে তেজগাঁ ও নারায়ণগঞ্জে। সমস্ত ঢাকা শহরে টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে, লাঠিচার্জও করেছে। — খবরের কাগজের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। —আমি পূর্বে যে অনুমান করেছি তাই হলো। কোন খবরই সরকার সংবাদপত্রে ছাপতে দেয় নাই। ধর্মঘটের কোন সংবাদই নাই। শুধু সরকারি প্রেসনোট। ইত্তেফাক, আজাদ, অবজারভার সকলেরই একই অবস্থা। একই বলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা! — প্রতিবাদ দিবস ও হরতাল যে পুরাপুরি পালিত হয়েছে বিভিন্ন জেলায় সে সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ রইলো না। —পত্রিকার নিজস্ব খবর ছাপতে দেয় নাই। তবে সরকারি প্রেসনোটেই স্বীকার করেছে পুলিশের গুলিতে দশজন মারা গিয়েছে। এটাতো ভয়াবহ খবর। সরকার জখন স্বীকার করেছে দশজন মারা গেছে তখন কতগুন বেশি হতে পারে ভাবতেও আমার ভয় হলো! কতজণ জখম হয়েছে সরকারি প্রেসনোটে তাহা নাই ।—৭ই জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামগঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফূর্র্ত ভাবে ফেটে পড়েছে, কোন শাসকের রক্ত চক্ষুরাঙাানি তাদের দমাতে পারবে না। — যে রক্ত আমার দেশের ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচঢালা কাল রাস্তা লাল করলো, সে রক্ত বৃথা যেতে পারে না। [কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৭১/৭২/৭৩ ]
২.
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে, ছয় দফা আসলে এক দফা। তারা প্রকাশ্যেই শেখ মুজিবকে লক্ষ্য করে বলতেন: ছয়দফা কর্মসূচি পাকিস্তান ভেঙে এর পূর্ব অংশকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সে জন্য তাদের টার্গেট ছিল শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ। ৭ জুন একদিকে যেমন নিজেদের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে ছয় দফার প্রতি পূর্ববাংলার মানুষের সমর্থন ঘোষণার দিন, তেমনি ছয় দফার প্রতি, বাঙালির প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর তীব্র আক্রোশ প্রকাশেরও দিন।
কি ছিল ছয় দফায়? কেন এই ছয় দফা? এই দফাগুলোর পটভূমিই বা কি? আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় গৃহীত হওয়ার পর ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এতে শেখ মুজিবুর রহমান তার ছয় দফার দফাওয়ারী ব্যাখ্যা, পটভূমি, যুক্তি ও এই দফা এবং তাকে নিয়ে সমালোচনার জবাব তুলে ধরেন। [‘আমাদের বাঁচার দাবি: ছয় দফা কর্মসূচি’ শেখ মুজিবুর রহমান; তারিখ: ৪ঠা চৈত্র, ১৩৭২; ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬] এতে নিজেকে ‘খাদেম’ হিসেবে উল্লেখ করে শেখ মুজিব বলছেন: কর্মী ভাইদের সুবিধার জন্য ও দেশবাসী জনসাধারণের কাছে সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যে আমি ৬— দফার প্রতিটি দফার দফাওয়ারী সহজসরল ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও যুক্তিসহ এই পুস্তিকা প্রচার করিলাম। [এই নিবন্ধে সেই বক্তব্য গুলোর খুবই সংক্ষিপ্ত রূপ, ভাষা অবিকল রেখে তুলে ধরা হলো— নিবন্ধকার]
১নং দফা: ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করত: পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে। তাতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইন সভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে।
ব্যাখ্যায় শেখ মুজিব বলছেন: ইহাতে আপত্তির কি আছে? লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তানের জনগণের নিকট কায়েদে আজমসহ সকল নেতার দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হইয়াছিল। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে ৯৭টি যে একুশ দফার পক্ষে আসিয়াছিল, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবি ছিল তার অন্যতম প্রধান দাবি। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষের কথা বলিতে গেলে এই প্রশ্ন চূড়ান্তভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে মীমাংসিত হইয়াই গিয়াছে। কাজেই আজ লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার দাবি করিয়া আমি কোনও নতুন দাবি তুলি নাই।
২নং দফা: ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ওপর রাষ্ট্রীয় ব্যাপার এই দুইটি বিষয় থাকিবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় স্টেটসমূহের (বর্তমান ব্যবস্থায় যাকে প্রদেশ বলা হয়) হাতে থাকিবে।
শেখ মুজিব ব্যাখ্যায় বলছেন: বৃটিশ সরকারের ক্যাবিনেট মিশন ১৯৪৬ সালে যে ‘প্ল্যান’ দিয়াছিলেন এবং যে ‘প্ল্যান’ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এই তিনটি মাত্র বিষয় ছিল এবং বাকিসব বিষয়ই প্রদেশের হাতে দেওয়া হইয়াছিল। কংগ্রেস চুক্তি ভঙ্গ করায় ক্যাবিনেট প্ল্যান পরিত্যক্ত হয়। আমি আমার প্রস্তাবে ক্যাবিনেট প্ল্যানেরই অনুসরণ করিয়াছি। আরেকটা ব্যাপারে ভুল ধারণা সৃষ্টি হইতে পারে। আমার প্রস্তাবে ফেডারেটিং ইউনিটকে ‘প্রদেশ’ না বলিয়া স্টেট বলিয়াছি। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র সব বড় বড় ফেডারেশনেই ‘প্রদেশ’ বা ‘প্রভিন্স’ না বলিয়া ‘স্টেটস্’ বলা হইয়া থাকে।
৩নং দফা: মুদ্রা সম্পর্কে দুইটি বিকল্প বা অল্টারনেটিভ প্রস্তাব দিয়াছি। এই দুইটি প্রস্তাবের যে কোন একটি গ্রহণ করিলেই চলিবে।
ক. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পুর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে। এই ব্যবস্থা অনুসারে কারেন্সি কেন্দ্রের হাতে থাকিবে না, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকিবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুইটি স্বতন্ত্র ‘স্টেট’ ব্যাংক থাকিবে।
খ. দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকিবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এ অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে; দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে।
শেখ মুজিব ব্যাখ্যা দিচ্ছেন: যদি আমার দ্বিতীয় অল্টারনেটিভ গৃহীত হয়, তবে মুদ্রা কেন্দ্রের হাতেই থাকিয়া যাইবে। যদি পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা আমার এই প্রস্তাবে রাজী না হন, তবেই শুধু প্রথম বিকল্প অর্থ্যাৎ কেন্দ্রের হাত হইতে মুদ্রাকে প্রদেশের হাতে আনিতে হইবে। আমার প্রস্তাবের মর্ম এই যে, উপরোক্ত দুই বিকল্পের দ্বিতীয়টি গৃহীত হইলে মুদ্রা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে থাকিবে। সে অবস্থায় উভয় অঞ্চলের একই নকশার মুদ্রা বর্তমানে যেমন আছে তেমনি থাকিবে। পার্থক্য শুধু এই হইবে যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাংক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাতে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বা সংক্ষেপে ‘ঢাকা’ লেখা থাকিবে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাংক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাতে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ বা সংক্ষেপে ‘লাহোর’ লেখা থাকিবে। পক্ষান্তরে, আমার প্রস্তাবের দ্বিতীয় বিকল্প না হইয়া যদি প্রথম বিকল্পও গৃহীত হয়, সে অবস্থাতেও উভয় অঞ্চলের মুদ্রা সহজে বিনিময়যোগ্য থাকিবে এবং পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতীক ও নিদর্শন স্বরূপ উভয় আঞ্চলিক সরকারের সহযোগিতায় একই নকশার মুদ্রা প্রচলন করা যাইবে।
৪নং দফা: সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধায্য ও আদায়ের ক্ষমতা থকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউ এর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলেঅটোমেটিকক্যালি জমা হইয়া যাইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংক সমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকিবে। এইভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের তহবিল হইবে।
শেখ মুজিব ব্যাখ্যায় বলছেন: আমার এই প্রস্তাবে কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধায্যের্র দায়িত্ব দেয়া না হইলেও কেন্দ্রীয় সরকার নির্বিঘ্নে চলার মত যথেষ্ট অর্থের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। সে ব্যবস্থা নিখুঁত করিবার শাসনতান্ত্রিক বিধান রচনার সুপারিশ করা হইয়াছে। এটাই সরকারী তহবিলের সবচেয়ে অমোঘ, অব্যর্থ ও সর্বাপেক্ষা নিরাপদ উপায়। তারা এটাও জানেন যে, কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্য্যের ক্ষমতা না দিয়াও ফেডারেশন চলার বিধান রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বীকৃত। ৩ নং দফারব্যাখ্যায় আমি দেখাইয়াছি যে, অর্থমন্ত্রী ও অর্থদফতর ছাড়াও দুনিয়ার অনেক ফেডারেশন চলিতেছে। আমার প্রস্তাব কার্যকরী হইলেও তেমনি পাকিস্তাানের দেশরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হইবে না। কারণ আমার প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় তহবিলের নিরাপত্তার জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হইয়াছে। সে অবস্থায় শাসনতন্ত্রেও এমন বিধান থাকিবে যে, আঞ্চলিক সরকার যেখানে যখন যে খাতেই যে টাকা ট্যাক্স ধার্য্য ও আয় করুন না কেন, শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত সে টাকায় হারের অংশ রিজার্ভ ব্যাংকে কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হইয়া যাইবে। সে টাকার আঞ্চলিক সরকারের কোন হাত থাকিবে না।
৫নং দফা: বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নিমনরূপ শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করিয়াছি: ১. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে। ২. পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকিবে। ৩. ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা দুই অঞ্চল হইতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারাহারি মতে আদায় হইবে। ৪. দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানী রফতানী চলিবে। ৫. ব্যবসা বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানী রফতানী করিবার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে।
শেখ মুজিব ব্যাখ্য দিচ্ছেন: পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক নিশ্চিত মৃত্যু হইতে রক্ষা করিবার জন্য এই ব্যবস্থা ৩ নং দফার মতই অত্যাবশ্যক। পাকিস্তানের আঠার বছরের আর্থিক ইতিহাসের দিকে একটু নজর বুলাইলেই দেখা যাইবে যে— ক) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা দিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প গড়িয়া তোলা হইয়াছে এবং হইতেছে। সেই সকল শিল্পজাত দ্রব্যের অর্জিত বিদেশী মুদ্রাকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিতবিদেশী মুদ্রা বলা হইতেছে। খ) পূর্ব পাকিস্তানে মুলধন গড়িয়া না উঠায় পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের নাই এই অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বিদেশী আয় পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হইতেছে। এইভাবে পূর্ব পাকিস্তান শিল্পায়িত হইতে পারিতেছে না। গ) পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণে আয় করে সেই পরিমাণ ব্যয় করিতে পারে না। সকলেই জানেন, পূর্ব পাকিস্তানে যে পরিমাণ রফতানী করে আমদানী করে সাধারণত তার অর্ধেকের কম। ফলে অর্থনীতির অমোঘ নিয়ম অনুসারেই পূর্ব পাকিস্তানে ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি ম্যালেরিয়া জ্বরের মত লাগিয়াই আছে। তার ফলে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম এত বেশী। বিদেশ হইতে আমদানী করা একই জিনিসের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান দামের তুলনা করিলেই এটা বুঝা যাইবে। বিদেশী মুদ্রা বণ্টনের দায়িত্ব এবং অর্থনৈতিক অন্যান্য সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারেরএখতিয়ারে থাকার ফলেই আমাদের এই দুর্দশা। ঘ) পাকিস্তানের বিদেশী মুদ্রার তিন ভাগের দুই ভাগই অর্জিত হয় পাট হইতে। অথচ পাটচাষীকে পাটের ন্যায্য মুল্য তো দূরের কথা আবাদী খরচাটাও দেয়া হয় না। ফলে পাটচাষীদেও ভাগ্য আজ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের খেলার জিনিসে পরিণত হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান সরকার পাটের চাষ নিয়ন্ত্রণ করেন কিন্তু চাষীকে পাটের ন্যায্য দাম দিতে পারেন না।
৬নং দফা: পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারী রক্ষীবাহিনী গঠনের সুপারিশ।
শেখ মুজিব বলছেন: এ দাবী অন্যায়ও নয়, নতুনও নয়। একুশ দফার দাবিতে আমরা আনসার বাহিনীকে ইউনিফর্মধারী সশস্ত্র বাহিনীতে রূপান্তরিত করার দাবি করিয়াছিলাম। তাতো করা হয়ই নাই, বরঞ্চ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনস্থ ইপিআর বাহিনীকে এখন কেন্দ্রের অধীনে নেয়াহইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করতঃ এ অঞ্চলকে আত্মরক্ষায় আত্মনির্ভর করার দাবি একুশ দফার দাবি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বার বছরেও আমাদের একটি দাবিও পূরণ করেন নাই। পূর্ব পাকিস্তান অধিকাংশ পাকিস্তানীর বাসস্থান। এটাকে রক্ষা করা কেন্দ্রীয় সরকারেরই নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে আমাদের দাবি করিতে হইবে কেন? সরকার নিজে হইতে সে দায়িত্ব পালন করেন না কেন? পশ্চিম পাকিস্তান আগে বাঁচাইয়া সময় ও সুযোগ থাকিলে পরে পূর্ব পাকিস্তান বাঁচান হইবে, ইহাই কি কেন্দ্রীয় সরকারের অভিমত? পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষা ব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানেই রহিয়াছে এমন সাংঘাতিক কথা শাসনকর্তারা বলেন কোন মুখে? মাত্র সতর দিনের পাক—ভারত যুদ্ধই কি প্রমাণ করে নাই আমরা কত নিরুপায়? শত্রুর দয়া ও মর্জির উপর তো আমরা বাঁচিয়া থাকিতে পারি না। কেন্দ্রীয় সরকারের দেশরক্ষা নীতি কার্যতঃ আমদেরকে তাই করিয়া রাখিয়াছে।তবু আমরা পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির খাতিরে দেশরক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখিতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে এও চাই যে, কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে আত্মনির্ভর করিবার জন্য এখানে উপযুক্ত পরিমাণ দেশরক্ষা বাহিনী গঠন করুন। অস্ত্র কারখানা স্থাপন করুন। নৌ—বাহিনীর দফতর এখানে নিয়া আসুন।
ছয় দফা নিয়ে যাতে কোন বিভ্রান্তি না হয়, পশ্চিম পাকিস্তানে সাধারণ মানুষ যাতে ছয় দফাকে ভুল না বোঝেন সে জন্য শেখ মুজিব বলছেন: এক. মনে করিবেন না আমি শুধু পূর্ব পাকিস্তানীদের অধিকার দাবি করিতেছি। আমার ৬—দফা কর্মসূচীতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দাবিও সমভাবেই রহিয়াছে। এ দাবি স্বীকৃত হইলে পশ্চিম পাকিস্তানীরাও সমভাবে উপকৃত হইবেন। দুই. আমি যখন বলি, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার ও স্তূপীকৃত হইতেছে তখন আমিও আঞ্চলিক বৈষম্যের কথাই বলি, ব্যক্তিগত বৈষম্যের কথা বলি না। আমি জানি, এ বৈষম্য সৃষ্টির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীরাই দায়ী নয়। আমি এও জানি যে, আমাদের মত দরিদ্র পশ্চিম পাকিস্তানেও অনেক আছেন। যতদিন ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান না হইবে, ততদিন ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এই অসাম্য দূর হইবে না? কিন্তু তার আগে আঞ্চলিক শোষণও বন্ধ করিতে হইবে।
শেখ মুজিব নিজের উদারতার চিত্র তুলে ধরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বলেন:
১। প্রথম গণ—পরিষদে আমাদের মেম্বর সংখ্যা ছিল ৪৪; আর আপনাদের ছিল ২৮। আমরা ইচ্ছা করিলে গণতান্ত্রিক শক্তিতে ভোটের জোরে রাজধানী ও দেশ রক্ষার সদর দফতর পূর্বপাকিস্তানে আনিতে পারিতাম। তা করি নাই।
২। পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যাল্পতা দেখিয়া ভাই এর দরদ লইয়া আমাদের ৪৪ টা আসনের মধ্যে ৬ টাতে পূর্ব পাকিস্তানীর ভোটে পশ্চিম পাকিস্তানী মেম্বর নির্বাচন করিয়াছিলাম।
৩। ইচ্ছা করিলে ভোটের জোরে শুধু বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিতে পারিতাম। তা না করিয়া বাংলার সাথে উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষার দাবি করিয়াছিলাম।
৪। ইচ্ছা করিলে ভোটের জোরে পূর্ব পাকিস্তানের সুবিধাজনক শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পারিতাম।
৫। আপনাদের মন হইতে মেজরিটি ভয় দূর করিয়া সে স্থলে ভ্রাতৃত্ব ও সমতাবোধ সৃষ্টির জন্যউভয় অঞ্চলে সকল বিষয়ে সমতা বিধানের আশ্বাস আমরা সংখ্যা গুরুত্ব ত্যাগ করিয়া সংখ্যা—সাম্য গ্রহণ করিয়াছিলাম।
সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানী ভাই সাহেবান, আপনারা দেখিতেছেন, যেখানে যেখানে আমাদের দান করিবার আওকাৎ ছিল, আমরা দান করিয়াছি। আর কিছুই নাই দান করিবার। থাকিলে নিশ্চয় দিতাম। — আশা করি, আমার পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা এই মাপকাঠিতে আমার ছয়—দফা কর্মসূচীর বিচার করবেন। তা যদি তাঁরা করেন তবে দেখিতে পাইবেন, আমার এই ছয়—দফা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি নয়, গোটাপাকিস্তানেরই বাঁচার দাবি।
শেখ মুজিব তার দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরে বলছেন: পূর্বপাকিস্তানের ন্যায্য দাবির কথা বলিতে গেলে দেশদ্রোহিতার বদনাম ও জেল জুলুমের ঝুঁকি লইয়াই সে কাজ করিতে হইবে। অতীতে এমন অনেক জেল জুলুম ভুগিবার তকদির আমার হইয়াছে। মুরুব্বিদের দোয়ায়, সহকর্মীদের সহৃদয়তায় এবং দেশবাসীর সমর্থনে সে সব সহ্য করিবার মত মনের বল আল্লাহ আমাকে দান করিয়াছেন। সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর ভালবাসাকে সম্বল করিয়া আমি এ কাজে যে কোন ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি। আমার দেশবাসীর কল্যাণের কাছে আমার মত নগণ্য ব্যক্তির জীবনের মূল্যই বা কতটুকু? মজলুম দেশবাসীর বাঁচার দাবির জন্য সংগ্রাম করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছুই আছে বলিয়া আমি মনে করি না। মরহুম জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ন্যায় যোগ্য নেতার কাছেই আমি এ জ্ঞান লাভ করিয়াছি। তার পায়ের তলে বসিয়াই এতকাল দেশবাসীর খেদমত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। তিনিও আজ বাঁচিয়া নাই, আমিও আজ যৌবনের কোঠা বহু পিছনে ফেলিয়া প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছিয়াছি। আমার দেশের প্রিয় ভাই বোনেরা আল্লাহর দরগায় শুধু এই দোয়া করিবেন, বাকী জীবনটুকু আমি যেন তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনায় নিয়োজিত করিতে পারি। ইতিহাস সাক্ষী দেবে শেখ মুজিব জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তার ওয়াদা রক্ষা করেছেন।
৩.
রাাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, ইংল্যান্ডের ‘ম্যাগনা কার্টা’ যেমন বিশ্বকে পরিবর্তিত করেছে, বাংলাদেশের ‘ম্যাগনা কার্টা ছয় দফা’ তেমনি শুধু বাঙালির ভাগ্যই পাল্টায়নি, পৃথিবীর শোষিত মানুষের ভাগ্য বদলের ম্যাগনা কার্টা হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু যেমন বলতেন, পৃথিবী আজ দুইভাগে বিভক্ত— শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। ছয় দফার প্রতিটিতেই তার এই দর্শন উজ্জ্বল ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
সে জন্য ছয় দফা শুধু বাঙালি জনগোষ্ঠীর নয়, বিশ্বের সকল শোষিত মানুষেরই মুক্তি সনদ।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ছয় দফা: বিশ্বের শোষিত মানুষের মুক্তি সনদ মত-দ্বিমত মনজুরুল আহসান বুলবুল