বাংলাদেশে কী চায় যুক্তরাষ্ট্র?
২০ জুন ২০২২ ১৪:১৫
পেয়ে বসার মতো বাংলাদেশকে সম্প্রতি আবার বেশি বেশি নসিয়ত করছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ নিয়ে গত বছর কয়েকের তুলনায় যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত তারা। বিশেষ করে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। যোগদানের শুরু থেকেই অ্যাক্টিভ তিনি। প্রতিদিনই তাগিদ দিচ্ছেন সুষ্ঠু নির্বাচনের। কেবল সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নয়, সর্বজন গ্রহণযোগ্যসহ বিশেষায়িত নানা আকাঙ্খা যোগ করে চলছেন। ক’দিন ধরে বলছেন, সামনের নির্বাচন হতে হবে আন্তর্জাতিকমানের। মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়েও কথা বলছেন সমানে। জবাবদিহি ছাড়া র্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সুযোগ নেই -এমন খাসকথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন পিটার হাস।
নানা ঘটনার পরিক্রমায় ২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কমতে থাকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা তথা তৎপরতা। বিগত দুইজন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ঢাকায় কেবল রুটিন ওয়ার্কে ছিলেন। কিন্তু সেই জায়গা থেকে সরে এসেছেন নতুন রাষ্ট্রদূত হাস। বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন। পরামর্শ দিচ্ছেন। আকাঙ্খার কথা জানাচ্ছেন। সর্বশেষ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যা দেখতে চায়, আমরা তা দেখতে চাই। সেটি হচ্ছে যে আন্তর্জাতিক মানের একটি নির্বাচন হবে, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ তাদের পরবর্তী নেতাদের বেছে নিতে পারবে একটি অবাধ, প্রতিযোগিতামূলক, সহিংসতাবিহীন ও দমন-নিপীড়নমুক্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।’
বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বা হিতাকাঙ্খী হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হাস মন্দ কিছু বলেছেন -এমনও নয়। কিন্তু, তার বলাবলি একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিনা -প্রশ্নটি ঘুরছে নানা মহলে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন কি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হয়? এ প্রশ্নও সামনে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের পর ক্যাপিটল হিলে হামলা হয়েছে, টিভি পর্দায় গোটা পৃথিবীর মানুষ তা দেখেছে। বাংলাদেশে টানা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হলেও চর্চার দিক এখনো ওই পর্যায়ে যায়নি। বাংলাদেশের রাজনীতির ভারসাম্য ও ক্ষমতার চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স না থাকার পেছনে পরামর্শদাতা যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততাও প্রশ্নের বাইরে নয়। হয় পক্ষে, নয় বিপক্ষে থাকেই তারা। সেই একাত্তর থেকে ওয়ান ইলেভেন, এর আগে-পরের হাঁ-না, নিশি বা একতরফা ভোট কোনটাতে ছিল না?
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ ব্যস্ততা নির্বাচনের জন্যই? আগে-পিছে অন্য কিছু নেই তো? প্রশ্নগুলো ঘুরলেও জবাব স্পষ্ট নয়। আদ্যোপান্ত জানা আরো অপেক্ষার বিষয়। ঢাকায় হাসের আগের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক নিযুক্ত হয়েছেন। গ্লোবাল ট্যালেন্ট পরিচালকও নিযুক্ত হয়েছেন। কারো কারো কাছে এটি চিন্তার বিষয়। কিছু দুঃখজনক ঘটনা ও কথাবার্তা থাকলেও বার্নিকাট কোনো শব্দ না করে সময় শেষে ঢাকা থেকে প্রস্থান করেছেন। কিন্তু, পিটার হাস মার্কিন এই রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক খোলামেলা এবং আক্রমণাত্মক বক্তব্য নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে কথার কচলানি চলছে। ভারত ও চীনের দীর্ঘদিনের দ্বৈরথের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মতিগতির জের বাংলাদেশের ওপর পড়েছে অনেকের মূল্যায়ন। এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সুদূরপ্রসারী প্রভাব আঁচ করছেন কেউ কেউ।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা ও নীতির বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে বলে যাচ্ছে চীন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এ মর্মে বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়াবিষয়ক মহাপরিচালক লিউ জিনসং বেইজিংয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামানকে এ বিষয়ক বার্তা দিয়েছেন। সম্প্রসারিত কোয়াডে বাংলাদেশ যোগ দিলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানিয়ে রেখেছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীনের বিনিয়োগ শিকারের পরিণতি এবার ভোগ না করে উপায় থাকছে কিনা ঝানু কূটনীতিকরাও বুঝতে পারছেন না। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন যা করছে -বলছে সব একটি মহলের পক্ষে যাচ্ছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক নানা সমীকরণ লুকানো।
হাই-প্রোফাইলের এ কূটনীতি বুঝতে এখন আর ঝানু কূটনীতিক হওয়া লাগছে না। বৈশ্বিক রাজনীতিতে সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব বিস্তার করেই চলছে। এর জেরে পরাশক্তিকেন্দ্রিক নতুন মেরুকরণের নমুনা। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের ওপর এর কী প্রভাব পড়তে পারে -এ নিয়ে আলোচনা বেশ সরগরম। বিশ্লেষণ নানামুখী। ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে চীন-ভারত দ্বন্দ্বের প্রভাব বাংলাদেশের ওপর আছড়ে পড়াও স্বাভাবিক। কোয়াডের মতো জোটে বাংলাদেশকে যোগ দেয়ানোর চেষ্টা করে এখনো সুফল নিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। সেইসঙ্গে সামরিক জোট অকাসতো আছেই। কোয়াড এবং অকাস গঠনের মূল উদ্দেশ্য চীনকে রোখা। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য বিষয়টি স্পর্শকাতর। বাংলাদেশকে করনীয় ঠিক করতে হচ্ছে ডান-বাম, আগ-পিছ ভেবে। কারণ, বাংলাদেশে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের বেশিরভাগই হচ্ছে চীনা অর্থায়নে। স্বাভাবিকভাবে তা চীনের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। এর মাঝেই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
পরিস্থিতির এ অনিবার্যতায় বাংলাদেশকে বেশি-বেশি করে বলতে হচ্ছে- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। বিশ্ব যে অশান্তির নতুন খাদে পড়তে যাচ্ছে তা কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা চীন-রাশিয়া নয়, তা আরো অনেকের চালচলন-ভাবভঙ্গিতেই স্পষ্ট। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক। প্রকাশ্যে এ সতর্কতার কথা না বললেও ‘ঢং’ শব্দ দিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তার বক্তব্যটি হুবহু এ রকম- ‘কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তার প্রধানকে যুক্ত করা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন একটা ঢং।’
র্যাব এবং এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের বিরক্তির কথা জানাতে গিয়ে ‘ঢং’ যুক্ত এ মন্তব্য করেন তিনি। আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়ে এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করায় ক্ষোভও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিশ্বব্যাপী প্রভাব-প্রতিপত্তিবান যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশ যে অগ্রাহ্য করছে বা পাত্তা দিচ্ছে না-এমনও নয়। এরমাঝেই সম্পর্কে ছেদ পড়ে কখনো কখনো। পারস্পরিক বিরক্তি বাড়ে। পরে আবার ম্যানেজও হয়। কিন্তু, সাম্প্রতিক পদক্ষেপটা বেশির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। উচ্চারণ হচ্ছে কিছু তিক্ত কথাও। যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশের বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নৃশংসতার কথাও বাদ যাচ্ছে না।
একাত্তরে দেশ স্বাধীনের পর চারদিকে যুদ্ধের দগদগে ক্ষতের মধ্যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় ও দেশ পুনর্গঠনে বন্ধু দেশগুলোর সহায়তা পাওয়ার চেষ্টার সময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে আখ্যায়িত করেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার। তৎকালীন পাকিস্তান-সমর্থক কয়েকটি দেশের অন্যায্য তৎপরতায় জাতিসংঘের সদস্য পদ পেতে প্রায় দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয় বাংলাদেশকে। যুদ্ধকালেও বৈরি ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তারা তখন চীনের সঙ্গে মৈত্রী করতে গিয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। অন্যদিকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পক্ষে। স্বাধীনতার পর ধাপে-ধাপে নানা প্রক্রিয়া ও কূটনীতিতে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের তত্ত্বে যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশের মিত্র। এ বাস্তবতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে নতুন কোনো জটিলতা তৈরি হতে চলেছে কি-না, এ প্রশ্ন বেশ প্রাসঙ্গিক।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি