কেন পদ্মা সেতু আমার আবেগ
২২ জুন ২০২২ ১০:৪৬
২৫ জুন বাংলাদেশের সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হতে যাচ্ছে আরেকটি পালক। উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বহুল কাঙ্ক্ষিত-বহুল আলোচিত-বহুল আলোড়িত স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এটি এখন আর নতুন কোনো খবর নয়। আর এ সম্পর্কে জানে না এদেশে এমন মানুষও বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। বলা হচ্ছে স্বপ্নের সেতু। স্বপ্নের? সে তো বটেই। একটি সেতু কীভাবে একটি জাতির স্বপ্নের সেতু হয়ে উঠতে পারে সেটিও একটি বিরল ঘটনা।
বাংলাদেশে ইতোমধ্যে অনেক সেতু হয়েছে, এখনো হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। শুধু সেতু নয়, এদেশে আরো অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে এবং হচ্ছে। মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, উড়ালসেতু, কর্ণফুলি টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, পায়রা সমুদ্র বন্দর—এই রকম অনেক যুগান্তকারী উদ্যোগের কথা বলা যায়। তবে সে সব উদ্যোগ নিয়ে এত কথা হয়নি যত কথা হয়েছে এবং হচ্ছে এই এক পদ্মা সেতু নিয়ে। সে সব নিয়ে এতটা উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়নি, যতটা হচ্ছে এই পদ্মা সেতু নিয়ে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন? পদ্মা সেতু নিয়ে কেন এত হৈচৈ, কেন এত কথা, কেন এত উচ্ছ্বাস? অনেকেই বলছে নিজেদের অর্থায়নে এই সেতু বানানো বলেই কি? খরস্রোতা পদ্মা নদী নিজেই একটা চ্যালেঞ্জ ছিল বলেই কি? এই সেতু বানাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে বলেই কি? পৃথিবীতে এই ধরনের নদীর উপর এই ধরনের সেতু আগে আর কখনো নির্মিত হয়নি বলেই কি? এই সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার সক্ষমতা ও সামর্থ্য তুলে ধরতে পেরেছে বলেই কি?
উপরের এই প্রশ্নগুলোর কোনোটিই অমূলক নয়। প্রশ্নগুলোর যে কোনোটিই এর উত্তর হতে পারে। কারণ পদ্মা সেতু নিয়ে এতো বহুমাত্রিকতা রয়েছে যে অনেকভাবেই এ নিয়ে কথা বলা যায়। বলাও হচ্ছে।
তবে আমার কাছে মনে হয় উপরের কারণগুলো ছাড়াও পদ্মা সেতু নিয়ে এত উচ্ছ্বাস, এত আবেগের কারণটা আসলে অন্যখানে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব তো আর এমনি এমনি আসেনি। এর জন্য এ-দেশের মানুষকে নয় মাস যুদ্ধ করতে হয়েছে, ত্রিশলাখ মানুষকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে, তিনলাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই দেশের মানুষের আবেগের জায়গাটা অন্য দেশ থেকে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পদ্মা সেতুতে আমার আবেগের জায়গাটা কোথায়?
বিশ্ব রাজনীতিতে সাধারণত দেখা যায় যে মোড়ল রাষ্ট্রগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট ( সামরিক শক্তি এবং অর্থনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে) রাষ্ট্রগুলোর উপর কারণে-অকারণে ছড়ি ঘুরিয়ে থাকে এবং ঘুরাতে পছন্দও করে। তারা সেইসব রাষ্ট্রগুলোকে তাদের আজ্ঞাবহ করে রাখতে চায়। সেই রাষ্ট্রের কিসে ভালো কিসে মন্দ সেইসবও তারা নির্ধারণ করে দিতে চায়। তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায়। তারা চায় উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকুক। এমনকি কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও মোড়ল রাষ্ট্রগুলো তাদের সার্বভৌমত্বে হাত দিতে মোটেও কুণ্ঠিত হয় না। চলমান বিশ্বরাজনীতির দিকে তাকালে সেই চিত্রটিই দেখা যায়।
বাংলাদেশকেও বিভিন্ন সময় এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। তার খেসারতও আমাদের দিতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ আর আগের সেই জায়গাটিতে নাই। যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া একটি দেশকে সেই জায়গা রাখা যায় না। কিন্তু মোড়ল রাষ্ট্রগুলো সেটি বুঝতে পারেনি। পদ্মাসেতুর ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটেছে।
পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিপ্রায়ের অভিযোগ তুলে বাংলাদেশকে তারা হেয় করতে চেয়েছিল। বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে বাংলাদেশকে আটকাতে চেয়েছিল। এ নিয়ে বিশ্বব্যাংক নানা রকম হুমকি-ধামকিও দিয়েছে। এক পর্যায়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে তারা সরে গেছে। অথচ কানাডার আদালতেই পরে প্রমাণিত হয়েছে যে এটি ছিল মিথ্যা একটি অভিযোগ। এ ঘটনা এদেশের মানুষকে ব্যথিত করেছে, ক্ষুব্ধ করেছে। বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত ছিল লাখো শহিদের রক্তে অর্জিত এই দেশকে অপমানের শামিল।
বিশ্বব্যাংকের এই সরে যাওয়াতে বাংলাদেশ কিন্তু থেমে যায়নি। বরং নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় সিদ্ধান্ত বিশ্বকে এই বার্তা দিয়েছে যে কোনো অন্যায়ের কাছে বাংলাদেশ কখনো মাথা নত করবে না। তাই পদ্মা সেতু নিছক একটি সেতু নয়। আকারে বড় কিংবা নির্মাণে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল কিংবা নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত- সেসব কথার চেয়েও পদ্মা সেতু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সার্বভৌমত্বের কারণে। এই সেতু বাংলাদেশের সামর্থ্য ও সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে এটি যেমন সত্য, তেমনি এটিও অবধারিতভাবেই সত্য যে এই সেতু বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে থাকবে। পদ্মার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এই সেতু বলবে যে সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আমরা কখনো আপস করিনি। আর এখানেই আমার গৌরব, এখানেই আমার অহংকার, এখানেই আমার আবেগ।
সারাবাংলা/আইই