Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দৃশ্যমান শত্রু মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ কেন ব্যর্থ হবে?

বিভুরঞ্জন সরকার
২২ জুন ২০২২ ১৯:২৭

গত দুই বছর এবং এ বছর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে। গত দুই বছর ছিল করোনার প্রকোপ। এবার দেশের এক বিরাট এলাকা বন্যা কবলিত। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। তার ওপর আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন। সব মিলিয়ে ক্ষমতাসীন দলের জন্মদিন ঘটা করে, জৌলুশের সঙ্গেই পালন করার কথা।

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেওয়ার পর থেকে দলটি এ দেশের মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক লড়াইয়ে নিয়োজিত রয়েছে। এই দলের বিরুদ্ধে, দলের রাজনৈতিক অবস্থান ও কৌশলের বিরোধিতা করেছে প্রতিষ্ঠিত অন্য প্রায় সব দল। দেশের মানুষ অবশ্য আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছে, বিশেষ করে পাকিস্তান কালপর্বে।

আওয়ামী লীগকে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত অবদান সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাকে যতই জনগণের সামনে শত্রু বা ভিলেন বানানোর চেষ্টা করেছে, তাকে বারবার কারাগারে নিয়েছে, বিনাবিচারে আটক রেখেছে, দেশের মানুষ ততই তাকে আপনজন ভেবেছে, নায়ক হিসেবে গ্রহণ করেছে। যারা শেখ মুজিবকে গুরুত্বহীন করে তোলার চেষ্টা করেছে, মানুষের কাছে তারাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। শেখ মুজিবের হাত ধরেই আওয়ামী লীগের উত্থান হয়েছে, আবার আওয়ামী লীগও দলগতভাবে শেখ মুজিবকে সহযোগিতা দিয়েছে, বড় করে তুলেছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়া, বঙ্গবন্ধু হওয়া, সত্তরের নির্বাচনে অভূতপূর্ব জয় এবং তারপর একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান– সবই সম্ভব করে তুলেছেন এদেশের মানুষ। বঙ্গবন্ধু যেমন মানুষের অনিঃশেষ ভালোবাসা পেয়েছেন, তেমনি তিনিও দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন, একটু বেশিই ভালোবেসেছেন। মানুষকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে তিনি রাজনীতির হিসাব-নিকাশ করেননি। রাজনীতি ছিল যার জীবন। তিনি মানুষকে বিশ্বাস-ভালোবাসার বেলায় থাকলেন বেহিসাবি। ইতিহাসের কী মারাত্মক স্ববিরোধ!

শেখ মুজিবকে জীবন দিতে হয়েছে তিনি যে দেশটি স্বাধীন করলেন সেই স্বাধীন দেশে একদল বিশ্বাসঘাতকের হাতে। তার কি কোনো বড় ভুল ছিল? তিনি কি বুঝতে পারেননি যে দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষছেন? তিনি বুঝতেন, জানতেনও। কারা তার শত্রু, কারা গোপনে অস্ত্র শান দিচ্ছে, সেসব তিনি জানতেন। বিশ্বাস করতে চাইতেন না। ভাবতেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলো। দেশের রাজনীতি চলে গেল একাত্তর-পূর্ব ধারায়।

মুজিববিহীন দেশে আওয়ামী লীগের দিশেহারা অবস্থায় এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন তারই কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। যে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছিল পঁচাত্তরের খুনি চক্র, মুজিব হত্যার প্রধান বেনিফিশিয়ারি জিয়াউর রহমান, সেই আওয়ামী লীগ কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যারা দম্ভ করে বলতো, আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, তাদের দম্ভ চূর্ণ হয়েছে। তাদের ক্ষমতায় ফেরার আশা প্রায় দুরাশায় পরিণত হয়েছে।

আওয়ামী লীগের উত্থান-পতনের সঙ্গে বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িত। এই দল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় নিশ্চিত করছে। আবার বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশের নতুন সমৃদ্ধিযাত্রা। বাংলাদেশকে আজ আর বিশ্বসম্প্রদায় দুর্যোগ-দুর্বিপাক এবং ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দেশ মনে করে না। বাংলাদেশ আজ আত্মশক্তিতে বলীয়ান মর্যাদা সম্পন্ন একটি দেশ। উন্নয়ন সহায়ক দেশ ও প্রতিষ্ঠানের অন্যায় চাপ, পরামর্শ উপেক্ষা করার সাহসও বাংলাদেশ অর্জন করেছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, মেট্রোরেলসহ যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, তা কার্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম বাংলাদেশেরই ছবি। এক সময়ের সাহায্য-নির্ভর বাংলাদেশ এখন অন্যদেশের সাহায্যে এগিয়ে যাচ্ছে।

তারমানে কী বাংলাদেশের কোনো সমস্যা নেই? আওয়ামী লীগ যা করছে, সব ভালো? না, তা অবশ্যই নয়। আওয়ামী লীগের ভেতরেও নানা সংকট আছে। সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে আদর্শের সংকট। আওয়ামী লীগ যে গণতন্ত্র ও উদারতার জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, অন্যদের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল করে তুলেছে, সেখানে এখন তৈরি হয়েছে ফাটল। আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতাই এখন প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে।

এ কথা ঠিক, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে দেশ ও দেশের মানুষের দুর্দশা-দুর্গতি বাড়ে। সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদী রাজনীতি ফণা তোলে, আবার এটাও অসত্য নয় যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য যে নীতিহীন আপসকামী ভূমিকা নিচ্ছে, সেটা আসলে দেশের আত্মশক্তি দুর্বল করার কাজও করছে। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতি-অনৈতিকতা শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের ভাবমূর্তিতে কালিপা লেপন করছে। মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। আওয়ামী লীগের শক্তির উৎস জনগণ। তাই যেকোনো মূল্যে জনগণের মধ্যে আস্থা ধরে রাখার কাজে আওয়ামী লীগকে সফল হতেই হবে।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি, আর আমি পাইছি চোরের খনি’। সেই চোরাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এখন তো তাদের বারবাড়ন্ত অবস্থা। এদের নিয়ন্ত্রণে শেখ হাসিনাকে শক্ত হতেই হবে। সৎ ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে দল এবং সরকারকে ঢেলে সাজাতে না পারলে বিপর্যয় হতে পারে।

আওয়ামী লীগ তিয়াত্তরে পা দিচ্ছে। এটা আশার কথা। আবার আশঙ্কারও কথা। বাংলা ভাষায় ‘বাহাত্তুরে পাওয়া’ বলে একটা কথা আছে। এর অর্থ ইতিবাচক নয়। আভিধানিক অর্থ হলো: বার্ধক্য হেতু দৈহিক শক্তি ও বুদ্ধি লোপ পেয়েছে এমন, অথবা ভীমরতিগ্রস্ত। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে এখনও বয়সের ভারে নত হয়নি। সময়ের দাবি বা প্রয়োজন পূরনে আওয়ামী লীগ কখনো ব্যর্থ হয়নি। দেশের যেকোনো সংকটকালে যখনই প্রশ্ন এসেছে, আওয়ামী লীগ সংকট মোকাবিলায় সক্ষমতা দেখাতে পারবে তো?

আওয়ামী লীগ কিন্তু পেরেছে। আওয়ামী লীগ পেরেছে বলেই অন্যরা হেরেছে। অন্যরা হেরেছে বলে দেশের কোনো ক্ষতি হয়নি। দেশের হৃদপিণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগ। হৃদপিণ্ড উপড়ে নিলে যেমন মানুষ বাঁচে না, তেমনি আওয়ামী লীগও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হেলাফেলা করলে বাংলাদেশেরও কার্যত নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীরা টানা ক্ষমতায় আছে। কিন্তু দেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন নানা কারণে উঠছে। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ডাক্তারের অভাবে, ওষুধের অভাবে, মানুষ অকালে মরে যায়; তবুও বলবে সময় হয়ে গেছে। আল্লা তো অল্প বয়সে মররার জন্য জন্ম দেয় নাই। শোষক শ্রেণী এদের সমস্ত সম্পদ শোষণ করে নিয়ে এদের পথের ভিখারি করে, না খাওয়াইয়া মারিতেছে। না খেতে খেতে শুকায়ে মরছে, শেষ পর্যন্ত না খাওয়ার ফলে বা অখাদ্য খাওয়ার ফলে কোনো একটি ব্যারাম হয়ে মরছে, বলে কিনা আল্লা ডাক দিয়েছে আর রাখবে কে? গ্রেট বৃটেন, রাশিয়া, জার্মানি, আমেরিকা, জাপান এই সকল দেশে তো কেহ শোনে নাই –কলেরা হয়ে কেহ মারা গেছে?’

‘কলেরা তো এসব দেশে হয় না। আমার দেশে কলেরায় এত লোক মারা যায় কেন? ওসব দেশে তো মুসলমান নাই বললেই চলে। সেখানে আল্লার নাম লইবার লোক নাই একজনও, সেখানে আল্লার গজব পড়ে না। কলেরা, বসন্ত, কালাজ্বরও হয় না। আর আমরা রোজ আল্লার পথে আজান দিই, নামাজ পড়ি, আমাদের ওপর গজব আসে কেন?’
-এই প্রশ্ন তোলার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু কি আমাদের বিজ্ঞানমুখী এবং যুক্তিবাদী হওয়ার ডাক দেননি? কিন্তু আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে কি মানুষকে ধর্মমুখী করে তোলার চেষ্টা করছে না। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়। রাজনীতি থেকে ধর্মকে দূরে রাখার যে নীতি বঙ্গবন্ধু অনুসরণ করতেন, আজকের আওয়ামী লীগ কি সেই ধারায় দৃঢ় আছে? পরগাছাকে বঙ্গবন্ধু ভয় করতেন। পরগাছা রাজনীতিবিদদের প্রতি তার ছিল ঘৃণা।

কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির নানা মেরুকরণে এখন আওয়ামী লীগেও ঢুকে পড়েছে আগাছা-পরগাছা, যাদের বলা হচ্ছে হাইব্রিড, কাউয়া। দলের মধ্যে যেসব প্রাণঘাতি ভাইরাস ঢুকেছে, তাদের পরাস্ত করার সংগ্রাম শুরু করতে হবে আওয়ামী লীগকে। করোনাভাইরাস অদৃশ্য শক্তি, আওয়ামী লীগের ভাইরাস দৃশ্যমান, সহজে শনাক্ত করা সম্ভব।

অদৃশ্য শত্রুকে পরাভূত করার সংগ্রামে সফল হওয়া গেলে দৃশ্যমান শত্রু মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ সফল হবে না কেন?

লেখক: জেষ্ঠ্য সাংবাদিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

টপ নিউজ দৃশ্যমান শত্রু মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ কেন ব্যর্থ হবে? বিভুরঞ্জন সরকার মত-দ্বিমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর