Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

১৯৪৯ থেকে ২০২২: অর্জন আর অস্তিত্বে আওয়ামী লীগ

জুয়েল সরকার
২৩ জুন ২০২২ ১২:১৭

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে ৭৩ বছরে পা রেখেছে। উপমহাদেশের যে কয়টি প্রাচীন রাজনৈতিক দল আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অন্যতম। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এত দীর্ঘ সময় একটি রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা ধরে রাখা নিঃসন্দেহে অতি তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে কোনো স্বাধীন ভূখণ্ড ছিল না। আওয়ামী লীগ অতুলনীয় রাজনৈতিক গুণাবলীসম্পন্ন বিশ্বমানের একজন নেতা তৈরি করেছে। বিশ্ব রাজনীতির হাজার বছরের ইতিহাসে একটি রাজনৈতিক দলের একজন নেতার একক নেতৃত্বে মাত্র ২২ বছরের কম সময়ের মধ্যে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার কোনো দ্বিতীয় নজির নেই।

বিজ্ঞাপন

মূলত তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের চাহিদা মেটাতেই উদ্ভব ঘটেছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। রাজনৈতিক পরিস্থিতিই বাধ্য করেছিল আওয়ামী লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শোষণ ও বঞ্চনা থেকে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের মাধ্যমে বাঙালি তাদের মুক্তিলাভের আশা করেছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা এবং সীমাহীন নির্যাতনের বাইরে কিছুই দেয়নি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা। তাদের অকথ্য নির্যাতন এবং শোষণের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

বিজ্ঞাপন

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে আজকের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। শুরু দলটির নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। কারাবন্দি অবস্থায় দলের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

পরবর্তীকালে, ১৯৫৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নামে পরিবর্তন আনা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নামে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে দলটি। এই ভাবনাটি যে বঙ্গবন্ধুর ছিল, তা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনও আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তা ভাবনা করেই করেছেন।’

জন্মলগ্ন থেকেই দলটি সোচ্চার থাকে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে। নেতৃত্ব দেয় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ঐতিহাসিক ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভের মধ্য দিয়ে জাতিকে এগিয়ে যেতে নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জগতবিখ্যাত ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। শুরু হয় মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে এবং ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের মাধ্যমে এসেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়।

১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাসটা বর্তমান সময়ের মতো এতটা মসৃণ ছিল না। আওয়ামী লীগকে বিভিন্ন সময় নানা প্রতিকূলতা এবং অস্তিত্বের সংকটের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দলটি বেশ কয়েকবার মোটা দাগে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছিল। কিন্তু তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

দল প্রতিষ্ঠার মাত্র আট বছরের মাথায় সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর মতপার্থক্যের কারণে আওয়ামী লীগ প্রথম অস্তিত্ব সংকটে পড়ে ১৯৫৭ সালে। ওই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি কাগমারি সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে বিভক্ত হয়, মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যান। এদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে ভারতের এজেন্ট বলে ক্রমাগত অপপ্রচার চালাতে থাকে এবং আওয়ামী লীগ ভয়াবহ অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। কিন্তু হাল ধরে থাকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার দৃঢ় নেতৃত্বেই তখন ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

নতুনভাবে আওয়ামী লীগ ভয়াবহ সমস্যায় পড়ে ১৯৫৮ সালে। সে বছর পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দেওয়া হয়। জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার সংবিধান বাতিল, কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা বাতিল এবং রাজনৈতিক সমস্ত কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। এ সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এসব নেতাদের গ্রেফতারের পরে আওয়ামী লীগ অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। এ সময় আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। তিনি আওয়ামী লীগের গোপন বৈঠক এবং নানা রকম আলাপ-আলোচনাসহ নেতাকর্মীদের উৎসাহিত করা এবং দল পরিচালনার জন্য অর্থ জোগানসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দলকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিলেন আওয়ামী লীগের।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এক অচলায়তনের মধ্যে পড়ে গোটা বাংলাদেশ। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অস্তিত্বের সংকট তৈরি হয়। কার্যত আওয়ামী লীগ বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেওয়ার আগে আওয়ামী লীগ ছিল নানাভাবে বিভক্ত। তারপর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার পর এই দ্বিধাবিভক্তি কাটিয়ে দলকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে।

২০০১ সালে নির্বাচনে পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়ে। একের পর এক আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের হত্যার মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে বিএনপি-জামায়াত জোট। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সরাসরি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালায় ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়, নতুন সংকটে পড়ে আওয়ামী লীগ। এই সময় আওয়ামী লীগের কিছু সংস্কারপন্থী নেতা ‘মাইনাস ফর্মুলা’র মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রে মেতেছিল। অন্যান্যবারের মতো এবারও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের আন্তরিকতা এবং তাদের দৃঢ় অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ায়। সকল বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক সময় নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদৃঢ় নেতৃত্বেই পূর্ণতা পেয়েছিল আজকের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তারই নীতি-আদর্শে নৌকার হাল এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতে। আওয়ামী লীগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ যতবার অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে, ততবার আওয়ামী লীগ আরও সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের এ রাজনৈতিক বৈচিত্র্যই উপমহাদেশের অন্যান্য দলের চেয়ে তাকে আলাদা করেছে।

আওয়ামী লীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গণমানুষের প্রত্যাশা, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, এগিয়ে যাবে আমাদের সোনার বাংলা। জয় হোক গণমানুষের। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: উন্নয়নকর্মী

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

১৯৪৯ থেকে ২০২২: অর্জন আর অস্তিত্বে আওয়ামী লীগ জুয়েল সরকার মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর