Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক বিপ্লব

সজীব ওয়াফি
২৫ জুন ২০২২ ১৭:২৪

গত সপ্তাহের প্রথমদিকে মাওয়া হয়ে বরিশালে যাচ্ছিলাম। পদ্মা সেতু তখনো উদ্বোধন হয়নি। তবে হবে হবে একটা আমেজ। কাঁঠালবাড়ি ঘাটে উদ্বোধনী সমাবেশ মঞ্চ তৈরি হচ্ছিলো, তৈরি হচ্ছিলো অস্থায়ী কিছু তাবু ঘর। পাশাপাশি সমাপ্ত করা হচ্ছিলো সেতুর শেষ সময়ের দু’পাড়ের নানা রকমের প্রস্তুতি। লঞ্চযোগে যখন পদ্মা পাড়ি দিচ্ছি প্রবল স্রোতের তীব্র ধাক্কায় যে কারো ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তারউপরে যেই না মাঝ নদীতে লঞ্চ নামলো সেই মুহূর্তে ঝড় শুরু হয়েছে, আকাশেও প্রচন্ড বজ্রপাতের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। লঞ্চ একবার এদিকে কাত হচ্ছে তো আরেকবার ওদিকে কাত হচ্ছে। যাত্রীরাও এদিক সেদিক ছোটাছুটি করায় পরিস্থিতি আরো বেশি নাজুক। ঝড়-বৃষ্টি কিছুটা কমলে, মুরুব্বি গোছের মধ্যবয়স্ক টুপি পাঞ্জাবি পরিহিত সহজ-সরল এক ভদ্রলোক নিশ্বাস নিয়ে বলেই ফেললেন, “এবারেই লঞ্চে শেষ যাচ্ছি, সেতুটা হওয়ায় ঝড় তুফানের মসিবত দিয়ে অন্তত মানুষজন মুক্তি পাবে।”

ভদ্রলোক কথা শেষ করতে দেরি, কিন্তু প্রতিউত্তর পেতে মোটেও দেরি নাই। তার কথা টেনে নিয়ে দু’জন জানালো সেতু চালু হলেও তাতে নাকি সাধারণ মানুষ উঠতে দিবে না, একজন বললো সেতুর কাজই তো এখনো শেষ হয়নি, অন্য আরেকজন বললো ভারতের সুবিধার জন্য সরকার এই সেতু এতো আগ্রহ নিয়ে করেছে। অন্য একজন আবার এ সমস্ত আলাপের বিরোধীতা করে ঝগড়া শুরু করে দিলো। রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লাম যে, এ সকল আজগুবি তথ্য এরা পায় কই? এদের তথ্য দাতাই বা কারা? বিনয়ের সাথে জানতে চাইলাম ভাই জনসাধারণ যে সেতুতে চড়ে পদ্মা পার হতে পারবে না এই তথ্য কোথা থেকে শুনেছেন? জানালো সে একজনের কাছে শুনেছে, যার থেকে শুনেছে সে আবার নাকি মোবাইলে দেখেছে। এই হলো আমাদের তথ্য উৎসের আদ্যোপান্ত! কখনো শোনার শোনা, আবার কখনো গুজবের ডালপালা। অথচ আজব-গুজবে তর্কাতর্কি করা এ সকল লোকগুলোই কিন্তু কিছুক্ষণ আগে লঞ্চে পানির ধাক্কায় বিপদ আশঙ্কায় মলিনমুখো হয়েছিলো, বিপদ রক্ষার্থে স্মরণাপন্ন হয়েছিলো সৃষ্টিকর্তার।

গৌরচন্দ্রিকার মূলে প্রবেশের আগে একটু পূর্বেকার দিনগুলোতে ফেরা যাক। ২০১৪ সাল, আগস্টের প্রথম পক্ষ; পদ্মায় পানির প্রবল স্রোত এবং অস্বাভাবিক ঢেউ। ঈদের ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফেরা প্রায় আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে মাওয়াঘাটের উদ্দেশ্য রওনা করে পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। পদ্মায় পরা মাত্র উত্তাল ঢেউয়ে তলিয়ে যায় অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই ফিটনেসবিহীন লঞ্চটি। মুহূর্তেই ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে মানুষের আহাজারিতে রূপান্তরিত হয় পদ্মা পাড়। পিনাক-৬ এর আগের লঞ্চে ঢাকায় ফেরার পথে ছিলাম আমরা আত্মীয়-স্বজনসহ। পিছনে তাকিয়ে আমরা কেবল দেখেছি মানুষের বাঁচার আকুতি কেমন হয়! সত্যি বলতে সেদিন আমাদের লঞ্চও প্রায় ডুবুডুবু অবস্থা, অসহায়ের মতো পানিতে ডুবে যাওয়া অসংখ্য মানুষের মৃত্যু তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের করার কিছুই ছিলো না! তলিয়ে যাওয়া লঞ্চটির মুষ্টিমেয় সংখ্যক যাত্রী প্রাণে ফিরে আসলেও অধিকাংশেরই সেদিন সলিল সমাধি হয়েছে। অনেকের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, মেঘনা হয়ে ভেসে যাওয়া অনেকের লাশ আবার মিলেছে বরিশালের কোন উপকূলে। ভাগ্যক্রমে আগের লঞ্চে ওঠায় আমরা কেবল বেঁচে গেছি। পদ্মাসেতু নিয়ে যারা বিভিন্ন সময়ে শুধুমাত্র সমালোচনাটাই করলেন, সেতু করতে মানুষের মাথা লাগবেসহ বিভিন্ন গুজব ছড়ালেন, সেতুটা যেন না হয় সে জন্য নানান মেকানিজম করলেন; মুহুর্তেই লাশ হয়ে যাওয়া আমাদের এতোগুলো মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে আপনাদের হৃদয় কি এতটুকুও গলে না!

পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ২০০১ সালের ৪ঠা জুলাই। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে হয় উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব(ডিপিপি)। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে তৈরি করা হয় প্রথম সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব। এরপর থেকে বিতর্ক আর পিছু ছাড়েনি, আপাদমস্তক দেশি-বিদেশি তর্কে-বিতর্কে ভরপুর। রাজনীতিও হয়েছে অতিমাত্রায়, একেবারে ঠাঁসা। শুরুতে বিশ্বব্যাংক ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মত থাকলেও ঘটনাক্রমে দুর্নীতির অভিযোগ এনে অর্থায়ন করবে না বলে বিবৃতি দেয়। স্বচ্ছতা নিশ্চিতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। সময় অতিবাহিত হলে কানাডার আদালতে প্রমাণিত হয় পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোন দুর্নীতি অভিযোগের সত্যতা মিলেনি। তাহলে অর্থ বরাদ্দের এই কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা তৈরির পেছনে কি বা কে! যাহোক আত্মমর্যাদার প্রশ্নে একটা সময়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে বাংলাদেশ সরকার। বিশ্ব ব্যাংকের টানাপোড়েনে একে একে সরে দাঁড়ায় এডিবি, আইডিবি ও জাইকার মতো উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো। বিদেশ নির্ভরশীলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বাংলাদেশ। তবে মুদ্রাস্ফীতি ও নির্মাণ কাজের সময় অতিরিক্ত কাজ যুক্ত হওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্তদের তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সেতুর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সেতুর সাথে তুলনা করলে পদ্মা সেতুর তুলনামূলক ব্যয় কিছুটা বেশি এটা সত্য। তবে সেইক্ষেত্রে খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মার তলদেশের গঠনপ্রকৃতিও যে বিবেচ্য রাখতে হয়।

পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হওয়ায় যোগাযোগ ক্ষেত্রে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়কে যেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে তেমনি আর্থসামাজিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। সাথে সাথে ২ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী এলাকার জিডিপি। পদ্মা সেতুর কারণে রাজধানী ঢাকা শহরকে সম্ভব হবে বিকেন্দ্রীকরণ করতে। তৈরি হবে টাইম ভ্যালু মানির কার্যকারিতা। অধিকতর সহজ হবে কৃষিপণ্যের পরিবহন ব্যবস্থায়। সরাসরি নতুনত্ব পাবে কমপক্ষে ২১ জেলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। দূরের বরিশাল শহরে পৌছাবে গ্যাস এবং অপটিক্যাল ফাইবার লাইন। আরো খানিকটা অপেক্ষার পরে হয়তো ট্রেন ছুটবে পশ্চিমের দিগন্তে। কলকারখানা, স্কুল কলেজ, পর্যটন; মোটাদাগে বিশ্বায়ন এবং শিল্পায়নের পুর্নাঙ্গ রূপ দেখবে দক্ষিণের জনগণ। কর্মসংস্থানের প্রসার ঘটবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর। অথচ পূর্ববর্তী দিনগুলোতে যেই শরিয়তপুর-মাদারীপুরের অর্থনীতি ছিলো অত্যন্ত ভঙ্গুর, অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিলো অবহেলিত; পরিচিত পেতো চরাঞ্চল এবং দেশের সবচেয়ে বেশি নদীভাঙ্গন এলাকা হিসেবে। অন্যদিকে দেশের অন্যতম মংলা এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর পুরোদমে চালু হওয়াও নির্ভর করছে পদ্মা সেতুর ওপর। সব চেয়ে বড় কথা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রমত্তা পদ্মায় আমাদের আর নামতে হচ্ছে না, থাকছে না কোন আত্মীয় স্বজন হারানোর ভয়।

পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন থাকতে পারে। বিরোধীতা থাকতে পারে টোল এবং ভাড়া নির্ধারণের পরিমাণ নিয়ে। কিন্তু এই স্থাপনা নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কারো নূন্যতম কোন প্রশ্ন থাকার কথা নয়। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার এবং প্রতিবেশ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে যারা বিভিন্ন সময়ে এই নির্মাণযজ্ঞের বিরোধীতা করেছেন অথবা করছেন বা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তা কেবল বাতুলতা। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা যে অনেকাংশে বেড়েছে এ কথা স্বীকার করতেই হবে। পদ্মা সেতু হয়তো ৪২টি পিলারের উপরে দাড়ানো একটি নির্মাণ স্থাপনা, কিন্তু নানান চড়াই-উৎরাইয়ে সব চেয়ে বৃহৎ যে পিলারটির উপরে গিয়ে ঠেকেছে তা হলো বাঙালির আত্মবিশ্বাস, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি।

ভালো কিছুর বিপরীতে সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া চিরাচরিত নিয়ম। সেই দিক থেকে পদ্মা পাড়াপাড়কে কেন্দ্র করে যাদের জীবন-জীবিকা চলতো তারা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সেই সকল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসন করার আহ্বান থাকবে। এমনকি সিলেটের বন্যা কিংবা চট্টগ্রামে রাসায়নিক ডিপোর আগুন যেমন দুঃসহ তেমনি মর্মান্তিক; পাশাপাশি অগ্রগতির কাঙ্ক্ষিত যাত্রাও উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ থেকে এই যাত্রা শুরু হয়ে বয়সের দিক থেকে আজ পঞ্চাশ বছরে অতিক্রান্ত। এবার কেবল আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করার প্রহর। দক্ষিণের সড়কে সেই হুইশেলই বাজছে, সড়ক যোগাযোগের বৈপ্লবিক হুইশেল। শত প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর এই স্পৃহা থেকেই সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন—

“সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।।”

লেখক: প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

পদ্মা সেতু: সড়ক বিপ্লবে দক্ষিণাঞ্চল মত-দ্বিমত সজীব ওয়াফি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

আইভরি কোস্টে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৩
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৪০

সম্পর্কিত খবর