Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দূর হোক চিত্ত ও বোধের দারিদ্র্য

শেখ ফয়সল আমীন
২৯ জুন ২০২২ ২৩:৪৫

ভাইরাল শব্দের আদি-অর্থ বিষপূর্ণ/দূষিত/বিষাক্ত। তবে ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটারের যুগে শব্দটির নতুন একটি অর্থ আধুনিক অভিধানসমূহে যুক্ত হয়েছে। সেটি হচ্ছে দ্রুত প্রচারিত হওয়া। বিশদভাবে বললে, কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি অন্তর্জালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্য দিয়ে একজন থেকে বহুজনের কাছে দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যাওয়া, যা তৎক্ষণাৎ সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে, একটি প্রভাব বিস্তার করে। গত অর্ধযুগে তরুণ এবং মধ্যবয়সী নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে ভাইরাল হওয়ার প্রবল প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সবাই যে নেতিবাচক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করছে তা নয়। তবে ভালোর উদাহরণ কম, খারাপেরই বেশি। ‘দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য’ প্রবাদের মতোই এই ট্রেন্ডের ভেতরে কিছু মাঙ্গলিক দৃষ্টান্ত থাকলেও এটি প্রতিরোতব্য। কেননা, ভাইরাল হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় দিন দিন তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ সামাজিক-বিষে পরিণত হচ্ছে। জীবন উন্মোচন বা সৌন্দর্যসৃষ্টি তাদের লক্ষ্য নয়, তাদের লক্ষ্য সামাজিক ও জাতিসাত্ত্বিক সংকট সৃষ্টি করা। নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে চরমভাবে চ্যালেঞ্জ করা।

বিজ্ঞাপন

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ও তার পরের দিনে এ-সেতুকেন্দ্রিক কিছু ঘটনা আমাদের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক গঠনধারা ও বিকাশ বিষয়ে দুর্ভাবনায় ফেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশের যে নেতিবাচক সৃজন তা প্রতিনিয়ত অশনিবার্তা বহন করছে। সভ্যতা, ভদ্রতা, শিষ্টাচার এই মানবিক গুণাবলি আজ চরম অস্তিত্ব সংকটে। চিত্তের ঐশ্বর্যই পারে জীবনযাত্রার চরিত্র বাঁচাতে। সেজন্য প্রয়োজন মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠা।

বিজ্ঞাপন

উদ্বোধনী দিনের একটি দুঃখজনক ঘটনা গণমাধ্যমের কল্যাণে চোখে পড়ল। সেখানে দেখা গেল, পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা বেষ্টনী (স্টিলের নেট) ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে এবং সেখান দিয়ে উৎসুক জনতা অবাধে সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করছে এবং বের হচ্ছে। তাদের এমন কাজের কারণ জিজ্ঞাসা করতেই গণমাধ্যমকে তারা উত্তর দিচ্ছে যে, পদ্মা সেতুর আনন্দে, খুশিতে তারা এমন আচরণ বা কাজ করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করে, সৌন্দর্যকে বিলীন করে এ-কেমন আনন্দ-উল্লাস! এ-কেমন খুশির প্রকাশ! এখানে তাদের নাগরিক দায়িত্ববোধটুকুইবা কোথায়? কবে জাগ্রত হবে? আর কত এই নিয়ম ভাঙার ছল? দেশ উন্নত হচ্ছে, দেশের অবকাঠামো শক্তিশালী হচ্ছে, সেবা ও সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবুও আমরা কেন আত্মসত্তার উন্নয়নে দিন দিন পশ্চাদগামী? আমাদের আচরণগুলো কেন সুনাগরিকের বৈশিষ্ট্য বহন করে না? টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে নাগরিক হিসেবে আমাদেরও তো কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।

ঘটনাটি দ্বিতীয় দিনের। দেখলাম একজন ব্যক্তি পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা রেলিং-এর নাট-বোল্ট থেকে নাট খুলছে এবং ভিডিও করছে। নাট-বোল্টের কাজ এবং মেকানিজম বোঝার জন্য সার্টিফিকেটধারী ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার প্রয়োজন নেই। খুবই সিধে কথায়, যদি আপনি ক্লক ওয়াইজ ঘুরান নাট লাগবে এবং যদি এন্টি-ক্লক ওয়াইজ ঘুরান নাট খুলবে। তাছাড়া নাট-বোল্ট যেখানে লাগানো হয় সেখানে ঝালাই বা স্থায়ী কোনো এডহেসিভ প্রয়োগ করা হয় না। কেননা যেকোনো সময়, যেকোনো প্রয়োজনে এটি খোলা লাগতে পারে বা লাগে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই নাট-বোল্ট খুলে বায়জিদ নামের আপাদমস্তক প্রকৌশল-নিরক্ষর ব্যক্তিটি কী বোঝাতে চাইলো? আর তার এই ভিডিও দেখে তার ছন্দে যারা নাচলো তাদের জ্ঞানবুদ্ধির দৌড় কতদূর? তারা কি রাষ্ট্র, সমাজ তথা সমাজের সাধারণ মানুষের জন্য আদৌ কল্যাণকর নাকি ভয়ংকর? এরা দেশ ও সমাজের সম্পদ নাকি বোঝা? এদের অশুভ ছায়া থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখতে আইনের প্রয়োজন নাকি বোধ ও বিবেকের?

দ্বিতীয় দিনের আরেকটি ঘটনা। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত পৃথক দুইটি ছবিতে দেখা গেছে তিনটি ছেলে পদ্মা সেতুতে প্রস্রাব করছে। কী অসভ্যতা! কী পারিবারিক শিক্ষার অভাব! কী কাণ্ডজ্ঞানহীনতা! এদের মাতৃ-পিতৃ পরিচয় কী? এরা কোন স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করেছে? এরা কোন সমাজে বেড়ে উঠেছে? এদের কান টেনে ধরে জিজ্ঞাসা করার কেউ কি নেই? কেউ কি বলতে পারে না, এই নির্লজ্জ তোর লজ্জা কই? তোর বিবেক কই? তোর বোধ কই? এদের সুশিক্ষাহীনতা, বিবেকহীনতা, নির্লজ্জতা একটি প্রজন্মকে আজ অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিচ্ছে। মনে শঙ্কা জাগে উন্নত, পরিচ্ছন্ন, আধুনিক ও সুন্দর আগামীর বাংলাদেশে এদের ভূমিকা কী হবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনভর শ্রম ও সাধনায় নির্মিত উদীয়মান বাংলাদেশে এরা জগদ্দল পাথরের মতো সমাজের ঘাড়ে চেপে বসে থাকবে না তো?

পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির নীল, কালো, হলুদ রঙের আগ্রাসনে বাঙালি সংস্কৃতির লাল-সবুজ বর্ণ ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। বাঙালিয়ানার শ্বেত-শুভ্রতা হারাচ্ছে স্বকীয়তা। আজ টিকটক, লাইকির উন্মাদনায় ভাসছে সমাজের একটি অংশ। পদ্মা সেতুও রক্ষা পায়নি এইসব টিকটক, লাইকিবাহিনীর কবল থেকে। মানুষের অসুস্থ ও অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, বিকারগ্রস্ত আচরণ সবই দেখল পদ্মা সেতু তার দুই দিনের জীবনযাত্রায়। প্রশ্ন হচ্ছে, পদ্মা সেতু কি কোনো পিকনিক স্পট? এটি কি কোনো শুটিং স্পট? নাকি দেশের সর্বাধুনিক র‍্যাপিড ট্রানজিট, যাকে ঘিরে বোনা হচ্ছে সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার স্বপ্ন? সড়ক কিংবা সেতু সবক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট চলাচল ও পরিবহন নীতিমালা রয়েছে, আইন রয়েছে। আমাদের মধ্যে আইননিষ্ঠতা কই? যখন পদ্মা সেতুর দিকে সারা পৃথিবীর গণমাধ্যম, রাষ্ট্রপ্রধান ও সংস্থাপ্রধানরা তাকিয়ে ছিলেন, তখন আমরা নাগরিকরা কী করছিলাম? টিকটক করছিলাম? ১০৫ কিলোমিটার বেগে বাইক ছুটচ্ছিলাম? ভাড়ায় বাইক চালিয়ে পকেট ভরছিলাম? ব্রিজের ডিভাইডারে কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছিলাম? পিকআপে করে খিচুড়ির ডেক নিয়ে এসে পিকনিক করছিলাম? বিশ্বকে আমরা কী বার্তা দিলাম? আমরা কতটুকু সভ্য হলাম?

লেখক: কর্মকর্তা, বাংলা একাডেমি

সারাবাংলা/আইই

পদ্মা সেতু

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর