ড. ইউনূসের বিবৃতি অসত্য এবং বিভ্রান্তিমূলক
৩০ জুন ২০২২ ১৭:৩৯
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাক্তন এমডি ড. ইউনূসের পক্ষে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠানো হয়েছে। এতে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত আইনের নানা ভুল ব্যাখ্যা এবং অসত্য তথ্য দেয়া হয়।
গ্রামীণ ব্যাংক কোন বেসরকারি ব্যাংক নয়, এটি একটি statutory public authority বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ/প্রতিষ্ঠান। সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ বলতে সে সকল প্রতিষ্ঠানকে বুঝায়, যে প্রতিষ্ঠান কোন নির্দিষ্ট আইনের দ্বারা সৃষ্ট এবং আইনে উল্লেখিত বিধানাবলীর আলোকে ঐ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়।
গ্রামীণ ব্যাংক ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারিকৃত অর্ডিন্যান্স The Grameen Bank Ordinance, 1983( Ordinance NO. XLVI OF 1983 ) এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। আইনটির ধারা ২ তে বলা আছে, আইনটি সেসব গ্রামীণ এলাকায় কার্যকর হবে, যে সকল এলাকা সরকার কর্তৃক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।
১৯৮৩ সালের আইনের ধারা ৪(৪) এ বলা আছে, সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ব্যাংক কোম্পানিজ আইন অথবা ব্যাঙ্ক কোম্পানিজ সম্পর্কিত অন্য কোন আইনের কোন বিধান গ্রামীণ ব্যাংকে প্রয়োগ করতে পারবে।
এই আইনের ধারা ৩ অনুযায়ী আইনটি একটি বিশেষ আইন। কারণ এই আইনের ধারা ৩ এ এই আইনের প্রাধান্য (overridding clause) রয়েছে। ধারা ৩ এ বলা হয়েছে, অন্যান্য আইনে বিধানাবলী যা-ই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধান কার্যকরী হবে।
৬০ বছরের বেশি বয়সে গ্রামীণ ব্যাংকার দায়িত্বে থাকা প্রসঙ্গে ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘গ্রামীণ ব্যাংক এমন একটি ব্যাংক যার ৭৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক এর ঋণগ্রহীতারা। একটি আলাদা আইনের মাধ্যমে কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য সন্নিবেশ করে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ফলে অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে এর পার্থক্য আছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয় এর পরিচালনা পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে একটি চুক্তির অধীনে। এই নিয়োগের জন্য কোনও বয়সসীমা আইনে বা পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে উল্লেখ ছিল না।’
ব্যাংকের পেইড-আপ ক্যাপিটাল বা পরিশোধিত শেয়ার মূলধনের ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহীতারা এর কত ভাগ মালিক, এর সাথে ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) পদে নিয়োগ কিংবা ঐ পদের মেয়াদের কোন সম্পর্ক নেই। এমডি পদে নিয়োগ এবং পদের মেয়াদের ক্ষেত্রে একমাত্র আইনের বিধানই প্রযোজ্য হবে। অন্যান্য ব্যাংকের সাথে গ্রামীণ ব্যাংকের যে পার্থককের কথা বলা হচ্ছে, ব্যাংকের এমডি’র চাকুরীর মেয়াদের সাথে এই পার্থককের কোন সম্পর্ক নেই। বরং সকল সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের মতো গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদটি একটি পূর্ণকালীন চাকুরীর পদ এবং উক্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদটি অন্যান্য সকল ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদের মতো মেয়াদ ভিত্তিক ও অপূর্ণকালীন।
ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয় এর পরিচালনা পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে একটি চুক্তির অধীনে। এই নিয়োগের জন্য কোনও বয়সসীমা আইনে বা পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে উল্লেখ ছিল না।’ এই বক্তব্য অসত্য। কারণ ১৯৮৩ সালের গ্রামীণ ব্যাংকের অর্ডিন্যান্স এর ধারা ১৪(১) অনুযায়ী এই ব্যাংকের এমডি’র নিয়োগ চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমডি পদে প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য একটি সিলেকশন কমিটি থাকে এবং সেই বাছাইয়ের ভিত্তিতে ব্যাংকের বোর্ড এমডি নিয়োগ করে। এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যানও নিয়োগ করে সরকার। গ্রামীণ ব্যাংক একটি সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান বলেই আইনে এই নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতেই রাখা হয়েছে।
১৯৮৩ সালের গ্রামীন ব্যাংক আইন অনুযায়ী ব্যাংকের এমডি পদটি একটি সার্বক্ষণিক পদ এবং তিনি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী (সিইও) । আইনের ধারা ৯ (২) অনুযায়ী এমডি পদাধিকার বলে ব্যাংকের পরিচালক, তবে এমডি বোর্ডে ভোট প্রদান করতে পারবেন না। আইনের ধারা ১০(২) অনুযায়ী কোন কারণে চেয়ারম্যানের পদ শুন্য হলে সরকার এমডি ছাড়া অন্য যেকোনো পরিচালককে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে।
আইনের উল্লিখিত বিধানাবলী পড়লে এটি পরিষ্কার যে, গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদটি একটি সার্বক্ষণিক চাকুরী। যেকোনো সার্বক্ষণিক পদের একটা মেয়াদ থাকে l ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশে এমডি পদের অবসরের সময়সীমা উল্লেখ না থাকলেও এটি নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের রয়েছে।
কারণ ১৯৮৩ সালের আইনের ধারা ৪(৪) এ বলা আছে, সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ব্যাংক কোম্পানিজ আইন অথবা ব্যাংক কোম্পানিজ সম্পর্কিত অন্য কোন আইনের কোন বিধান গ্রামীণ ব্যাংকে প্রয়োগ করতে পারবে। সরকারের এই ক্ষমতা প্রয়োগ করা ছাড়াও Interpretation of Statutes এর সাধারণ নীতি অনুযায়ী দেশের অভ্ভন্তরে অন্যান্য ব্যাংকের এমডি পদের মেয়াদের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি’র চাকুরীর মেয়াদ ধরতে হবে। অন্যান্য সকল ব্যাংকে এই মেয়াদ তখন ছিল ৬০ বছর। এছাড়া সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২(১) তে আইনের যে সংজ্ঞা আছে, তাতে প্রথা বা রীতি-কেও আইন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ফলে অন্যান্য ব্যাংকের চাকুরীর বিধান প্রথা হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
গ্রামীণ ব্যাংকের আইন এর ধারা ৮ (২) অনুযায়ী ব্যাংক তার কার্যাবলী পরিচালনার ক্ষেত্রে সবসময়ই জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিবে। এই বিধানের আওতায় ব্যাংকটির প্রতিটি কাজ ও সিদ্ধান্তে সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি প্রয়োজন।
এছাড়া, The General Clauses Act 1897-এর বিধান অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডি এবং নিয়োগকৃত পরিচালকদের নিয়োগ সরকার বাতিল করতে পারে। কারণ General Clauses Act 1897-এ বলা আছে, যে কর্তৃপক্ষ নিয়োগ প্রদান করতে পারে, সেই একই কর্তৃপক্ষ নিয়োগ বাতিল করতে পারে।
ড. ইউনূসের বিবৃতিতে পদ্মা সেতু নিয়ে তার পক্ষ থেকে কোন ধরণের প্রভাব বিস্তার করা হয়নি মর্মে যে দাবী করা হয়, এই বিষয়ে ড. ইউনূসের কাছে বাংলাদেশের জনগনের প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট ফার্মের মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কেন খরচ করেছিলেন? যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট ফার্ম তিনি কেন নিয়োগ করেছেন- এটি বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ জানে।
লেখক: রাজনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ড. ইউনূস ড. ইউনূসের বিবৃতি অসত্য এবং বিভ্রান্তিমূলক ড. সেলিম মাহমুদ মত-দ্বিমত