Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কিশোর অপরাধীদের বিচার ও ফেরানোর উপায়

রাজন ভট্টাচার্য
১ জুলাই ২০২২ ১০:৫১

এক কিশোর, যার বয়স মাত্র ১৪ বছর; সে এত ভয়ঙ্কর হতে পারে? একটি মোবাইল ফোনের জন্য পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় সে প্রথমে বন্ধুকে খুন করে, লাশ গুম করার চেষ্টা করে। এরপর মোবাইল বিক্রির টাকায় হোটেলে বান্ধবিকে নিয়ে সময় কাটানো। এখানেই শেষ নয়, বন্ধুকে ফোনে ডেকে এনে বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটানোরও সুযোগ করে দিয়েছে সে। তারপর মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় খুনী কিশোরকে টঙ্গী থেকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। -বলছি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার ১৪ বছরের স্কুলছাত্র থেকে হত্যাকারী বনে যাওয়া কিশোরটির কথা। বগুড়া পুলিশ সুপারের সংবাদ সম্মেলন শেষে গত ২৮ জুন বিকালে প্রথমে খবরটি বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যমে আসে। প্রকাশিত সংবাদে হত্যাকারী কিশোরের নাম প্রকাশ করা হয়নি!

বিজ্ঞাপন

খুনের সমস্ত ঘটনা বিচার বিশ্লেষণ করে কি কারো মনে হবে এটা শিশুর কাজ? কোন শিশুর পক্ষে এ ধরণের ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটানো সম্ভব। আদতে তাই হয়েছে। তাই পুরো বিষয়টি ভাবতেই অবাক লাগে। আইনের দৃষ্টিতে সে শিশু, কিন্তু মেধা বা বুদ্ধি বিবেচনায় একজন পরিপক্ক মানুষের চেয়ে এগিয়ে। এমনকি ভয়ঙ্করও। যদিও গত কয়েক বছরে দেশে শিশুরা অনেকগুলো ভয়াবহ ঘটনার জন্ম দিয়েছে। যা রীতিমতো গা শিউরে ওঠার মতো। এর মধ্যে কিশোর গ্যাং কালচার সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক ও আতঙ্কের নাম। গ্যাং কালচার নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও হিমশিম খাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

গত ২৭ জুন সকালে সভারের এনাম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার এঙ্গেলদানি গ্রামের মৃত অজিত সরকারের ছেলে উৎপল কুমার সরকার (৩৫)। তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের কলেজ শাখার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। গত ২৫ জুন দুপুরে ওই স্কুলমাঠে শিক্ষককে স্ট্যাম্প দিয়ে বেধড়ক মারধর করে একজন শিক্ষার্থী। পুলিশ বলছে, নিহত উৎপল কুমার সরকার প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি থাকায় নিয়ম-কানুন মানাতে শিক্ষার্থীদের শাসন করতেন। তিনি ওই শিক্ষার্থীকেও শাসন করায় এ ঘটনা ঘটায়। স্থানীয়রা বলছেন, অভিযুক্ত দশম শ্রেণীর ঐ শিক্ষার্থী এলাকার কিশোরদের নিয়ে একটি ‘কিশোর গ্যাং’ পরিচালনা করে। মেয়েদের উত্যক্ত করার অভিযোগে কলেজে একাধিকবার তার বিচারও হয়েছে। নানা ঘটনার পর হত্যাকারী এই কিশোর গ্রেফতার হয়েছে। জানি না শেষ পর্যন্ত তার সুষ্ঠু বিচার হবে কিনা?

গত মঙ্গলবার বগুড়ায় বন্ধুর হাতে বন্ধু খুনের ঘটনা উল্লেখ করে পুলিশ সুপার বলেন, ‘গ্রেফতার হওয়া কিশোর পড়াশোনা না করলেও নওফেল ছিল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা দাড়িগাছা গ্রামের বিভিন্ন জঙ্গলে গিয়ে মাঝেমধ্যেই ধূমপান করতো। দুই মাস আগে জমি বিক্রি করে ১৮ হাজার টাকায় একমাত্র ছেলে নওফেলকে স্মার্টফোন কিনে দেন বাবা। এরপর থেকেই নওফেলের ফোনটি হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে তার বন্ধু।’ পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘১৮ জুন নওফেলের জন্মদিন ছিল। এদিন বেলা ১১টার দিকে নওফেলকে ধূমপানের কথা বলে কৌশলে জঙ্গলে নিয়ে যায় তার ওই বন্ধু। জঙ্গলের একটি ইউক্যালিপটাস গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে ধূমপানের সময় নওফেলের গলায় মাফলার পেঁচিয়ে গাছের সঙ্গে ফাঁস দেয় বন্ধু। নওফেল নিস্তেজ হয়ে পড়লে তার বন্ধু পাশের জমি থেকে একটি বাঁশের খুঁটি এনে নওফেলের মাথায় আঘাতে করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর মরদেহ গভীর জঙ্গলে ফেলে দিয়ে মোবাইল সেটটি নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।’

‘এরপর ওই কিশোর বগুড়ার শেরপুর থেকে তার এক বান্ধবীকে শহরে ডেকে নেয়। দুজন একত্রে নিজেদের ভাই- বোন পরিচয় দিয়ে শহরের সাতমাথায় একটি দোকানে ৫ হাজার টাকায় মোবাইল ফোনটি বিক্রি করে। সেখান থেকে তারা দুজন বগুড়া শহরের গালা পট্টির একটি আবাসিক হোটেলে গিয়ে একটি রুম ভাড়া করে। সেখানে বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটিয়ে তাকে দেড় হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করে।’ হত্যাকাণ্ডের দু’দিন পর ২০ জুন বিকেলে জঙ্গল থেকে দুর্গন্ধ বের হলে স্থানীয় লোকজন গিয়ে নওফেলের মরদেহ শনাক্ত করে। এরপর থেকেই তার বন্ধু পলাতক ছিল। উদ্ধার হওয়া ফোনের সূত্র ধরে আটক করা হয় নিহতের বন্ধুর কথিত বান্ধবীকে। পরে পুলিশের একটি দল নিহতের বন্ধুকে ঢাকার টঙ্গী থেকে গ্রেফতার করে।’

ঘটনা বিশ্লেষণ করলে কি কারো মনে হওয়ার সুযোগ আছে, এটি কোনো শিশুর কাজ! বড় বড় অপরাধের ক্ষেত্রেও এত বিচক্ষণতা দেখা যায় না। তাহলে এই শিশুর বিচার দাবি করা কি অন্যায় হবে? কিশোরটি যদি সামান্য একটি ফোনের জন্য বন্ধুকে হত্যার এত বড় পরিকল্পনা সফল করতে পারে, তাহলে তার মেধা বুদ্ধি কোন অবস্থাতেই অপরিপক্ক হতে পারে না। সেতো এ ও বোঝে এটি অপরাধ। অপরাধ করলে বিচার হয়। এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। সবকিছু বুঝেশুনে সে যদি খুন করতে পারে; তাহলে তার বিচার দাবি করা কী অন্যায় হবে?

মনে আছে তো ঐশীর কথা। ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে তাদের ১৭ বছর বয়সী মেয়ে ঐশী রহমান একাই খুন করে। এ ঘটনা নিয়ে সারাদেশে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়। শুধু ঐশীই নয়, আমাদের দেশসহ বিশ্বব্যাপী কিশোর অপরাধীদের দ্বারা সংঘটিত ভয়ংকর অপরাধের সংখ্যা আশংকাজনকহারে বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিশোরদের এরকম ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনার পর তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে স্বীকার করেছে বিদেশী অপরাধ বিষয়ক সিরিয়াল দেখেই তাদের মাথায় এ ধরণের পরিকল্পনা আসে। এর মধ্যে ক্রাইম পেট্রোল, সিআইডি অন্যতম। বিদেশী টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচার করা এ ধরণের অনুষ্ঠান দর্শকপ্রিয় হওয়ায় আমাদের দেশেও এখন অনেক টিভিতে অপরাধ বিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে। অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে তো কোনকিছু চাপিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে শিশু কিশোরদের হাতে চলে যাচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির মোবাইল সেট। আর টেলিভিশনের পর্দা তো উন্মুক্ত!

প্রশ্ন হলো বয়সের কারণে একজন শিশু বা কিশোর তো তার স্বভাবসুলভ কাজটি করছে না। সে ভয়ঙ্কর পথে পা বাড়িয়েছে। এই সর্বনাশা পথ নিজেকে যেমন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তেমনি সঙ্গদোষে তার সঙ্গে অনেকেই অন্ধকার পথে আসছে। পরিবারও পথে বসছে। অথচ শিশু-কিশোররা এরকম বেপরোয়া পথে যাচ্ছে কী একদিনেই। এজন্য কি পরিবারের কোন দায় নেই? যদিও কিশোর অপরাধ বাড়ার পেছনে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নেশাসহ নানাবিধ কারণ রয়েছে। প্রশ্ন হলো কারণ যাই থাক না কেন, অপরাধী হওয়ার আগেই বিপজ্জনক পথ থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হবে। তেমনি তারা যেন নষ্ট জগতে পা না রাখতে পারে সেজন্য সতর্ক দৃষ্টি রাখার বিকল্প নেই। এজন্য অভিভাবক থেকে শুরু করে সমাজের সবার অংশগ্রহণ জরুরি।

আমাদের দেশে শিশুদের সুরক্ষার জন্য ‘শিশু আইন, ২০১৩’ নিয়ে জটিলতা রয়েছে। এই আইনের বিভিন্ন ধারাকে কিশোর অপরাধ দমনে অন্তরায় মনে করা হচ্ছে। প্রথম শিশু আইনটি ছিল ‘বেঙ্গল চিলড্রেনস অ্যাক্ট, ১৯২২’। সেটি রহিত করে হয় ‘শিশু আইন, ১৯৭৪’। সম্প্রতি সেটি রহিত করে কিছু পরিবর্তনসহ ‘শিশু আইন, ২০১৩’ প্রণীত হয়েছে। আইনে ‘শিশু’র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে অনূর্ধ্ব-১৮ বছর পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু গণ্য হইবে।’ আইনটির মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কল্যাণ এবং শিশু অপরাধীদের বিচার। ‘পেনাল কোড, ১৮৬০’-এর ৮২ ধারামতে ৯ বছর পর্যন্ত কোনো শিশু অপরাধ করতে পারে না। ৮৩ ধারামতে, ‘৯ বছরের অধিক এবং ১২ বছরের নিচের কোনো শিশু কর্তৃক কৃত কোনো কর্ম অপরাধ হবে না, যদি মনে করা হয় কর্মটি যে অপরাধ, উহা অনুধাবন করার মতো পর্যাপ্ত মানসিক পরিপক্বতা শিশুটির ছিল না।’

যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর অপরাধীদের বেশিরভাগই ১২ বছরের বেশি। ৯ বছর অতিক্রম করে শিশুটি কিশোর হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত সে অপরিপক্ব কিশোর গণ্য হতে পারে। এ কারণেই ১৯৭৪ সালের শিশু আইনে ‘চাইল্ড অফেন্ডার’-এর স্থলে ‘ইউথফুল অফেন্ডার’ এবং ‘চাইল্ড কোর্ট’-এর স্থলে ‘জুভেনাইল কোর্ট’ বলা হয়েছিল। পেনাল কোড এর মতে, ৯ বছর হলেই একটি শিশু অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য পূর্ণবয়স্ক গণ্য হতে পারে। ১২ বছর হলেই শিশু পুরোপুরি পূর্ণবয়স্ক। রহিত আইনে শিশুর বয়স ছিল অনূর্ধ্ব-১৬ বছর। ১২ থেকে ১৮ তথা ৬ বছরের এই ব্যবধানের সমন্বয় কঠিন। পেনাল কোড, ১৮৬০-এর ৪০ ধারামতে ‘অপরাধ’ হচ্ছে আইনের অধীন শাস্তিযোগ্য কোনো কর্ম। আইনি ব্যাখ্যার প্রধানতম আইন জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট, ১৮৯৭-এর ৩৭ ধারামতেও ‘অপরাধ’ হচ্ছে কোনো কর্ম, যা প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য।

কথা হলো আইনে নানাভাবে শিশুদের সুরক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তেমিন অপরাধ করা শিশুদের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানান সুযোগ সুবিধা। বাস্তবতা হলো ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিশোর অপরাধীদের বিচারের দাবি উঠেছে। এজন্য আমেরিকা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে শিশু আইনে নানা রকম সংস্কারও আনা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধী প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তার বিচার শুরু হতে পারে। তেমনি দণ্ডের ক্ষেত্রে পূর্ণ বয়স্কদের মতো না হলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন। এ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারকদের কপালে রীতিমতো চিন্তার ভাঁজ। জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও শিশুদের অপরাধ দমনে ভাববার সময় আসছে। সবমিলিয়ে কিশোর অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার বিষয়ে অনেকে এখন একমত।

শেষ পর্যন্ত সাভারে ছাত্রের হাতে শিক্ষক হত্যা ও বগুড়ায় বন্ধুর হাতে বন্ধু খুনের ঘটনার বিচার হয়ত শিশু আইনেই হবে।কিন্তু ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে আইনের ক্ষেত্রে কিছু সংশোধন আনা প্রয়োজন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিশু আইন অপরাধী কিশোরদের ক্ষেত্রে সুরক্ষার যে দেয়াল তুলেছে এজন্য ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশে কিশোর অপরাধ বিস্তারে সংকট আরো বাড়াতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানীদের আরো বেশি কাজ করার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ কিভাবে কিশোর অপরাধকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যায় এ নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা প্রয়োজন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

কিশোর অপরাধীদের বিচার ও ফেরানোর উপায় রাজন ভট্টাচার্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর