আসুন সড়ক ঘাতকদের ফুলের মালায় বরণ করি!
২১ এপ্রিল ২০১৮ ১৯:৪১
।। অঞ্জন রায়।।
প্রিয় মানুষ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা অসহায় তাকিয়ে আছেন। রোজিনা, তার বাসার সহকর্মী- রোজিনার একটা পা খেয়ে ফেলেছে সড়ক দূর্ঘটনা। এমন দৃশ্য প্রতিদিনের, কোনও না কোন একজন ইশতিয়াক রেজা অসহায় তাকিয়ে থাকবেন- সামনে কোনও জীবিত বা মৃত রোজিনা। দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমরাও। কাল রেজা ভাইয়ের স্থানে আমি বা আপনি যে কেউ হতে পারি- রোজিনার মতোও হতে পারি ভয়াবহ আহত। কি হবে তার বিচার? কিছুই হবে না।
হবে না। কারণ একজন বড় ক্ষমতাধর পাহারা দিচ্ছেন বাংলাদেশের সড়ক হত্যার কারিগরদের। এ দেশে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের ফলাফলে সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী হারানো ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে জুতোর মালা ঝোলানোর ঘটনা আমরা দেখেছি। দেখেছি কীর্তিমান তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের খুনিদের রক্ষার জন্য গাড়ির চাকা বন্ধের কর্মসূচি। এসবে উৎসাহ দিয়েছেন গাড়ী চাপা পড়া মানুষদের টাকায় বেতন পাওয়া একজন ক্ষমতাধর। তিনি গরু ছাগল চিনলে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ারও তত্ত্ব দিয়ে বিখ্যাত। গাড়ীর চাকা বন্ধ করে রাষ্ট্রকে- নাগরিকদের ভোগান্তিতে ফেলার ঘটনাগুলোর পেছনে কোন শক্তি? সেটাও নাগরিকদের অজানা নয়।
সড়ক দূর্ঘটনায় শাস্তির মাত্রাবৃদ্ধি, শুধু চালক নয়- মালিকদেরও দণ্ড, আইন না মানলে শুধু জরিমানার বদলে কারাদণ্ড এটা এখন সবার দাবি। আর একই সাথে পরিবহন খাতে নূন্যতম নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে এই খাতে সম্পৃক্ত প্রভাবশালীর- হয় মন্ত্রিত্ব না হয় শ্রমিক নেতা। যে কোনও একটা পরিচয় নির্ধারণ করা জরুরী।
বাংলাদেশের সড়কে আইন না মানাই এখন নিত্যকার সংস্কৃতি- সেই আইন না মানলে শাস্তির বিধানও রয়েছে। সেই শাস্তির পরিমাণ প্রশ্নবোধক, কারণ ২০ লাখ টাকার গাড়ির মালিকের জন্য মাসে এক বা দুই হাজার টাকা জরিমানা দেওয়া মোটেই অসাধ্য কিছু নয়। জরিমানা করার ক্ষেত্রে গাড়ীর মালিক অনেকটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। চালকের ওপরেই যতটুকু চাপ। অন্যদিকে প্রাইভেট কার বা ব্যক্তিগত যানবাহনে মামলা হলে সেই মামলার সামান্য জরিমানা বা অন্য সাজা দেয়ার স্বক্ষমতা দণ্ডদানকারীদের থাকলেও গণপরিবহন খাত জুড়ে বছরের পর বছর চলছে নৈরাজ্য।
এ এমন দেশ যেখানে সেই নৈরাজ্যের মদতদাতার আছে রাষ্ট্রীয় তকমা। তিনি কখনো মালিক কখনো শ্রমিক নেতা। এবং তিনি জানেন কিভাবে শ্রমিকদের ব্যবহার করে নিজের আসন শক্ত রাখা যায়। জানেন, সিটিং সার্ভিসের নামে প্রতারণা বন্ধে পদক্ষেপ এলে বাসের চাকা বন্ধ রেখে শহরজুড়ে অরাজকতার সৃষ্টি করতে। জানেন তারেক মাসুদ, মিশুক মুনিরের খুনীদের রক্ষায় শ্রমিক সমাবেশ করতে। গাড়ির চাকা বন্ধ করে কোটি নাগরিকদের অসহায় অবস্থায় ফেলে ফায়দা লুটতে।
বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠন ও তাদের নেতারা সড়ক হত্যার জন্য দায়ীদের রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে কঠোর কর্মসূচি দেন। সেই কঠোরতার কারণে কখনো পথে আটকে থাকে রোগী, কখনো কোনও চাকরিপ্রার্থী তার পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন না। অথচ এই বাংলাদেশের পরিবহন শ্রমিকদের নেই কোনও নিয়োগপত্র। যে কারনে বাস বা ট্রাক মালিকের মর্জির ওপরে নির্ভর করে তাদের চাকরি। একবার গাড়ি থেকে নামার পরে তারা জানেন না- আর সেই গাড়ীতে কখনও উঠতে পারবেন কী না!
পরিহাসের বিষয় শ্রমিকদের এই বেঁচে থাকার মানবিক ইস্যু নিয়ে কোনও গডফাদার শ্রমিকনেতা বা শ্রমিক সংগঠনগুলোর মাথাব্যথা নেই। তাদের যত মাথাব্যথা সড়কের হাতেগোনা হন্তারকদের রক্ষায় বা তাদের হত্যা করলে সাজা দেয়া যাবে না এমন সব ইস্যুতে।
রাষ্ট্র মানে অনুভূতিহীন কোনও অবয়ব নয়। রাষ্ট্র মহাভারতের সেই পৌরানিক ধৃতরাষ্ট্রের মতোন স্বেচ্ছায় অন্ধ অবয়ব নয়। রাষ্ট্র মানে নাগরিকের কল্যাণের একটি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র মানে নাগরিকের নাড়ি বুঝতে পারার স্বক্ষমতাও বটে। যে কারনেই রাষ্ট্রের নজরটা একটু রাস্তার দিকে দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন। রাজীবের মৃত্যু বা রোজিনার কাটা পড়া পা- এগুলো ছোট ছোট কোনও ঘটনা নয়। এগুলো একাধারে নির্লিপ্ততা ও ক্ষমতাবানদের মদতের ফলাফল।
সড়কে যখন এক পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলেছে, তখন রাষ্ট্রের নির্লিপ্ত থাকা মানায় না। রাষ্ট্রের উচিত এই সময়ে সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশগুলোকে স্পর্শ করা, আহত রোজিনাকে অভয় দেওয়া। সেই অভয় কোনও মন্ত্রীর হাসপাতালের মিডিয়া সেশন নয়, সেই অভয় হবে সড়ক দানবদের ঘাড় মটকে ধরা। হত্যাকাণ্ডের মদতদানকারী ব্যক্তির বিবেকে ধাক্কা দিয়ে বলা, একটি পরিচয় সন্তষ্ট থাকুন। ক্ষমতা না হয় শ্রমিক নেতা দু’টোর একটি বেছে নিন।
আর যদি তা না হয়, আসুন আমরা নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী রঙবেরঙের ফুলের মালা কিনি। প্রস্তুতি নেই, প্রতিটি সড়ক হত্যা বা হত্যা প্রচেষ্টার পর সেই ঘাতক ও তাদের নেতাদের যেখানে পাবো সেখানে ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়ার। আর একই সাথে কিছু মালা তাদের ইউনিয়ন বা নেপথ্য ক্ষমতাধরের জন্য বরাদ্দের কথাটা বিশেষ বিবেচনায় রাখতেই হবে।
লেখক: সংবাদকর্মী ও একটিভিস্ট
([email protected])
সারাবাংলা/ এসবি