মতান্তরের ফেসবুকবাসী
২২ এপ্রিল ২০১৮ ১৪:০৭
।। মেহেদী উল্লাহ ।।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের ‘চিঠিপত্র’ বিভাগের নিচে লেখা থাকে, ‘মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়’। চিন্তা করে দেখলাম, এই বাক্যের জন্ম এমনি এমনি হয় নাই। এ কথার অর্থ, পাঠকের যে মত সেখানে তুলে ধরা হচ্ছে তার কোনো ধরনের দায়-দায়িত্ব কর্তৃপক্ষ নিতে আগ্রহী নয়। সহজেই বোঝা যাচ্ছে, এটি কোনো দায় আসার আগেই এক ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থন। কারণ আর কিছুই নয়, প্রকাশিত মতামতে ভুল তথ্য থাকলে তার দায়ভার সম্পূর্ণ মতামত প্রদানকারীর। ভুল তথ্য না থাকলেও ব্যক্তির অসাবধানতাবশত কোনো ভুল বোঝাবুঝিকৃত উপস্থাপনও যদি চিঠিতে থেকে থাকে তার দায়িত্বও ব্যক্তিরই; সম্পাদকের নয়।
এই বাক্যটি ছাড়াও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে বেনামি চিঠি গ্রহণীয় নয়। যতদূর জানি, এসব মতকে পাঁচ-সাত বছর আগেও কর্তৃপক্ষ বেশ গ্রাহ্য করত। সমস্যা বিষয়ক মত হলে সমাধানের জন্য ছুটে আসত। বিষয়টি এত দূর গড়িয়েছিল যে, এসএসসি পরীক্ষায়ও এমন প্রশ্ন আসত- তোমার গ্রামে দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন বা বিদ্যুত সংযোগ চেয়ে পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে সম্পাদক বরাবর একটি আবেদনপত্র লেখ। আবেদনের নিচে আমরা মতামতসহ পরীক্ষায় তুলে ধরতাম। বিনিময়ে নম্বর আসত, বিদ্যুত আর আসত না। বিদ্যুত আছে এমন গ্রামের শিক্ষার্থীদেরও লিখতে হত! এখন আসে কি না জানি না।
যাই হোক, সেই দিন আর নাই। এখন খুব কম সংখ্যক মানুষকেই পাওয়া যাবে মতামত প্রকাশের জন্য পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগের দ্বারস্থ হতে। অনেক দৈনিকে এই বিভাগটার নামই বদলে গেছে। যেমন, মেইল-ইমেল। তবে মত পাঠানোর মাধ্যম বদলে গেলেও মত কেউ কেউ পাঠান। অধিকাংশ মানুষই আজ আর সেই অপেক্ষায় তীর্থের কাক সাজতে রাজি নন। কবে ছাপা হবে প্রতিবাদ? মতামত? ছাপা হয় কি, না হয় তার নাই ঠিক।
এখন তবে কী করেন? না বললেও বোঝার কথা, ফেসবুকে লিখে দেন। অভ্র আছে। আর আছে হাতে হাতে নানা ডিভাইস। কথ্য বুলিতে বললে, মানুষ এখন ‘পোস্টান’। শব্দটা প্রথম শুনেছি আমার এক ছাত্রের মুখে। একদিন তার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম ক্যাম্পাসের চায়ের দোকানে। সে সময় তার ফোন আসায় সে ধরল। ফোনেই কাকে যেন বলতে শুনলাম,’হ্যাঁ, পোস্টাইছি তো! দেখ আমার ওয়ালে।’ তারপর ফোন রেখে আমাকে জানাল, বন্ধুর জন্মদিনের কয়টা ছবি, ফেসবুকে দিতে বলেছিল অনেকদিন ধরে। দিয়ে দিয়েছি, স্যার। ছাত্রটির কাছে আর জিজ্ঞেস করতে হয়নি পোস্টানো মানে কী?
এখন ফেসবুক খুললেই পোস্ট, সেকেন্ডে সেকেন্ডে পোস্ট। হরেক রকম পোস্ট। না বললেও একটা আইডির মালিক মাত্রই বুঝতে পারছেন কেমন ধরনের সেইসব পোস্ট। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত সবই আছে!
২.
ক’দিন আগের ঘটনা। একটি ফেসবুক পোস্টে একজনকে লিখতে দেখলাম, ‘এত সোন্দর কিলিপটা আমার হারাইছে।’ সঙ্গে কান্নার ইমোকটিনস। এক মিনিটের মধ্যেই আরেকজন পোস্টে কমেন্ট করল, ‘হারায় নাই, দুপুরে আমার কাছে রাখতে দিছিলি।’ এবার তার নিচে আরেকটা কমেন্ট,’তোর কাছে ক্যামনে! তোর ব্যাগ থেকে ক্লিপটা আমি সরাইছি। ট্রিট চাই!’ সঙ্গে আনন্দের রিঅ্যাক্ট। মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে পোস্ট থেকে চোখ সরাতে বাধ্য হলাম, এদের এত তালের কথা শুনে। মাথা ঘুরছে।
পরদিন ক্লিপটা যার সে আবার পোস্ট দিল- এবারের বক্তব্য ‘ক্লিপটা আসলেই হারাইছে, ওই দুই বান্ধবী ঢপ দিয়েছে, ট্রিট দিলেও ক্লিপ আর পায় নি ফিরে। ’
এ তো গেলো মাথার ক্লিপ বৃত্তান্ত! কিন্তু এমন ঘটনা এই ফেসবুকেই ঘটে চলেছে নিত্য, যেগুলো আঘাত করে হৃদয়ে, সমাজ ব্যবস্থায়। ফেসবুকে মত প্রকাশের সোজা রাস্তাটাকে ব্যবহার করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে গুজব। বিভিন্ন ইস্যুতে সেটা প্রমাণিত হচ্ছে বার বার। কি ব্যক্তি, কি জাতীয় সব ধরনের ইস্যুতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফেসবুককে। এমনকি ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য ছড়ানো হচ্ছে গুজব। কদিন আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেখা গেছে এমন হীন অপচেষ্টা।
‘পুলিশের গুলিতে জনৈক শিক্ষার্থীর মৃত্যু’ পোস্টগুলো এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে আসতে পারে। খোঁজখবর না নিয়ে, সবচেয়ে বড় কথা নিশ্চিত না হয়ে এ ধরনের প্রচারণার জন্য ব্যক্তি কতটা দায় নিচ্ছে? যে দায় তিনি সমাজের ঘাড়ে চাপালেন, অস্থিতিশীলতা বাড়ালেন এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে-সেই দায়ের জন্য ওই ব্যক্তিকে খুঁজতে গেলে হয়তো দেখা যাচ্ছে তার ফেসবুক আইডিটি ততক্ষণে ডিএক্টিভেট করা হয়ে গেছে। পাঠকের অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য মতামতের জন্য দায়ী নয় লিখেও, যেখানে পত্রিকা ক্ষেত্র বিশেষে ক্ষমা চাচ্ছে সেখানে এই সোশ্যাল মিডিয়ার তারও বালাই নেই। ক্ষমা চাওয়া দূরের কথা একটা মতামতের যে নূন্যতম দায়দায়িত্ব আছে সেটার ঊর্ধ্বে অবস্থান করছেন অনেকেই। আর সেটা ফেক আইডির মাধ্যমে। অবশ্য কেউ কেউ আছেন আবেগের বশে, না বুঝে গুজব শেয়ার করেন। তারা হয়তো পরে ক্ষমাও চান। কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
৩.
ব্যক্তিগতভাবে আমি স্বাধীন মতপ্রকাশের পক্ষে। গঠনমূলক মতামত হলে সেটা কার পক্ষে গেল, কার বিপক্ষে গেল তার চেয়ে বড় একটা সত্য প্রকাশিত হলো, তা সমাজের জন্য উপকার বয়ে আনছে। সেটাকে আইনি বিধিনিষেধ কিংবা কোনো বিশেষ ধারার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ গণতন্ত্রের পক্ষে কল্যাণদায়ি নয়। কিন্তু ফেসবুকবাসীর এমন সংখ্যাটাই বেশি যারা এই স্বাধীন মত প্রকাশের অপব্যহার করে যাচ্ছেন, বুঝে বা না বুঝে। আর এসব মতামতের জন্য কেউ দায়ী থাকে না। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দায়ী থাকবার তো কোনো ব্যবস্থাই নাই। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটা সেন্সরবিহীন। সম্পাদনাহীন, ব্যক্তির রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি, নৈতিকতা, আদর্শ, শিক্ষা, ইচ্ছা, অভিসন্ধি, দুরভিসন্ধি ইত্যাদি দ্বারা পরিচালিত। ব্যক্তির এইসব উৎসজাত পোস্ট প্রভাবিত করে চলেছে অন্য ফেসবুকবাসীদের। এটি নিয়ন্ত্রণের আর কোনো উপায় আপাতত দেখছি না সংশ্লিষ্ট পোস্টদাতার সচেতন হওয়া ছাড়া।
নাগরিক হিসেবে পোস্টদাতা ও কমেন্টকারীকে বুদ্ধি, বিবেক আর আত্মসংযমের চাবি ব্যবহার করেই এই প্রতিবন্ধকতার তালা খুলতে হবে। পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিবারে যেমন দায়িত্ব নিয়েই বাবা-মা, ভাই-বোনের উদ্দেশে কিছু বলি, সমাজের সামাজিকতা মেনেই যেমন চলি তেমনি ফেসবুকেও কিছু বলার সময় সংগতিবিধান করেই বলা বাঞ্চনীয়।
ফেক আইডিকে নিরুৎসাহিত করা উচিত। ফেক আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালে একসেপ্ট করা তো উচিতই নয় রিপোর্ট করা উত্তম। ফেক আইডির কোনো প্রতিক্রিয়া যেমন লাইক, কমেন্টে সাড়া দেয়াও তেমনি অনুচিত।
৪.
সাধারণত কয়েকটি ভাষিক উপায়ে ফেসবুক ব্যবহারকারী মতামত (পোস্ট বা কমেন্ট) প্রকাশ করে থাকেন। জেনে-বুঝে সরাসরি, জেনে-বুঝে রূপক বা ইঙ্গিতের আশ্রয়ে, না জেনে-না বুঝে সরাসরি, বুঝে-শুনে অশ্লীলভঙ্গিতে , অন্যের মতের সাথে ইচ্ছাকৃত দ্বিমত পোষণের জন্যে। রুচিশীলতা কিংবা বিকৃত রুচির পরিচয় দিয়ে।
এছাড়া বিভিন্ন উদ্দেশে মতামত প্রদান করে থাকেন। বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রগতিশীলতা প্রকাশে, যে কোনো ইস্যুতে সাধারণ মনের ভাব প্রকাশে, কোনো নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নে, আদর্শ প্রচারে, চমক সৃষ্টি করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ। এর মূল উদ্দেশ্য লাইক, ফলোয়ার বাড়ানো।
তবে নানা ভাষিক উপায় ও উদ্দেশ্যে দেওয়া মতামতের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে এই বিষয়গুলো- না জেনে-না বুঝে সরাসরি, বুঝে-শুনে অশ্লীলভঙ্গিতে, অন্যের মতের সঙ্গে ইচ্ছাকৃত দ্বিমত পোষণের জন্যে। কিন্তু বিকৃত রুচির পরিচয় দিয়ে। কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নে। বিশেষ আদর্শ প্রচারে যা বিভক্তি ও বিভেদ বাড়ায়।
ফেসবুকে যে মতান্তর তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনত যদি উপরের উপায়গুলো ব্যবহার করে মত প্রকাশকারী না থাকতেন। যে কোনো ইস্যুতে দেখছি, এরাই ঘটনাকে নানাভাবে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করছে, ধোঁয়াশা ও অস্পষ্টতা সৃষ্টি করছে। একটা ঘটনা না ঘটলেও তার প্রচার বা ঘটনার মূলে না থাকার জন্য সামগ্রিকভাবে এরাই দায়ী।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই অপব্যবহারে তৈরি হচ্ছে দ্বিধাগ্রস্থ দশা। সত্যিই বিভ্রান্ত হয়ে যেতে হয় সবাইকে। এমনও দেখা যাচ্ছে একটা ইস্যু চলাকালীন এই গোষ্ঠীর চাপে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। পরে সত্য প্রকাশিত হলে আগের অবস্থান থেকে সরে আসতেও দেখা যাচ্ছে কর্তৃপক্ষকে দুঃখ প্রকাশ করে বা ক্ষমা চেয়ে। এ ধরনের পরিস্থিতে ভালো পরামর্শ বা সমাধান হতে পারে আমলে না নিয়ে সময় নেওয়া। সময় নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা।
এ কথা ঠিক, ইস্যু চলাকালীন মানসিক চাপ তৈরি হয়। কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে না কি করা উচিত। কিন্তু এই গোষ্ঠীর মতামত আমলে নিয়ে যে কোনো তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেশের স্বার্থেই ভাবা উচিত। উপেক্ষা করতে পারাটা সবচেয়ে বড় সমাধান। আমলে নেয়া হচ্ছে না বা হবে না এটা বার কয় প্রমাণিত হলে পরবর্তীকালে এদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। মনে রাখা জরুরি, এমন মত প্রকাশকারীদের অধিকাংশের বাস্তবতাই ভার্চুয়াল বাস্তবতা। বাস্তবতা হয়তো এদের অস্তিত্বই নাই। বা থাকলেও বাস্তবে এরা ফেসবুকের সারসত্তার বাইরে অবস্থান করে। ফেসবুকে যে সত্তা সেটা বিভ্রান্তির, মতান্তরের।
ফেসবুকবাসীর যে মতান্তর তা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে সেই প্রত্যাশা করি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
সারাবাংলা/ এসবি