করোনা ও ওষুধে নয়া অভিঘাত, অঘটনের সম্ভাবনা
১৮ জুলাই ২০২২ ১৫:৫৮
এক
কয়েকদিন থেকে সেই ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে—অঘটনের সম্ভাবনা। প্রতিদিন করোনা-আক্রান্তের পরিসংখ্যান অন্তত সেই কথাই বলছে। তা সত্ত্বেও চোখ বুজে থাকার যে অভ্যাসটি আমরা আত্মস্থ করেছি, কানা চোখে তা দেখে স্বস্তি ফেলতে হয়। ভিড় নিয়ন্ত্রণ, শারীরিক দুরত্ববিধি পালন দূরে থাক, এখনও অবধি মাস্ক পরা-সহ ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে কোনো তৎপরতা দেখা গেল না।
আপাতত সংক্রমণের যা চরিত্র, তাতে জানা গেছে, গুরুতর অসুস্থের সংখ্যা মাত্রাছাড়া পর্যায়ে পৌঁছায় নি। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকার উপায় কই! এটি সত্য, কোনো নতুন স্ট্রেন কিনা, অথবা এর ক্ষতি করার ক্ষমতা কতোটা, সে সব নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় হয়তো এখনো আসেনি। তবে, যারা আক্রান্ত হচ্ছে, তারা বলছেন, এটা অনেক কষ্টকর, যন্ত্রণাদায়ক। শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধির গোড়ার দিকে গুরুতর অসুস্থতা অথবা মৃত্যুর সংখ্যা কম থাকতেই পারে। কিন্তু পরবর্তীকালে তাতে যে কোনো বিশাল লাফ দেখা দেবে না, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। অভিজ্ঞতা বলে, পরিস্থিতি যেমনই হোক, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই সাবধান হওয়া জরুরি। অথচ, এক বিশাল সংখ্যক মানুষের মনোভাব দেখে মনে হয় না, কেউ অভিজ্ঞতা থেকে কোনোরকম শিক্ষা নিয়েছে।
ঈদের আগে থেকে সারাদেশে, বিশেষত বরিশাল বিভাগে যে পরিস্থিতির মধ্যে যেতে হচ্ছে; বরিশাল বিভাগে করোনা সংক্রমণের হার ৩৭ শতাংশ। রাজশাহীতে শনাক্তের হার ৩৫.৭১ শতাংশ। এছাড়া চট্টগ্রামেও উল্লম্ফনে করোনা ওঠানামা করছে। মর্মান্তিক, একই সঙ্গে এটি উদ্বেগের বিষয়। তারপরও চিকিৎসকদের সাবধানবাণীকে এমন অগ্রাহ্য করা কেন? কোন্ সর্বনাশের প্রতীক্ষায়? প্রশ্ন হল, টনক নড়বে কবে? জনগণ যথেচ্ছ স্বাস্থ্যবিধি ভাঙছে, নির্জলা সত্য। কিন্তু সেই বিধি ভাঙায় এত দিন যে অবাধ প্রশ্রয় সংশ্লিষ্ট দফতর জুগিয়ে এসেছে, তার মূল্য কটি প্রাণের বিনিময়ে চোকাতে হবে, জানা নেই।
এই ঢেউয়ে অন্তত করোনা প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় দিয়েছে। কিন্তু সেই সময়টুকুর সদ্ব্যবহার করে দ্রুত বুস্টার ডোজ দানের কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্যতামূলক কেন করা হলো না?
দুই
ওষুধের দাম বেড়েছে। সিটিজেন জার্নালিজমে অনেককেই এ নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যাচ্ছে। জ্বর-ব্যথার জন্য সাধারণ প্যারাসিটামল থেকে শুরু করে গ্যাস, পেটের সমস্যা, হৃদরোগ, অ্যান্টিবায়োটিক, ত্বকের ওষুধ কিনতে সাধারণ মানুষের বাজেট হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।
সব ধরনের ওষুধের দাম মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। শুধু দেশে উৎপাদিত ওষুধ নয়, বিদেশ থেকে আমদানি অতি জরুরি ওষুধও বিক্রি করা হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি দামে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক, মানুষের জীবনরক্ষার উপকরণ নিয়েও কিছু লোকের বাণিজ্যিক মনোবৃত্তি বন্ধ হয়নি। এক্ষেত্রেও তারা হিসাব করছে লাভের অঙ্ক!
এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাড়তি দামের জেরে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। তার ওপর হঠাৎ ওষুধের দাম বৃদ্ধি সবার দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়েছে। অন্যদিকে কাঁচামাল, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে ওষুধের দাম বাড়ানোর কথা জানিয়েছে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। দাম বাড়াতে না দিলে উৎপাদন বন্ধের হুমকিও দিয়েছে তারা। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন আচরণ সত্যিই হতাশাজনক।
মৌসুমি জ্বর-সর্দি-কাশি তো বটেই, এমনকি করোনায় আক্রান্ত হলেও ৯৮ শতাংশ রোগী অপ্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী সেবন করছেন ওষুধ। ফলে করোনা, সর্দি ও জ্বরের চিকিৎসায় সাধারণ ওষুধের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ওষুধের কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে ওষুধ বিক্রি করছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে করোনাকালে কোনো ওষুধের দাম বাড়ানো হয়নি বলে জানিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর।
শুধু করোনাকালেই ওষুধের বাজারের এমন পরিস্থিতি নয়, বছরজুড়েই খুচরা পর্যায়ে ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন। কোনো কারণ ছাড়া ওষুধের দাম বাড়ছে। যেন কেউ দেখার নেই। দাম নিয়ন্ত্রণে ওষধ প্রশাসন অধিদফতরের একটি তদারকি টিম রয়েছে, কিন্তু বাজারে সে টিমের তৎপরতা খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না।
বাজার ও জনস্বার্থের এই দ্বিমুখী টান অপ্রত্যাশিত নয়। এ-ও সত্য যে, মোটের ওপর আমাদের দেশে ওষুধের দাম এখনও তুলনায় কম। কিন্তু তাতেও এদেশে অধিকাংশ মানুষের কাছে চিকিৎসার খরচ সাধ্যাতীত। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অর্ধেকেরও বেশি তাদের সমস্যার কথা জানেন না, ডায়াবেটিসের রোগীদের অনেকেই জানেন না রোগটি হওয়ার কথা। জেনেও চিকিৎসা করাতে পারেন না, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। চিকিৎসার খরচই চিকিৎসাকে অধরা রাখছে।
চিকিৎসাকে সুলভ করতে হলে কিছু জীবনদায়ী ওষুধের দাম বাঁধা যথেষ্ট নয়। চিকিৎসকরা ব্র্যান্ডের পরিবর্তে জেনেরিক ওষুধ লিখলে চিকিৎসার খরচ কমে। কিন্তু, জেনেরিক ওষুধের মান পরীক্ষার ব্যবস্থা দেশে অত্যন্ত দুর্বল। তাই সেগুলোর কার্যকারিতা সম্পর্কে চিকিৎসক ও রোগী, উভয়ই সন্দিহান।
ওষুধের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। উপায়ান্তর না দেখে অনেকে ঝুঁকবে ঝাড়ফুঁক আর টোটকা চিকিৎসার দিকে। এতে দেশের স্বাস্থ্যসেবা মুখ থুবড়ে পড়বে।
তিন
জনস্বাস্থ্য রক্ষা সরকারের দায়িত্ব, ঠিক যেমন শিক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকা- সুষ্ঠুভাবে, স্বাভাবিক নিয়মে যাতে চলতে পারে তার ব্যবস্থা করাও সরকারের কাজ। সর্বোপরি, জনগণ যদি সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে নিমজ্জিত থেকে গোষ্ঠীস্বার্থের কথাটি বিস্মৃত হয়, তবে তাকে ঠিক সময়ে কথাটি মনে করিয়ে দেওয়ার দায়ও সরকারেরই। কোনো অজুহাতেই এই কা-জ্ঞানহীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। স্বাস্থ্যসুরক্ষার ক্ষেত্রে যদি শেষপর্যন্ত ভাইরাসের বদান্যতার ওপরে নির্ভর করে থাকতে হয়, তবে তা নিতান্তই দুর্ভাগ্যের।
আগামী ৭ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত টিকা দেওয়া শুরু হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। তবে ইউনিয়নে একটি মাত্র টিকাকেন্দ্র থাকলে দূরদূরান্তের মানুষ এসে টিকা দিতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে ইউনিয়নে একাধিক টিকাকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ টিকাকেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। করোনা রুখতে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।
লেখক: রাজনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
করোনা ও ওষুধে নয়া অভিঘাত- অঘটনের সম্ভাবনা মত-দ্বিমত হাবীব ইমন