Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হেপাটাইটিস দিবস, কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

জুয়েল সরকার
২৮ জুলাই ২০২২ ১৬:৪০

আজ বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। এ বছরের হেপাটাইটিস দিবস এর প্রতিপাদ্য ‘আর অপেক্ষা নয়, হেপাটাইটিস প্রতিরোধের এখনই সময়’। প্রতিবছর লিভারের এই রোগের কারণে বিশ্বব্যাপী এক কোটি ত্রিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। তবে এই রোগ ছোঁয়াচে নয় বলে এর প্রতি মানুষের ভীতিটাও অনেকটাই কম। আমাদের দেশেও চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা হেপাটাইটিস সংক্রমণকে এক নীরব ঘাতক হিসেবে দেখেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে প্রায় এক কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত। বেসরকারি হিসেবে হেপাটাইটিসে প্রতি বছর ২০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।

বিজ্ঞাপন

হেপাটাইটিস কী? সহজ ভাষায়, হেপাটাইটিস হলো লিভারের প্রদাহ বা ভাইরাসজনিত লিভারের রোগ। সাধারণত দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হলে শরীর দুর্বল, বমি বমি ভাব, পেটব্যথা, শরীর হলুদ বর্ণ ধারণ করা এবং হলুদ প্রস্রাবের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। শরীরে এই রোগের বিস্তার ঘটলে পেটে পানি আসা, রক্ত পায়খানা ও রক্ত বমিও হতে পারে। এ হেপাটাইটিস সংক্রমণ সাধারণের কাছে ‘জন্ডিস রোগ’ হিসেবে পরিচিত। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ৫ ধরনের হেপাটাইটিস রয়েছে। হেপাটাইটিস এ থেকে ই। হেপাটাইটিস এ এবং ই স্বল্পমেয়াদী লিভার রোগ। এটি বিশ্রাম নিলে এক পর্যায়ে সেরে ওঠে। তবে প্রাণঘাতী হচ্ছে হেপাটাইটিস টাইপ- বি এবং সি ভাইরাসের সংক্রমণ। শরীরে রোগের বিস্তার না ঘটা পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও নির্দিষ্ট লক্ষণ ধরা পড়ে না। এছাড়া এ রোগে আক্রান্তরা অনেক ক্ষেত্রেই সুচিকিৎসা পান না। আর বাংলাদেশে হেপাটাইটিসে আক্রান্তদের একটা বড় অংশ ঝাড়ফুঁক, পানি পড়া, ডাব পড়া নেয়ার মতো কবিরাজি চিকিৎসার দ্বারস্থ হন।

বিজ্ঞাপন

হেপাটাইটিস এ ভাইরাস দূষিত খাবার এবং পানীয় জলের মাধ্যমে ছড়ায়। এই রোগের ক্ষেত্রে, লিভার ফুলে যাওয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া, জ্বর, বমি, পেশী ও জয়েন্টে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা যায়।

হেপাটাইটিস বি ভাইরাস রক্ত ও দেহনিঃসৃত তরলের মাধ্যমে ছড়ায়। এই ভাইরাসের উপসর্গ হলো, জ্বর, দুর্বলতা, অবসাদ, ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া, বমি ভাব বা বমি হওয়া। এই রোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে লিভারের রোগ যা লিভার সিরোসিস এবং ক্যান্সারের রূপ নেয়। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভস্থ শিশুও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত ব্যক্তির সচরাচর কোন উপসর্গ থাকে না। অনিরাপদ রক্ত গ্রহণ, জীবাণুযুক্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম এর ফলে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হয়। পৃথিবী জুড়ে আনুমানিক এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ হেপাটাইটিস সি -এ আক্রান্ত। এই ভাইরাসের দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ লিভারে ক্ষত এবং বেশ কয়েক বছর পর সিরোসিস সৃষ্টি করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিরোসিস আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার অকার্যকর হয়ে ক্যান্সার বা খাদ্যনালী ও পাকস্থলীর শিরা বেড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

হেপাটাইটিস ডি রক্ত গ্রহণ, সংক্রমিত সূঁচ বা শেভিং সরঞ্জামের মাধ্যমে ছড়ায়। এই ভাইরাসে লিভারের সংক্রমণের ফলে বমি ও হালকা জ্বর হয়।

হেপাটাইটিস ই ভাইরাস সাধারণত দূষিত খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। এই ভাইরাসের সংক্রমণে রোগীর ক্লান্তি, ওজন কমে যাওয়া, ত্বক ফ্যাকাশে হলুদ হওয়া ও জ্বরের মতো লক্ষণ দেখা যায়।

চিকিৎসকরা জানান, হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস ছড়ায় মূলত রক্ত এবং মানবদেহের তরল পদার্থের মাধ্যমে। বিশ্বে যত মানুষের লিভার ক্যান্সার হয় তার ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই দায়ী হচ্ছে এই হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস। পৃথিবীতে গড়ে প্রতিদিন ৪ হাজার মানুষ লিভার রোগে মারা যায়। হেপাটাইটিস নিয়ে উদ্বেগের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, সারা বিশ্বে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে সংক্রমিত দশজনের নয়জনই জানেন না যে তারা শরীরে এই ভাইরাস বহন করছেন। তাই এটি একটি নীরব ঘাতক। এই হেপাটাইটিস বি এবং সি অনেকটা এইডসের মতো। এটা নীরবে একজন থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। বিভিন্নভাবে যেমন, সেলুনে শেভ করতে গিয়ে ক্ষুর থেকে, সিরিঞ্জের মাধ্যমে ড্রাগস গ্রহণ, নাক-কান ফুটানো, রক্ত পরিসঞ্চালন, তারপর যৌন মিলনের মাধ্যমে সহজে সঞ্চালিত হয়।

যেহেতু রক্তের মাধ্যমে ভয়ংকর এই ভাইরাস সবচেয়ে বেশি ছড়ায় তাই নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে রক্তদানের আগে যে পরীক্ষা করা হয় সেখানে সবসময় হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস ধরা পড়ে না। এছাড়া বি ও সি ভাইরাস রক্তে সংক্রমণের পর একটা ‘অন্তর্বতীকালীন সময়’ থাকে ২ থেকে ৬ মাস। এ সময়ে সাধারণ রক্ত পরীক্ষায় এ ভাইরাস ধরা পড়ে না। এ সময় কেউ যদি রক্ত আদান-প্রদান করেন তাহলে অগোচরেই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে পড়ে। এটি নিরূপণে ডিএনএ ভাইরাল মার্কার বা এইচভিসি টোটাল টেস্ট প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে জেলা উপজেলা হাসপাতালগুলোতে হেপাটাইটিস পরীক্ষায় এইচভিসি ভাইরাল মার্কার বা এইচভিসি টোটাল টেস্টগুলো করার ব্যবস্থা নেই। এগুলো ছাড়া নিশ্চিত হওয়া যায় না যে রক্তে হেপাটাইটিস ভাইরাস আছে কি নেই। তাই এই প্রাণঘাতী রোগটি নির্মূল করতে চাইলে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালনের বিকল্প কিছু নেই।

এছাড়া প্রাণঘাতী এই রোগটি থেকে বাঁচার আরও একটি উপায় আছে- টিকা গ্রহণ। হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নির্মূলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সেক্টর স্ট্র্যাটেজির ২০২০ সালে কিছুটা লক্ষ্য পূরণ হয়েছে, যা শিশুদের টিকা এবং রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রম দ্বারা সম্ভব হয়েছে। এখন চার বছরের কম বয়সি বাচ্চাদের বি ভাইরাসের হার শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ। প্রতি বছর বি ভাইরাস দ্বারা নতুনভাবে সংক্রমিত হচ্ছে লাখে ২০ জন এবং বি ভাইরাসের কারণে বছরে মারা যায় লাখে ১০ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৫ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বি ভাইরাস নির্মূলে কিছু লক্ষ্য স্থির করেছে। চারের কম বয়সি শিশুদের বি ভাইরাস সংক্রমণ কমিয়ে ২০২৫-এ শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০৩০-এ শূন্য দশমিক ১ শতাংশ আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। নতুনভাবে সংক্রমণের সংখ্যাও প্রতি লাখে ২০২৫-এ ১১ জন এবং ২০৩০-এ দুই জনে কমিয়ে আনার লক্ষ্যও স্থির করা হয়েছে। বি ভাইরাসজনিত মৃত্যুহার ও ২০২৫-এ প্রতি লাখে সাত এবং ২০৩০-এ প্রতি লাখে চারে কমিয়ে আনতে চান বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সেক্টর স্ট্র্যাটেজি ২০২২। সেজন্য বি ভাইরাস সংক্রমণ রোধে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সেক্টর স্ট্র্যাটেজি ২০২২-এর মূল লক্ষ্য হলো—জন্মের পরপর সব শিশুকে প্রথম ডোজ টিকা এবং অন্য সব শিশুকে শিডিউলের সব টিকা কাভারেজ ২০৩০ সালের মধ্যে ক্রমান্বয়ে কমপক্ষে ৯০ শতকের ওপরে রাখা। বর্তমানে বি ভাইরাস সংক্রমিত রোগীদের মধ্যে শতকরা মাত্র ৩০ ভাগ রোগীর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য হলো—শতকরা ৯০ ভাগ রোগীর রোগ নির্ণয় করা এবং কমপক্ষে শতকরা ৮০ ভাগ রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা। গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে শিশু বয়সে এবং মাতৃগর্ভে—সেটা নিজের মায়ের মাধ্যমে সংক্রমণ।

এক্ষেত্রে খারাপ ব্যপারটা হলো—শিশুবয়সের সংক্রমণের প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগ শিশু এই জীবাণুটি সারা জীবন বহন করে, অজান্তে অন্যদের সংক্রমিত করে এবং শতকরা ৫ ভাগ শিশু দূর ভবিষ্যতে যকৃতের ক্যানসারসহ দীর্ঘমেয়াদি জটিল যকৃতের রোগে ভোগে। শিশুদের এত বেশি দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণের কারণ হলো—জরায়ুতে থাকা অবস্থায় অনবরত ভাইরাসের মুখোমুখি হওয়া এবং দুর্বল, ক্লান্ত ইমিউন প্রতিক্রিয়া। মায়ের শরীরে যত বেশি ভাইরাল লোড, বাচ্চার সংক্রমণের হার তত বেশি। প্রাপ্তবয়স্কের ক্ষেত্রে প্রবল ইমিউন প্রতিক্রিয়া হয়, যকৃত স্বল্পকালীন সময় অল্প থেকে মাঝারি আকারের আঘাত পেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এপোপটসিস ও সাইটোকাইনের মাধ্যমে শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্হা সংক্রমিত কোষগুলো ধ্বংস করে ফেলে এবং উলটো শরীরের মধ্যে এইচবিভি প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। তবে দুর্বল ক্লান্ত ইমিউন প্রতিক্রিয়ার কারণে এদের মধ্যেও শতকরা মাত্র ৫ ভাগ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি এই ভাইরাসটি বহন করে এবং কেউ কেউ যকৃতের জটিলতার সম্মুখীন হন। ক্লান্ত সিডি ৮ ও টি রেগুলেটরি কোষের প্রকটতাই হলো ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে শরীরের প্রতিরক্ষায় হেরে যাওয়ার কারণ। বাচ্চার জন্মের পূর্বে মায়েরা চিকিৎসকের কাছে অ্যান্টিনেটাল চেকআপের জন্য আসেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান হলো—শতকরা মাত্র শূন্য দশমিক ৪ ভাগ (বাংলাদেশে শতকরা ৩ দশমিক ৫ ভাগ) গর্ভবতী মা এই ভাইরাসটি বহন করছে। এই পরিসংখ্যানটিকে শূন্য করতে পারলেই HBV-এর পরিণতি হবে স্মলপক্সের মতো।

হেপাটাইটিস নিয়ে বাংলাদেশে সক্রিয়ভাবে কাজ করা একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, গর্ভবতী মা-সহ সবার এইচবিএসএজি (HBsAg) টেস্ট করানো উচিত। পজিটিভ হলে নির্দিষ্ট পরীক্ষানিরীক্ষা ও চিকিৎসা দরকার। নেগেটিভ থাকলে প্রয়োজনে অ্যান্টি এইচবিসি টোটাল (anti HBC total) এবং প্রয়োজনে অ্যান্টি এইচবিএস (anti HBs) টেস্ট করা দরকার। উপরিউক্ত পরীক্ষানিরীক্ষায় নেগেটিভ থাকলে অবশ্যই এইচবিভি টিকা প্রদান প্রয়োজন। এইচবিভি সংক্রমণ জটিলতা শুরু করে দিলেও সুনির্দিষ্ট চিকিত্সায় কার্যকরী নিরাময় হয়।

লেখক: উন্নয়নকর্মী

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

জুয়েল সরকার মত-দ্বিমত হেপাটাইটিস দিবস- কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর