‘একজন গবেষক বাংলাদেশের স্যোশাল মিডিয়া বুঝতে চেয়েছিলো’
২৭ নভেম্বর ২০১৭ ০৯:৪৪ | আপডেট: ৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৫:৪১
আশীফ এন্তাজ রবি
আমার কাছে এক শিক্ষার্থী এসেছে। সে কোনো এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছে। তার গবেষণার বিষয় সোশাল মিডিয়া।
আমার কাছে আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের সোশাল মিডিয়া সম্পর্কে সে কিছু জানতে চায়।
আমি তাকে খুবই যত্ন করে চা খাওয়ালাম। বাংলাদেশের চা। সে খুবই আগ্রহ নিয়ে চা খেলো। তার খাওয়া শেষ হওয়ার পর, আমি গলায় দুই লিটার বিনয় ঢেলে বললাম, বাংলাদেশের সোশাল মিডিয়া নিয়ে আমি কিছুই জানি না।
সে খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল, কিন্তু আমি তো শুনেছি তুমি ফেসবুকে খুব একটিভ।
– ঠিকই শুনেছো। আমি যতক্ষণ সময় ফেসবুকে থাকি, ততক্ষণ সময় আমি আমি অফিস, সংসার, বাথরুম এমনকি বিছানায়ও থাকি না। আমার একটা ছোট্ট প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ আছে। যখন শাওয়ার নিই, তখনও আমি ফেসবুকে চোখ রাখি। সেই ছোট্ট প্লাস্টিকের ব্যাগে আমার মোবাইল থাকে। পানিতে যাতে মোবাইল ভিজে না যায় এজন্য এই ব্যবস্থা।
এই কথা শুনে তরুণ গবেষকটির চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে বলল, আমি তোমার এই ফেসবুক ব্যবহারের অভিজ্ঞতাটাই শুনতে চাই।
এবার আমি গলায় দুই কেজি পরিমাণ কনক্রিট ঢেলে বললাম, সেই অভিজ্ঞতা আমার পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। স্যরি। তুমি এবার আসো। তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে আমার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এ সময়ে ফেসবুকের অনেক কিছুই আমি মিস করেছি। এই বলে আমি দ্রুত মোবাইল ফোনে ফেসবুক খুলে ঘাটাঘাটি করতে লাগলাম।
এই রকম ভয়াবহ অভদ্র ব্যবহারের পর কেউ আর দ্বিতীয় বার আমার কাছে আসবে না। কিন্তু সে যে জাত গবেষক। দুইদিন পর সে আমাকে মেইল দিলো। একটা অদভুত প্রস্তাব দিয়ে। আমি বসে বসে ফেসবুকিং করবো। সে আমার পাশে বসে থাকবে। তার শুধু এতটুকুই চাওয়া।
অগত্যা আমাকে রাজি হতেই হলো।
এক সুন্দর প্রভাতে তরুণ গবেষকটি আসলো। আমার ফেসবুক খোলাই ছিল। সে এসে আমার পাশে বসে বলল, আজকের হট টপিক কি ফেসবুকে?
আমি নিউজফিডে গেলাম। একটা ভিডিও। কয়েক হাজার বার শেয়ার হয়েছে। ছেলেটি বলল, আমাকে বলবে, এই ভিডিও-তে কি আছে? আমি বাংলা বুঝতে পারছি না।
ভিডিওটি বাংলাদেশের একজন কৌতুক অভিনেতার। মঞ্চে, স্ক্রিনে কৌতুক দেখিয়ে, শুনিয়ে নাম করেছেন। তিনি একটা অনুষ্ঠান হোস্ট করছিলেন সেই সময়কার ভিডিও। তিনি মেয়েদের নিয়ে একটা কৌতুক বলছেন। কৌতুকটি সবাই জানেন। কাজেই আমি আর রিপিট করলাম না। তরুণ গবেষককে যথাসম্ভব ভদ্রভাষায় কৌতুকটি ব্যাখা করলাম।
ছেলেটি একটু থতমত খেলো। বলল, ঠিক আছে। এর পরের পোস্ট টা দেখি তো ।
পরের পোস্টে গেলাম। একজন একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন। বলা বাহুল্য, স্ট্যাটাসটি ওই অভিনেতার পোস্ট বিষয়ক। যিনি স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তিনি স্বাধীন মতামত প্রকাশের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি লিখেছেন, “মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। অশ্লীলতা বলে কিছু নেই। নারীর **** থেকে শুরু করে পুরুষের **** পর্যন্ত- যেকোনো বিষয় নিয়ে কৌতুক করা যাবে। এতে কোনো ধরণের বাঁধা দেয়া যাবে না। বাঁধা দিলে সেটা বরদাস্ত করা হবে না।”
গবেষককে এই মন্তব্য অনুবাদ করে বুঝলাম।
এরপরে স্ট্যাটাসে গেলাম। এই স্ট্যাটাসটিও ওই কৌতুক বিষয়ক। কষ্ট করে এটার অনুবাদ করতে হলো না। লেখক ইংরেজিতে লিখছেন, ছি ছি, কী অশ্লীল। কী লজ্জা!
এরপরে স্ট্যাটাসও একই বিষয়ে। একজন লিখেছেন, এই কৌতুক শালীনতার সকল মাত্রা অতিক্রম করেছে। ** ****কে হাতের কাছে পাইলে ডট ডট ডট।
এরপরের স্ট্যাটাসে আরেকজন শাহবাগে ইভেন্ট খুলেছেন। কৌতুককারীর বিচার দাবি করে। বিশ হাজার মানুষ গোয়িং দিয়েছে।
এরপরের স্ট্যাটাস কৌতুককারীর পক্ষে একটি ইভেন্টের ডাক দিয়ে। এখানেও বিশ হাজার গোয়িং।
এরপরের স্ট্যাটাস কিছুটা অন্য রকম। একজন নরমপন্থী মানুষ লিখেছেন, সে তো কিছু করে নাই। শুধু বলছে। বলা কি অন্যায়?
এরপরে স্ট্যাটাস পুরোটাই অভিনেতার বিরুদ্ধে। লিখেছেন জনৈক নারীবাদী। এই কৌতুকের মাধ্যমে নারী জাতিকে হেয় করা হয়েছে। এই রকম অপমান ইতিহাসে নজির বিহীন। এই লাঞ্ছনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাকেও হার মানিয়েছে। গ্রিক ট্রাজেডি এর কাছে তুচ্ছ।
তারপরের স্ট্যাটাসটি কিছুটা অনুসন্ধানমূলক। একজন লিখেছেন, ভাই, পুরা ভিডিও’র লিংক হবে? সে কি আর কোনো জোকস কইছে?
এরপরের স্ট্যাটাসটি দিয়েছেন একজন খাদ্য এবং পুষ্টি বিশেষজ্ঞ। ভাবলাম, নিশ্চয়ই এটা কৌতুক বিষয়ক না। ওমা। তিনি এই ভিডিও’র সূত্র ধরে, দুধের সর বিষয়ক একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখা দিয়েছেন। এই কৌতুকটি কীভাবে বাংলাদেশের পুষ্টিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে, প্রাঞ্জল ভাষায় সেটি বর্ণনা করেছেন।
এই স্ট্যাটাস শেষ করার আগেই ভেসে উঠলো নামকরা এক অভিনেত্রীর স্ট্যাটাস। তিনি অভিনেতাকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন। তার সাথে কাজ করেছেন। এই অভিনেতার মতো ভালো ছেলে হয় না, হলেও বাঁচে না। *** (ওই অভিনেতা) সব সময় রঙ চা খায়। সে দুধ ছোয় না। দুধ এবং ক্রিমার বিহীন কফি খায়। এমনকি যে দই তিনি খান, সেটাতেও কোনো দুধ থাকে না বলে দাবি করেছেন এই অভিনেত্রী।
এরপরের স্ট্যাটাসটিও একই বিষয়ে। আমি খুবই আগ্রহ নিয়ে সেটি পড়ে শোনাতে যাচ্ছি, এমন সময় ছেলেটি বলল, স্টপ। কিছু মনে করো না। আমার মাথা ধরছে। কাল আসি?
পরের দিন ছেলেটি আসলো। ততক্ষণে বিষয়টি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়ে গেছে।
সরকার সমর্থক একজন লিখেছেন, সারাদেশ যখন উন্নয়নে মহাসড়কে ধাবমান, তখন হঠাৎ করে এই কৌতুক বলার মানে কি? জাতির দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার পেছনে কোনো আন্তজার্তিক ষড়যন্ত্র আছে কিনা, সেটি তদন্ত করে দেখার জোর দাবি জানাচ্ছি।
তবে সব সরকার সমর্থকের বক্তব্য অবশ্য এই রকম নয়। সরকার সমর্থক আরেকজন স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ভেজাল দুধে সর পড়ে না। কৌতুক হচ্ছে সমাজের প্রতিচ্ছবি। এই কৌতুকের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে দেশ আজ ভেজাল এবং দুর্নীতিমুক্ত। অভিনেতা সেই সঠিক চিত্রটিই কৌতুকের মাধ্যমে তুলে এনেছেন। যদিও কতিপয় চক্রান্তকারী তার কৌতুক নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে নেমেছে। **** কে আগামী নির্বাচনে খুলনা দুই আসনে …..
এর নিচে আরেকজন কমেন্ট করেছে, কাকে চক্রান্তকারী বলছেন? মুখ সামলে কথা বলবেন। আপনি তো হাইব্রিড…
এরপরে কমেন্ট, তুই ফার্মের মুরগি।
এই কৌতুক নিয়ে বিরোধী দলীয় এক বিপ্লবী কর্মীর বক্তব্যও আছে। সরকারের ব্যর্থতা থেকে জাতির দৃষ্টিতে অন্য দিকে ঘুরিয়ে একপাক্ষিক নির্বাচনের জন্য যে আয়োজন, জাতি সেটা মেনে নেবে না।
এরপরের আরও দেড় দুই সপ্তাহ ওই বিষয়ে আলোচনা চলেছিলো। আপনারা যারা যারা স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের স্ট্যাটাস আমি এই তরুণ গবেষককে পড়ে শুনিয়েছি। কারোটা বাদ রাখিনি।
এরপর দীর্ঘদিন যায় সেই গবেষকের আর কোনো খোঁজ নাই। মাস দুয়েক পর তার একটি মেইল পেলাম। সে জানালো, তার গবেষণার টাইটেল সে সামান্য পরিবর্তন করছে। সোশাল মিডিয়ায় সাজু খাদেম বিষয়ক ডিসকোর্স এবং কাউন্টার ন্যারেটিভ।
পরের মাসে আরেকটি মেইল পেলাম। সে পিএইচডি প্রোগ্রাম থেকে নিজেকে উইথড্র করে নিয়েছে। এর বদলে সে একটা বই লিখছে। বইটার নাম: সাজু খাদেমের বুক এবং আমাদের মাথা।
এরপরের মাসে সে আরেকটি মেইল পাঠালো। তার বই লেখার কাছ চলছে। বইয়ের একটা ডামি ছবি সে পাঠালো। মোটামুটি ডিকশনারি টাইপের বই। বইটার নামও দেখলাম বদলে গেছে: দি মিল্কি ওয়ে অব সাজু খাদেম এরপর দুই মাস কোনো মেইল নেই। আরও এক মাস যাবার পর আরেকটি মেইল পেলাম। সেই তরুণ গবেষক মেইলটি পাঠিয়েছেন। তবে সরাসরি আমাকে নয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধানকে লেখা। আমি সিসিতে। মেইলটির বিষয় যথেষ্ট কৌতুহলউদ্দীপক। তরুণ গবেষক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কোর্স চালু করার কথা বলেছেন, যার নাম হবে সাজু খাদেম কোর্স। এই কোর্সটি চালু করা কত জরুরি, কেন জরুরি, এটাই তিনি প্রফেসরকে ব্যাখা করেছেন। বলাবাহুল্য, সেই প্রফেসর সেই মেইলের কোনো উত্তর দেননি। আমিও না।
এরপরের মাসে গবেষক আমাকে আরেকটি মেইল পাঠালেন। কোনো টেক্সট নাই । শুধু ছবি। গবেষকের হাতে আঁকা একটা ট্যাটু। ট্যাটুতে লেখা, এসকে । এসকে মানে কি? সাজু খাদেম?
এই গবেষক বিষয়ক সর্বশেষ মেইল পাই আমি গত মাসে। জনৈক সাইক্রিয়াট্রিস্ট আমাকে মেইল করেছেন। তার একজন রোগী সম্পর্কে তিনি আমার সাহায্য চেয়েছেন। রোগী বঙ্গীয় সোশাল মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে খানিকটা অসুস্থ। তার যথাযথ চিকিৎসা চলছে। তিনি শুধু আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, হোয়াট ইজ সাদু খাদেম?
আমি কোনো উত্তর দেইনি। মানুষের জীবন নষ্ট করা ঠিক না।
আশীফ এন্তাজ রবি : লেখক, সাংবাদিক।
[মত-দ্বিমত বিভাগের সব মতামত লেখকের নিজস্ব]