Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছয়জাতি পরমাণু চুক্তি, ফিরতে হবে পৃথিবীর স্বার্থেই

অলোক আচার্য
৬ আগস্ট ২০২২ ২০:১৫

পারমাণবিক চুক্তির পুনরুদ্ধারের ইস্যুটির কোনো সমাধানের পথ দেখছে না। বিষয়টি দীর্ঘ সময় ধরেই ঝুলে আছে। কয়েক দফা আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু কার্যত তেমন কিছুই হয়নি। ইরানের সাথে পরমাণু ইস্যু নিয়ে পশ্চিমা দেশের সাথে দীর্ঘদিন টানাপোড়েন চলছে। সম্প্রতি ইরানের পারমাণবিক সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি বলেছেন, পারমাণবিক বোমা তৈরির কারিগরী সামর্থ্য ইরানের আছে, তবে এই বোমা তৈরির পরিকল্পনা তাদের নেই।

বিজ্ঞাপন

১৯৭০ এর দশকে রাজতান্ত্রিক শাসনে ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় প্রথম পরমাণু প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর এই প্রকল্প থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে দাঁড়ালেও ইরান প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখে। ২০১৮ সালে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে পরমাণু চুক্তিতে ফেরার ঘোষণা দেন। ইরানকে পারমাণবিক শক্তিসমৃদ্ধ দেশ হতে না দেওয়ার পাশাপাশি ইসরায়েলকে সামরিক সাহয়তা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইসরায়েলের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদ। এমনকি প্রয়োজনে ইরানের পরমাণু অস্ত্র ঠেকানোর শেষ পন্থা হিসেবে শক্তি ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে চুক্তিতে। এইতো দিনকয়েক আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো চার দিনের মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন জো বাইডেন।

বিজ্ঞাপন

এদিকে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিও উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে। যদিও ইরান বলেছে এ কর্মসূচি পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য নয়। কিন্তু তা বিশ্বাস যোগাতে সক্ষম হয়নি। ইরানের পরমাণু অস্ত্র ইসরায়েলেরও মাথা ব্যাথার কারণ। নতুন করে ধ্বংসাত্বক অস্ত্র আবিষ্কৃত হলেও এখনও মানুষের মনে যে অস্ত্র ভীতির সঞ্চার করে তা হলো পরমাণু অস্ত্র। বিভিন্ন দেশের উত্তেজনায় পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার না হলেও মাঝে মধ্যেই তা হুমকি হিসেবে দেখা দেয়।

এদিকে পারমাণবিক চুক্তির পুনরুদ্ধারের ইস্যু ও চুক্তির সফলতা নিয়ে আগ্রহী সারাবিশ্ব। সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সময় পাঁচ জাতিগোষ্ঠির সাথে তেহরান ছয় দফা আলোচনা করেছে। রাইসি নির্বাচিত হওয়ার পর কিছুদিন এই সংলাপ বন্ধ ছিল। ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনোমালিন্যের অন্যতম ইস্যু হলো ইরানের পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধকরণ। প্রায় ঝুলতে থাকা চুক্তিটি পুনরায় ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন প্রচেষ্টা হচ্ছে। তবে এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি আসেনি। এক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে উভয় দেশের এবং সংশ্লিষ্ট নেতাদের।

ট্রাম্পের সময়ে চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার পর যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক অবনতি ঘটতে থাকে। সেই উত্তেজনা প্রশমনের সমাধান ইরানের পরমাণু চুক্তি মেনে চলা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু চুক্তিতে ফিরে আসা দরকার। আর এসব কিছুর মাঝে প্রয়োজন আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা না হলে সম্পর্কের অবনতি ঘটতেই থাকবে এবং কার্যকর কোনো সমাধানে আসা সম্ভব হবে না। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সমৃদ্ধকরণ ইস্যুটি নিয়ে যে কার্যকর সিদ্ধান্ত উভয়পক্ষ থেকে আসা প্রয়োজন রয়েছে সেগুলোও আসছে না। ফলে আপাতত অনিশ্চয়তার ভেতরেই থাকছে এ চুক্তি। বিপরীতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। আলোচনা সম্ভব হলে কোনো ইতিবাচক ফলাফল হবে কি না। সেই সম্ভাব্যতা কতটুকু? যদি ইরানকে একতরফাভাবে পরমাণু কর্মসূচি প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেওয়া হয় তাহলে হয়তো কোনো সমাধান হবে না। আলোচনা সফল হলে ইরানের ওপর থেকে আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার হতে পারে।

২০১৫ সালের জুনে ভিয়েনায় ইরানের সঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্য রাষ্ট্রসহ ছয়টি পরাশক্তি দেশের সাথে- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানি পরমাণু চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করার প্রতিশ্রুতি দেয় তেহরান। চুক্তি অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ কাজেই ইরানের এই কর্মসূচি ব্যবহার করার কথা। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিয়েই ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইউরেনিয়াম বৃদ্ধির মাধ্যমে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে চায়। এর আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, ইরান কখনো পরমাণু অস্ত্রের মালিক হতে পারবে না। সে সময় এসব উত্তেজনার মধ্যেই আগুনে ঘি ঢালার মতো ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধের মাত্রা বৃদ্ধি করে ৫ শতাংশে উন্নীত করার খবর প্রকাশিত হয় এবং তা আরও বেশি উত্তেজনার সৃষ্টি করে। চুক্তিতে এটি সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ করার কথা ছিল।

জো বাইডেনের পূর্বে ক্ষমতায় আসা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতার প্রথম দিকে ইরানের সাথে সম্পর্ক এতটা সংকটপূর্ণ ছিল না। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর পূর্ব থেকেই পরমাণু এ চুক্তির বিরোধীতা করতেন এবং পূর্বসরি ওবামা আমলে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিকে ‘ক্ষয়িষ্ণু ও পচনশীল’ আখ্যা দিয়ে ২০১৮ সালের মে মাসে তা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তেহরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরপর থেকে ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি পুনরায় গতিশীল করে। পরমাণু সমঝোতায় ইরানকে সর্বোচ্চ ৩০০ কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম মজুত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ইরান ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত ওই সমঝোতা মেনে চলেছিল। তেহরান বারবার বলে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে ফিরলে এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েলে ইরান তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে। অর্থাৎ এখানে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের ওপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ইরানের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার বিষয় যা ইতিপূর্বেও সামনে এসেছে।

পরমাণু চুক্তিতে ফেরা গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, পৃথিবী আর পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতা দেখতে চায় না। আধুনিক অস্ত্র যে নামেই আসুক পারমাণবিক বোমাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি কোনো মারণাস্ত্রই। কারণ পৃথিবী এই অস্ত্রের বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছে। তাই পৃথিবী নিত্যনতুন অস্ত্রে সজ্জিত হলেও পারমাণবিক বেমার কথা আসলেই চোখের সামনে এক বিরাট ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র ভেসে ওঠে। কোনো যুদ্ধ শুরু হলেই সামনে আসে পারমাণবিক অস্ত্র ক্ষমতার কথা। এই যে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ চলছে সেখানেও বারবার এসেছে পারমানবিক অস্ত্রের প্রয়োগের সম্ভাবনা। রাশিয়া এই অস্ত্র প্রয়োগ করবে কি না তাই নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এমনকি স্নায়ু যুদ্ধের পর থেকে আগামী বছরগুলোতে প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

সম্প্রতি স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিচার্স ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) এর বেশ কয়েকটি নতুন গবেষণা ফলাফলে এমন ধারণা পাওয়া যায়। এসআইপিআরআই বলছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ এবং কিয়েভের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন বিশ্বের ৯টি পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। জানুয়ারি ২০২১ থেকে জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা কিছুটা কমলেও পারমাণবিক শক্তিগুলো আশু পদক্ষেপ না নিলে শিগগিরই কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো বিশ্বে এ ধরনের যুদ্ধাস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু হতে পারে। জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মোট ৫ হাজার ৯৭৭টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে রাশিয়ার, যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় ৫৫০টি বেশি। বিশ্বে মোট পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের ৯০ শতাংশেরও বেশি এই দুই দেশের কাছে আছে। সুতরাং কোনোভাবে এর প্রয়োগ শুরু হলে পৃথিবীর অস্তিত্ব যে থাকবে না সেটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।

কিন্তু প্রশ্ন হলো এই ধ্বংসক্ষমতা জানা সত্ত্বেও কেন একেবারে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়া যাচ্ছে না? এর দায় মূলত শক্তিধর দেশগুলোর ব্যর্থতা। ক্ষমতা প্রদর্শন এবং নিজের প্রভাব বলয় ধরে রাখতে অস্ত্রের প্রয়োজন। আর পারমাণবিক অস্ত্র এক্ষেত্রে অন্যতম শক্তি হিসেবে কাজ করে। মোট কথা, আগের চেয়ে এখন পৃথিবীতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্টিফেন লাভগ্রোভ বলেছেন, পশ্চিমারা পরমাণু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি নিচ্ছে। কারণ তারা রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে যথেষ্ট কথা বলছে না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও বলেছেন, পারমাণবিক যুদ্ধ হলে কেউ বিজয়ী হতে পারে না। যুদ্ধ কখনোই করা উচিত নয়। সুতরাং ছয়জাতির পরমাণু চুক্তিটি পুর্নজ্জীবিত হওয়া প্রয়োজন এবং তা পৃথিবীর স্বার্থেই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মুক্তগদ্য লেখক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অলোক আচার্য ছয়জাতি পরমাণু চুক্তি- ফিরতে হবে পৃথিবীর স্বার্থেই মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর