বঙ্গমাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের ‘বিজয়-লক্ষ্মী’ নারী
৭ আগস্ট ২০২২ ১৮:৩৬
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘নারী’ কবিতায় বলেছেন, ‘কোন কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি/প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী/’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে বিজয়-লক্ষ্মী নারী ছিলেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণীই ছিলেন না, ছিলেন পরম বন্ধু, সকল লড়াই সগ্রামের সহযোদ্ধা।
বেগম মুজিব কখনোই কোনো কাজে বঙ্গবন্ধুর বাঁধা হয়ে দাঁড়ান নি বরং প্রতিটি কাজে সবসময় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে তাকে বারবার কারাগারে যেতে হয়েছে। তিনি কারাগারে থাকা অবস্থায় বেগম মুজিব নানা সংকট মোকাবিলা করে সংসার সামলেছেন। সন্তানদের লেখা-পড়া সহ সংসারের যাবতীয় কাজ করেছেন। তিনি একই সাথে সন্তানদের মা ও বাবার ভূমিকা পালন করেছেন। এসব নিয়ে তিনি কোনোদিনও স্বামীর প্রতি কোনো রকম অভিযোগ করেননি। বরং নিজের সর্বশক্তি দিয়ে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। জাতির পিতার মতো তিনিও বাংলার মানুষের মুক্তির জয়গান করেছেন।
বঙ্গমাতা দেশকে এতটাই বেশি ভালোবাসতেন যে, এজন্য পশ্চিম পাকিস্তানিদের মোটেও সহ্য করতে পারতেন না। অনেক সময় বঙ্গবন্ধুকে ম্যানেজ করতে না পেরে পাকিস্তানি নেতারা বেগম মুজিবের স্মরণাপন্ন হতেন। তারা বাসায় এলেও বেগম মুজিব কখনো তাদের মুখোমুখি হতেন না, পর্দার আড়াল থেকে কথা বলতেন। পরিবারের সদস্যদের বলতেন, ‘ওদের সাথে তো আমরা থাকবো না, তাহলে কেন দেখা করব? ওদের চেহারাও আমার দেখতে ইচ্ছে করে না। ‘বঙ্গবন্ধু এম.এন.এ, এমপি-মন্ত্রী থাকাকালে অনেক বার পশ্চিম পাকিস্তানে গেছেন। কিন্তু বেগম মুজিব একবারের জন্যও তার সফর সঙ্গী হন নি। তিনি কখনোই পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে চাইতেন না। পাকিস্তানিদের প্রতি ছিল প্রচন্ড ক্ষোভ ও ঘৃনা।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেপ্তার হন। সর্বশেষ পাকিস্তান সরকার ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করে। ৭ জুন ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু সহ আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে দেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট সফল করতে বেগম মুজিব নেপথ্যে কার্যকরী ভুমিকা পালন করেন। গোয়েন্দা নজরদারি এড়িয়ে বিভিন্ন স্থানে ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিতেন।
বঙ্গমাতার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানে আলোচনার জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন আইয়ুব খান। কিন্তু সেখানে বাধ সাধেন বেগম মুজিব। তিনি বঙ্গবন্ধুকে খবর পাঠালেন তার সাথে আলোচনা না করে যেন কোন সিন্ধান্ত না নেন। বেগম মুজিব দেখা করে বঙ্গবন্ধুকে জানালেন, দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ আছে। বঙ্গবন্ধু সহ ৩৫ রাজবন্দী সকলকেই মুক্তি দিলেই একমাত্র গোলটেবিল বৈঠক হতে পারে। অন্যথায় নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বেগম মুজিবের সিন্ধান্ত কতটা সঠিক ছিলো। এক পর্যায়ে আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তখনই তিনি শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধুতে পরিনত হন।
বঙ্গমাতা ছিলেন জাতির পিতার একজন উত্তম পরামর্শদাতা। রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পূর্বে যখন দলের নেতারা সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছিল তখনও এগিয়ে এসেছিলেন বেগম মুজিব। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘তুমি সারাজীবন সংগ্রাম করেছ, তুমি জেল-জুলুম খেটেছ, দেশের মানুষকে নিয়ে তোমার যে স্বপ্ন, বাংলার মানুষকে তোমার চেয়ে বেশি কেউ ভালোবাসে না, তোমার মনে যা আসে তুমি তাই বলবা’। বেগম মুজিবের এই টনিকই বঙ্গবন্ধুকে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। সেখানে তিনি সরাসরি ঘোষণা না দিয়েও স্বাধীনতার ঘোষণা কার্যত দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দু’টি ইতিহাসের অমূল্য দলিল। এই আত্মজীবনী লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বেগম মুজিব। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু নিজেই এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেল গেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনি। বললাম, লিখতে যে পারিনা; আর কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকুই বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করছি। বঙ্গবন্ধু বেগম মুজিব সম্পর্কে আরো বলেছেন, ‘আমার স্ত্রী যার ডাকনাম রেণু-আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল, তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’ এই লেখাগুলো বঙ্গমাতা চরম দুর্যোগের সময়ও সযত্নে আগলে রেখেছিলেন। সে কারণেই আজ বই দু’টো প্রকাশিত হওয়ার পর মানুষ ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য জানতে পারছে।
বঙ্গমাতা সম্পর্কে তার বড় কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বক্তব্যে মায়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন- ‘বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, লড়াই, সংগ্রামে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে কিন্তু কখনো মাকে ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। যতো কষ্টই হোক আমার বাবাকে কখনোই বলেননি যে তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা সংসার করো বা খরচ দাও। আব্বা যে পদেক্ষেপ নিতেন সেটাকেই সমর্থন করতেন তিনি।’ এজন্যই হয়তো নারী জাগরণের অগ্রতূত বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ‘কন্যারা জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত দেশমাতৃকার মুক্তি অসম্ভব।’ বেগম মুজিব নারী শক্তিরই রূপ। এ দেশের নারীরা জেগে উঠেছিল বলেই বাঙালিরা পাকিস্তানি শাসকদের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সঙ্গী ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ঘাতকরা যখন তার চোখের সামনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তখনও তিনি বাঁচার জন্য একবারও আকুতি করেন নি। বরং তিনি বলেছেন, ‘ওনাকে যখন মেরে ফেলেছ আমাকেও মেরে ফেলো।’ বাঙালির এই মহিয়শী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ১৯৩০ সালের ৮ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। আজকের শুভ জন্মদিন বঙ্গমাতাকে জানাই হাজারো প্রণতি।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
তাপস হালদার বঙ্গমাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের ‘বিজয়-লক্ষ্মী’ নারী মত-দ্বিমত