আর কত ধাক্কা সামলাবে মানুষ?
৮ আগস্ট ২০২২ ১৪:৪৯
হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দেওয়ায় দেশের মানুষ দারুণভাবে ধাক্কা খেয়েছে। অবশ্য বাজারে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ধাক্কা খেতে হচ্ছে। কবে কোন জিনিসের দাম কত বাড়বে তা কারোই আগে থেকে জানা থাকে না। দেশে বেশির ভাগ মানুষের আয় সীমিত, সেটা স্থির কিন্তু ব্যয় বাড়ছে, বাজারে অস্থিরতা নিয়মিত। তবে এটা ঠিক দেশে আবার অঢেল টাকার মালিকও আছেন, তাদের পকেট এতটাই গরম যে বাজারের গরম তার কাছে তুচ্ছ। গরমে গরম ক্ষয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের অবস্থা তো ত্রাহি মধুসূদন। মানুষ এখনও অনাহারে থাকছে না হয়তো কিন্তু স্বল্পাহার শুরু হয়েছে কম আয়ের মানুষের পরিবারে।
এরমধ্যেই হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের দাম বিপুল পরিমাণে বাড়ানোর ঘোষণায় মানুষ ধাক্কা খেয়েছে বললে কমিয়ে বলা হবে, অনেক মানুষের আসলে উপুড় হয়ে পড়ার অবস্থা। একেবারে দিন আনে দিন খায় মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ সবাই কম-বেশি জ্বলছেন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির জ্বালায়। সরকার অর্থাৎ যারা দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের নিশ্চয়ই কিছু যুক্তি আছে। তবে সবচেয়ে বড় যুক্তি আন্তর্জাতিক বাজারের। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদের তো কম রাখার উপায় থাকে না। কারণ আমাদের জ্বালানি তেলের সিংহভাগই আমদানি করতে হয়। বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করলে লোকসান হবে, সেটা কারও না বোঝার কথা নয়। ট্যাকে টাকার মোটা মোটা বান্ডেল থাকলে হয়তো লাভ-লোকসানের হিসাব একটু কম করলেও চলে। কিন্তু আমাদের সরকারের কাছে বাহুল্য ব্যয়ের জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা, এখানে অবশ্য ডলার, মজুত নেই। ঋণ করে ঘি ঘাওয়ার সুযোগও এখন সীমিত হয়ে এসেছে। মহাজনরা এখন চাইলে ঋণ বা লোন দেয় না। সবাই এখন সাবালক হয়ে উঠেছে। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই না করে কেউ আর লোন দিতে চায় না।
এখন প্রশ্ন হলো, এটা না হয় বোঝা গেলো যে, আন্তর্জাতিক বাজার চড়া হওয়ায় এবং সরকারের পক্ষে আর ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব নয় বলে জ্বালানি তেলের মূল্য না বাড়িয়ে কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েই মধ্যরাত থেকেই যে বাড়তি দাম আদায় শুরু হলো, এটা কেন? আগের কেনা তেলের মজুত শেষ হলে এবং বেশি দামে কেনা তেল দেশে আসার পর মূল্যবৃদ্ধি কার্যকর করা কি যুক্তিযুক্ত ছিল না? এই মজুত তেল বেশি দামে বিক্রি করে যে মুনাফা হবে সেটা কার পকেটে যাবে? সরকারের কাছে যাবে, না পাম্প মালিক বা জ্বালানি তেলের ডিলারদের পকেটস্থ হবে?
এটা বুঝতে বড় হিসাববিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই যে, জ্বালানি তেলের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পরিবহন, কৃষি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামসহ সমাজের সর্বত্র পড়বে। দেশের অর্থনীতি করোনার ভয়াবহতা আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নতুন করে বিপদের মুখে পড়ল। বেঁচে থাকার লড়াই চালাতে হিমশিম অবস্থায় পড়তে হবে হবে নিম্ন আয়ের মানুষদের।
গত শুক্রবার রাত ১২টা থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কথা ঘোষণা করা হয়। মাঝরাতেই এক ধাক্কায় ৮০ টাকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী, ৮৬ টাকার পেট্রলের দাম ১৩০ এবং ৮৯ টাকার অকটেন ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই দাম বৃদ্ধির ফলে জ্বালানি তেলে সরকারকে কোনো ভর্তুকি দিতে হবে না। বরং লাভই থাকবে। আর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে সরকারের লাভের পরিমাণ আরও বাড়বে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, দাম বাড়ার কারণে বিপিসির কোনো সাশ্রয় হবে না। বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে তুলনা করলে ডিজেলের খরচ পড়ে ১২২ টাকা। আমরা বাড়িয়ে করেছি ১১৪ টাকা। সুতরাং ডিজেলে লোকসান থেকেই যাবে। ভবিষ্যতে তেল আমদানি করতে গেলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই।
দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আইএমএফের কোনো চাপ ছিল কি না—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের ওপর কোনো চাপ ছিল না।’
দেশে যত পরিমাণ জ্বালানি তেল ব্যবহার হয় তার ৭৩ শতাংশই ডিজেল। গণপরিবহন, কৃষি, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যাপক ব্যবহার আছে। আর ডিজেলের জন্য সরকারের ব্যয় হয় সর্বাধিক। দাম বাড়ানোর পরেও এই ডিজেলে প্রতি লিটারে ৮ টাকা করে ভর্তুকি দিতে হবে বলে জানিয়েছেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী।
বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে দাম বাড়ানো হলেও সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ১ আগস্ট প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ছিল ১৩৮ ডলার। ৪ আগস্টে তা কমে ১৩৪ ডলার হয়। ডলারের সরকারি বিনিময় হার ৯৪ দশমিক ৭০ টাকা হিসাবে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ১৩৪ ধরলেও বাংলাদেশে এক লিটার ডিজেলের দাম পড়ে ৮০ টাকার মতো। বর্তমানে ডিজেলের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে লিটার প্রতি ভ্যাট ও ট্যাক্স ২৫ টাকা বাদ দিয়েও ৫-৬ টাকা লাভ থাকবে। আর আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম পড়তে শুরু করেছে। সামনে বিশ্ববাজারে ডিজেল উৎপাদনকারী বেশ কিছু রিফাইনারি উৎপাদনে আসবে। তখন ডিজেলের মূল্য আরও কমবে। তখন কি আমাদের দেশে দাম কমবে?
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা কনডেনসেট থেকে উৎপাদিত পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ একটি গেজেট প্রকাশ করে। ওই গেজেট অনুসারে বিপিসি মূল্য সংযোজন কর দেওয়ার পর ৪৯ টাকা লিটার দরে পেট্রল কিনে। অন্যদিকে অকটেন কেনে ৫৫ টাকা লিটারে দরে। আর কেরোসিন কেনে প্রতি লিটার ৪৮ টাকা দরে। গত শুক্রবার নতুন নির্ধারিত মূল্য তালিকা অনুযায়ী, পেট্রল, অকটেন ও কেরোসিনের কেনা ও বিক্রির দামে পার্থক্য বিপুল। এই হিসাবে পেট্রল বিক্রি করে ৮১ টাকা, অকটেনে ৮০ টাকা এবং কেরোসিনে ৬৬ টাকা লাভ করবে বিপিসি। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, অকটেন ও পেট্রলের চাহিদা দেশে উৎপাদিত গ্যাসের উপজাত থেকে মেটানো হয়।
এক লাফে এত বেশি দাম বাড়ানোর জন্য গরিব মানুষেরাও প্রকাশ্যে এমন সব মন্তব্য করছেন, যা কয়দিন আগেও অকল্পনীয় ছিল। স্বল্প আয়ের মানুষেরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। এক সঙ্গে এত দাম বাড়নোয় সবকিছুর দামে যে নৈরাজ্য শুরু হলে খেয়ে-পরে থাকাই তো কঠিন হয়ে যাবে। অথচ সরকারের উচিত হলো মানুষের কষ্ট কমিয়ে স্বস্তি দেওয়া। উল্টো মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তোলার পরিণতিতে রাজনীতির মাঠও গরম হয়ে ওঠার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বাড়ানোর বিষয়টি ভার্চুয়াল জগতেও রীতিমতো সমালোচনা আর ক্ষোভের উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা মন্তব্য, কার্টুন, ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এতে সরকারের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। দামবৃদ্ধির কারণে মানুষের যে কষ্ট বাড়ছে সেটা উপলব্ধিতে নিয়ে মন্ত্রী এবং সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের যখন সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন, অহেতুক ও অযৌক্তিক কথা বলা থেকে বিরত থাকা উচিত। কিন্তু এখনও তারা এমন সব কথা বলছেন, যা মানুষকে বিভ্রান্ত ও উত্তেজিত করছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমছে, তাই এই মুহূর্তে দাম বাড়ানো যুক্তিযুক্ত নয়। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা যেত। তিনি বলেন, ‘একেবারেই ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানোরও কোনো যৌক্তিকতা পাচ্ছি না। এখন যে পরিমাণ দাম বেড়েছে, আর আন্তর্জাতিক বাজারে যে দাম কমছে, তাতে তো বিপিসির ভর্তুকি কাটিয়ে লাভও থাকবে। কিন্তু অর্থনীতির এ কঠিন সময়ের বিপিসির তো লাভের চিন্তা করা উচিত নয়।’ তিনি বলেন, দাম বাড়ার প্রভাবে সব ধরনের পরিবহনের খরচ বাড়বে। এতে মানুষের যাতায়াতের খরচসহ সব ধরনের পণ্য পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। ব্যবসা-উদ্যোক্তা-সরবরাহ সব পর্যায়ে খরচ বেড়ে যাবে। খরচ বাড়লে উৎপাদন কমে যাবে। উৎপাদন কমে গেলে সরবরাহ কমে যাবে, জিনিস পত্রের দাম বেড়ে যাবে। এতে দরিদ্র আরও দরিদ্র হবে, আবার দারিদ্র্যসীমার ওপরের লোকজন দরিদ্র সীমার নিচে নেমে আসবে।
অবশ্য আইএমএফের সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট–পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, সরকারের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি খুবই সাহসী ও কঠিন সিদ্ধান্ত। এই দাম বাড়ার কারণে অর্থনীতিতে প্রাথমিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও আগামী ছয় মাস পর এই সিদ্ধান্তের ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে।
পাদটীকা: এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি কতটা মার হজম করতে পারো?
ওই ব্যক্তির জবাব: ধরে বেঁধে যতো।
মানুষ ক্রমাগত নানামুখী ধাক্কা সামলে চলছে। এটা কিন্তু স্বাভাবিক নয়। এক সময় তাদের সহ্য শক্তি আর অবশিষ্ট থাকবে না। তখনকার কথাটা বিবেচনা করেই ধরে বেঁধে মারাটা অব্যাহত রাখা না-রাখার সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি