নারী-শিশু পাচারকারীর জাল সারাদেশে
১৩ আগস্ট ২০২২ ১২:৫৪
মানুষের জীবন বড়ই রহস্যময়। মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে ছুটে চলে আমৃত্যু। উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে জীবিকার অন্বেষণে দরিদ্র দেশগুলো থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ ছুটে যায় উন্নত দেশে। শুধু একটু ভালো জীবন খুঁজে পেতেই এই ছুটে চলা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! জীবিকার অন্বেষণে পা চলে যায় মরণফাঁদে। বেশিরভাগেরই কপালে জুটেছে নির্মম মৃত্যু। তাদের দেওয়া হয়েছে গণকবর, নয়তো লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে নদীতে। অনেকের ঠাঁই হয়েছে বিভিন্ন দেশের শরণার্থী শিবির ও বন্দিশালায়। এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে ভারতে মানবপাচার অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে; যা বন্ধে কাজ করছে উভয় দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।
তবুও এ মানবপাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। উল্টো সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে নারী ও শিশু পাচারের সংখ্যা বেড়েছে। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির গত বছরের তথ্য বলছে, ১০ বছরে ভারতে পাচারের শিকার অন্তত দুই হাজার বাংলাদেশি নারী দেশে ফিরেছেন। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তেলেঙ্গানার প্রধান শহর হায়দরাবাদ থেকে সেখানকার এন্টি হিউম্যান ট্রাফিকিং ইউনিট (এএইচটিইউ) দুই বাংলাদেশি বেশ কিছু নারী ও শিশুদের উদ্ধার করেছে। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে ছয় মাস বয়সী শিশুও ছিল। তাদের পাচারের অভিযোগে এরই মধ্যে এক বাংলাদেশি নারীসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভারতীয় পুলিশ বলছে, মোটা বেতনে চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে একটি চক্র বাংলাদেশি নারী ও শিশুদের দেশটিতে নিয়ে আসছে। এ চক্রের মধ্যে বাংলাদেশি পাচারকারীরাও রয়েছেন। পাচার হওয়া এসব নারী-শিশুর সিংহভাগই নিন্মবিত্ত পরিবারের। বর্তমান বিশ্ব যেসব সমস্যায় আক্রান্ত তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ ও মানবপাচার।
সবশেষে, গত ১০ আগস্ট ভারতে নারী পাচার চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। আসামিরা নারীদের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে সেখানকার যৌনপল্লীতে বিক্রি করতেন। সিআইডি সূত্রমতে, দুই বোনকে বেশি বেতনের প্ররোচণায় ঝিনাইদহের মহেশপুর থানার বাঘাডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে গত ২০২১ সালের ৪ মে অবৈধভাবে ভারতে পাচার করেন। ভারতে অবস্থানরত সহযোগীদের সহায়তায় দুই বোনকে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়। সেখানে দুই বোন যৌন নির্যাতনের শিকার হন। পরবর্তীতে যৌনপল্লী থেকে পালিয়ে ভারতীয় পুলিশের সহায়তায় এই দুই বোন এ বছরের ২২ মার্চ বাংলাদেশে ফেরত আসেন ও আদালতে জবানবন্দি দেন। পাচারকারীচক্রের নতুন যে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা তদন্তাধীন।
নারী ও শিশু পাচার একটি সামাজিক সমস্যা। স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশ যদিও উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে এসেছে; তথাপি নারী ও শিশু পাচার একটি জটিল সামাজিক সমস্যা ও অর্থ উপার্জনের জঘন্য উৎস হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। নারী ও শিশু পাচারের মতো জঘন্য কাজটি যে কতভাবে সংঘটিত হতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বল্পোন্নত দেশের জনগণের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণীর অসাধু মানুষ পাচারের কাজে লিপ্ত হয়। মধ্যযুগে মানুষকে যেভাবে ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার করা হতো, বর্তমানে পাচারের মাধ্যমে ঠিক তেমনিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাচারকৃত শিশুদের পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ে। এই পাচারের কারণে তার একটি পরিবারের সুখ-শান্তি, আশা-আকাঙ্খাও শেষ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের আজকের এ পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দীর্ঘদিনের অবহেলারই ফল। আর এরই সুযোগ নিয়ে মানব পাচারকারীচক্র সারাদেশে তাদের জাল বিস্তার করেছে। শুধু আইন নয়, আইনের কঠোর প্রয়োগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোর তৎপরতা এবং শক্তিশালী সীমান্ত ব্যবস্থাপনা থাকলেই মানবপাচার বন্ধ করা সম্ভব। আমরা চাই মানবপাচার রোধে সরকার অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। পাশাপাশি বেকারত্ব দূর করে কর্মদক্ষতার উন্নয়নে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। পাচারের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। যে কোনো মূল্যে এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা থামাতে হবে। মানব পাচারকারীচক্রকে বাংলাদেশ থেকে সমূলে নির্মূল করা হোক- এটাই হবে সুস্থ বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম নিয়ামক।
লেখক: কবি, সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি