‘দুপুরে মুজিবের লাশ টুঙ্গিপাড়া যাবে, সব ব্যবস্থা করেন’
১৪ আগস্ট ২০২২ ২২:০৮
“অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার ঢাকা থেকে টেলিফোন এলো। এবার অপরপ্রান্ত হতে বার্তা, ‘আমি ঢাকার এসপি আব্দুস সালাম বলছি। আপনি এসডিপিও বলছেন?’ ‘জী বলছি’ -বলতেই তিনি জানালেন, ‘দুপুরের মধ্যে হেলিকপ্টারে করে শেখ মুজিবের লাশ টুঙ্গিপাড়া যাবে। বাবা-মার কবরের পাশে তার লাশ দাফন করতে হবে। হেলিকপ্টার নামার ব্যবস্থা করবেন। বড় করে কবর খনন করে রাখবেন। যাতে কবরের মধ্যে কফিনসহ লাশ রেখে তাড়াতাড়ি মাটি দেওয়া যায়। ১৫ মিনিটের মধ্যে লাশ কবর দিয়ে হেলিকপ্টার ফিরে আসবে। হেলিকপ্টার নামানো, লাশ কবর দেওয়া এবং ঐ লাশ যাতে কবর থেকে কেউ উঠিয়ে নিতে না পারে সেজন্যে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। গোপালগঞ্জ পুলিশ লাইন এবং নিকটস্থ থানা/ফাঁড়ি হতে পুলিশ এনে টুঙ্গিপাড়ায় নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা করেন। যাতে আর্মিরা লাশ তাড়াতাড়ি দাফন করে নিরাপদে ঢাকায় চলে আসতে পারে।’ আমি জানতে চাইলাম, ‘স্যার, কয়টা কবর খনন করতে হবে?’ প্রশ্ন শুনে তিনি রেগে গিয়ে বললেন, ‘অত প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না। আপনি অফিসার না? যেটা ভাল বুঝেন করেন।’ বলে টেলিফোন কেটে দিলেন।
এসপি সালামের টেলিফোন পেয়ে আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়লাম। কারণ ঢাকার এসপি ছিলেন বীর বিক্রম মাহবুব উদ্দিন আহমদ। সালাম সাহেব কে, যিনি নিজেকে এসপি পরিচয় দিলেন! সাথে সাথে গোপালগঞ্জ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অপারেটকে ঢাকার পুলিশ কন্ট্রোলরুমে কানেকশন দিতে বলি। অল্প সময়ের মধ্যে কথা হলো, কন্ট্রোল রুমের অফিসারের সাথে। ডিউটি অফিসার জানালেন, মাহবুব সাহেব আর এসপি নেই। এখন ঢাকার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করছেন সিটি এসপি আব্দুস সালাম।”
সারাবাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ওপরের কথাগুলো বলেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাফন-কাফনে অংশ নেওয়া গোপালগঞ্জ মহকুমার তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম। সম্প্রতি রাজধানীর মগবাজারে নিজ ফ্ল্যাটে সারাবাংলাকে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন তিনি।
“১৫ আগস্টের রাতটুকু কোনওরকমে পার হলো। ১৬ আগস্ট শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে টেলিফোন বেজে উঠে। ফোন ধরার সাথে সাথে শোনা যায়, ‘বঙ্গভবন থেকে মেজর মুনিব বলছি। শোনেন, এসডিপিও সাহেব থানার পাশে আমাদের বাড়ি। ওখানে আমার বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার মুখলেসুর রহমান মা ভাইবোনদের নিয়ে থাকেন। তাদের প্রতি খেয়াল রাখবেন। যাতে কোনও অসুবিধা না হয়। আপনার কথা বাবার কাছে শুনেছি। নির্ভয়ে কাজ করেন। কোনও অসুবিধা হলে জানাবেন। টেলিফোন নাম্বার নোট করেন। দুটি টেলিফোন নাম্বার দিয়ে বললেন, আমি এখানে ডিউটি অফিসারকে বলে রাখছি আপনার টেলিফোন আসলে আমাকে জানাবে। ঠিক আছে?’ আমি ‘জী স্যার’ বলতেই তিনি টেলিফোন রেখে দিলেন।
বঙ্গভবন থেকে টেলিফোন এসেছে শুনে খুবই ভয় পেয়েছিলাম। পরে আলাপ করে ভয় অনেকটা কেটে যায়। থানার ওসিকে মেজর সাহেবের বাড়ি পাঠালাম, বঙ্গভবন হতে টেলিফোনের খবর দিতে এবং বাড়ির খবরাখবর জেনে আসতে। অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার ঢাকা থেকে টেলিফোন এলো। এবার অপরপ্রান্ত হতে বার্তা, ‘আমি ঢাকার এসপি আব্দুস সালাম বলছি। আপনি এসডিপিও বলছেন?’ ‘জী বলছি’ -বলতেই তিনি জানালেন, ‘দুপুরের মধ্যে হেলিকপ্টারে করে শেখ মুজিবের লাশ টুঙ্গিপাড়া যাবে। বাবা-মার কবরের পাশে তার লাশ দাফন করতে হবে। হেলিকপ্টার নামার ব্যবস্থা করবেন। বড় করে কবর খনন করে রাখবেন। যাতে কবরের মধ্যে কফিনসহ লাশ রেখে তাড়াতাড়ি মাটি দেওয়া যায়। ১৫ মিনিটের মধ্যে লাশ কবর দিয়ে হেলিকপ্টার ফিরে আসবে। হেলিকপ্টার নামানো, লাশ কবর দেওয়া এবং ঐ লাশ যাতে কবর থেকে কেউ উঠিয়ে নিতে না পারে সেজন্যে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। গোপালগঞ্জ পুলিশ লাইন এবং নিকটস্থ থানা/ফাঁড়ি হতে পুলিশ এনে টুঙ্গিপাড়ায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। যাতে আর্মিরা লাশ তাড়াতাড়ি দাফন করে নিরাপদে ঢাকায় চলে আসতে পারে।’ আমি জানতে চাইলাম, ‘স্যার, কয়টা কবর খনন করতে হবে?’ প্রশ্ন শুনে তিনি রেগে গিয়ে বললেন, ‘অত প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না। আপনি অফিসার না? যেটা ভাল বুঝেন করেন।’ বলে টেলিফোন কেটে দিলেন।
এসপি সালামের টেলিফোন পেয়ে আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়লাম। কারণ ঢাকার এসপি ছিলেন বীর বিক্রম মাহবুব উদ্দিন আহমদ। সালাম সাহেব কে, যিনি নিজেকে এসপি পরিচয় দিলেন! সাথে সাথে গোপালগঞ্জ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অপারেটকে ঢাকার পুলিশ কন্ট্রোলরুমে কানেকশন দিতে বলি। অল্প সময়ের মধ্যে কথা হলো, কন্ট্রোল রুমের অফিসারের সাথে। ডিউটি অফিসার জানালেন, মাহবুব সাহেব আর এসপি নেই। এখন ঢাকার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করছেন সিটি এসপি আব্দুস সালাম। টেলিফোন রেখেই পুলিশ লাইনের ইমারজেন্সি ফোর্সের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর শেখ মো. ইছাক ফকিরকে বলি লাইনের সব ফোর্সকে অস্ত্রসজ্জিত করে দুপুরের খাবার খাইয়ে টুঙ্গিপাড়া পাঠানোর জন্য রেডি করতে। পুলিশ বেতারের মাধ্যমে সার্কেল ইন্সপেক্টর শেখ আব্দুর রহমানকে আমার অফিসে আসার নির্দেশ দিয়ে টুঙ্গিপাড়া থানায় যোগাযোগের জন্য তাড়াতাড়ি পায়ে হেঁটে গোপালগঞ্জ সদর থানায় চলে যাই। পুলিশ বেতারে টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি আব্দুল জলিল শেখের সাথে কথা হয়। তাকে ঢাকার নির্দেশ অনুযায়ী দ্রুততার সাথে ব্যবস্থা নিতে বলি।
পাশের বাঁশবাড়িয়া পুলিশ ক্যাম্প ও থানার পুলিশ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও ডাকবাংলোর সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থাগ্রহণের নির্দেশও দেই। তাকে আরও জানাই, গোপালগঞ্জ হতে রিজার্ভ পুলিশ লঞ্চযোগে মধুমতি নদী দিয়ে পাঠানো হচ্ছে। আমিও স্পীডবোটে করে অল্প সময়ের মধ্যে চলে আসছি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সে সময়ে টুঙ্গিপাড়ার চারদিকে অথৈই পানি। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে লঞ্চ, স্পীডবোট বা নৌকা ছাড়া যাওয়া সম্ভব ছিলো না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উত্তর পূর্ব কোণায় শেখ সায়রা খাতুন রেডক্রস হাসপাতালের পূর্ব দিকে একটা বিশাল দিঘী খনন করে পূর্বদিকের পাড়কে বড় আকারের মাঠের মতো করে ভরাট করা হয়। ঐ মাঠের উত্তর দিকে দোতলা ডাকবাংলো নির্মাণ করা হয় এবং ডাকবাংলোর দক্ষিণ আঙ্গিনায় হেলিকপ্টার নামানোর ব্যবস্থা রাখা হয়। দিঘীর পশ্চিমপাড়ে ছিলো টুঙ্গিপাড়া থানার টিনসেড অফিস ঘর এবং উত্তরপাড়ে সিকিউরিটি ফোর্সের থাকার সেড। দিঘীর দক্ষিণ পাড়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, শেখ সায়রা খাতুন হাসপাতাল ও টুঙ্গিপাড়া গ্রামে যাওয়া আসার রাস্তা।
আরও পড়ুন: ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়দের মারতে আর্মি আসতে পারে’
ওসি আব্দুল জলিলের সঙ্গে আলাপ শেষে অফিসে ফিরে এসডিওর দায়িত্বে থাকা লুৎফর রহমান চৌধুরীকে ঢাকা থেকে পাওয়া নির্দেশাবলীর বিষয়ে জানাই এবং আমাদের সাথে টুঙ্গিপাড়া যেতে অনুরোধ করি। এসডিও সাহেবের সাথে গত দুদিন ধরে যোগাযোগ হচ্ছে না বলেও তাকে জানাই। সম্ভব হলে তার সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানাতে বলি। এরপর টুঙ্গিপাড়ায় ফোর্স পাঠানোর জন্য এসডিওর লঞ্চ চাইলে তিনি তার ব্যবস্থা করে দেন। অফিসে উপস্থিত পরিদর্শক শেখ আব্দুর রহমানকে বলি, তাড়াতাড়ি লাইনে গিয়ে সেন্ট্রি ডিউটি রেখে বাকি সকল ফোর্সকে এসডিওর লঞ্চে করে টুঙ্গিপাড়া পাঠানোর ব্যবস্থা করতে।
এরপর স্পীডবোট চালক কনস্টেবল আব্দুস সাত্তারকে জ্বালানি নিয়ে বোট রেডি করতে বলে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। এ সময় ঢাকা হতে এসডিও বদিউর রহমানের ফোন আসে। তিনি বললেন, ‘টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর লাশ নেয়ার বিষয়টি জানেন কি?’ আমি জানি বলাতে তিনি বলেন লুৎফর রহমানকে আমার পক্ষে সব ব্যবস্থা করতে বলেছি। যে কোনও প্রয়োজন মোকাবিলায় সে সাধ্যমতো ব্যবস্থা নিবে। আমি তার প্রতিনিধি হিসেবে লুৎফর রহমানকে টুঙ্গিপাড়া পাঠানোর প্রস্তাব করলে তিনি জানান, লুৎফর সকাল থেকে অসুস্থ তাই যেতে পারবে না বলেছে। ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদের আপনার সঙ্গে যাবে। তাকে সাথে নিয়ে যান।
রেডি হয়ে অফিসে আসতেই দেখি ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদের, ইন্সপেক্টর শেখ আব্দুর রহমান, ইন্সপেক্টর শেখ ইছাক ফকির আমার সাথে টুঙ্গিপাড়া যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছে। ইন্সপেক্টররা জানালেন, এসডিও সাহেবের লঞ্চে করে দুজন সুবেদারের কমান্ডে ৪০জন ফোর্স টুঙ্গিপাড়া রওয়ানা করে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটসহ তারা আমার সাথে যাবার জন্য এসেছে। আমরা তাড়াতাড়ি দুজন অস্ত্রধারী কনস্টেবল নিয়ে থানার ঘাট হতে স্পীডবোটে করে টুঙ্গিপাড়া যাত্রা করি।”
চলবে…
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
‘দুপুরে মুজিবের লাশ টুঙ্গিপাড়া যাবে- সব ব্যবস্থা করেন’ ২য় পর্ব আজমল হক হেলাল মত-দ্বিমত সাক্ষাৎকার