সমাজতন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রভাব
১৫ আগস্ট ২০২২ ১৫:০৮
এক.
ছিয়ানব্বই সালের আগের কথা। সেইসময় আমাদের কাছে এখনকার মতো এতো গণমাধ্যম ছিলো না। ছিলো বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) আর গুটিকয়েক সংবাদপত্র। তাও সেখানে অকাট্য ইতিহাসনির্ভর আস্থার জায়গাটা ছিলো খুব আশাহত। একমাত্র সম্প্রচারমাধ্যম হিসেবে বিটিভি তো ছিল সঙ্কুচিত। পনের আগস্ট, সাত মার্চ এলে বিভিন্ন জায়গায় মাইক উঁচু করে বাজানো হতো বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত ভাষণ। আর কিছু দেশাত্ববোধক গান। আমরা শুনতাম সেগুলো। বেশ আগ্রহ নিয়ে। বড় বিস্ময় লাগতো। কী সুললিত-তেজদীপ্ত সেই ভাষণখানা। আহা! চোখ-মন জুড়িয়ে যেতো। সেটা ছিল অডিও। এই ছিল বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমাদের জানার জায়গা।
বঙ্গবন্ধু’র এ ঐতিহাাসিক ভাষণের ভিডিও দেখার সুযোগ আমাদের হয়নি। ছিয়ানব্বই সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলো। ওইদিনই বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি। দীর্ঘ ২১ বছর এ ভাষণটিকে বাক্সবন্দী করে রাখা হয়েছে। মনে হলো এই তো ‘বঙ্গবন্ধু’ আমাদের মাঝে আছে। কী এক আবেগপ্রবণ মুহূর্ত, কী এক জ্বাজল্যমান স্মৃতি। অনেক মানুষকে সেই সময় চোখের পানি ফেলতে দেখেছি। আমি বা আমার বয়সী যারা, তারা পঁচাত্তর পরবর্তী প্রজন্ম। এ প্রজন্মটি ছিয়ানব্বই সাল আসার আগে অনেক বিকৃতি অসত্যকে গিলে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক অকাট্য সত্য জানার সুযোগ আমাদের ছিল না। ইতিহাস তো ইতিহাসই। একে অস্বীকার করা যায়! ইতিহাসকে নিজের মতোন করে বানানো যায় না। ইতিহাসে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটি থাকবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা অনন্য। জনগণের সামনে অবস্থান নিয়ে, তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই তিনি রূপান্তরিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের স্থপতিরূপে।
কার্ল মার্কসের একটি উদ্বৃত্তি প্রণিধানযোগ্য, তা হচ্ছে—‘মানুষ তার নিজের ইতিহাস নিজে তৈরি করে, কিন্তু ইচ্ছেমতো তৈরি করতে পারে না।’
পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্ট নৃশংস্য হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে অনেক চেষ্টা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু নামটি নিশ্চিহ্ন করতে। আজ ৪৫ বছর পরও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা, ঐতিহাসিক আবেদন অনেক বেশি বলিষ্ঠ হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর অনেক ভাষণ-বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তার বক্তব্যে অনেকরকম জ্বালা আছে। অনেক বেদনার বর্হিপ্রকাশ আছে। খুব সম্ভবত খুব আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ আবার তিনি চাটার দল বলেও অভিহিত করেছেন তার আওয়ামী লীগকে। অনেক সত্যকে অনুধাবন ও উচ্চারণে তার পক্ষেই সম্ভব ছিল।
দুই.
সারাবিশ্বে সেই সময় সমাজতন্ত্রের প্রভাব পূর্ণমাত্রায় বহাল ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন বলিষ্ঠ সমর্থন দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে বড় মাপের ভূমিকা রাখে। তাছাড়া ষাটের দশকের পর আওয়ামী লীগের ইশতেহারের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি সংযোজন করা হয়। আবার সদ্য স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র শুরু হল। শুধু দেশের ভেতর থেকে নয়, দেশের বাইরেও ষড়যন্ত্র শুরু হলো। দেশে যখন খাদ্যের অভাব, তখন চাল বোঝাই জাহাজ হঠাৎ করে বাংলাদেশে না এসে অন্যদিকে চলে গেল। ফলে মানুষের ক্ষুধা-দেশে দুর্ভিক্ষ বেড়ে গেল। সেই সময় রাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করে অকার্যকর করে তোলা, পাটের গুদামে আগুন দেয়া, চাউল-চিনি-ময়দা-ডাল কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দিয়ে খাদ্যাভাব তৈরি করা, ধনী-গরীবের বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি করে নব্যধনীদের উত্থান হয়।
বঙ্গবন্ধু রুশ বিপ্লবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফলে তার দর্শনের মধ্যে নতুন করে সমাজতন্ত্র থাকলেও তার পথ যে সুগম নয়, অনেক কঠিন-এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের সুফল ভোগ করতে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ভাষণে ছাত্র সমাজের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোমাদের ইপ্সিত সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যকে বানচাল করার জন্য, তোমাদের আদর্শকে ধ্বংস করার জন্য শত্রুরা চারদিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে। তোমরা সংঘবদ্ধ থাকলে ওদের কীভাবে ঠা-া করতে হয়. তা ইনশাল্লাহ আমি জানি।’ ওই ভাষণে তিনি বলেন, রুশ বিপ্লবের প্রায় ৫০ বছর পর সোভিয়েত রাশিয়া সমাজতন্ত্র কায়েম করেছে।
‘কেমন বাংলাদেশ চাই’ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টিভি ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোন অগণতান্ত্রিক কথা নয়। আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতবদ্ধ। একটি নতুন ব্যবস্থার ভীত রচনার জন্য পুরাতন সমাজব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়বো।’ বঙ্গবন্ধু কার্ল মার্কস দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না, কিন্তু চীনের মাও সেতুংয়ের মতোন করে বাংলাদেশে একটি নয়া সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, এটি বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ছিল এ দেশের গণমানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক গভীর মানবিক সংগ্রামী দর্শন। এ দর্শনের ভিত্তিমূলে ছিল ঐতিহাসিক বিশ্বাস, যা কেবল জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে। এ দর্শনের স্পষ্ট প্রতিফলন- তাঁর সোনার বাংলার স্বপ্ন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন, শোষণ-বঞ্চনা-দুর্দশামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন।
তিন.
মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু লুটেরা পুঁজি ও নব্যধনীদের অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করেনি তা নয়। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন আওয়ামী লীগ যেহেতু একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক সংগঠন, সেহেতু এই সংগঠনেরও শ্রেণিচরিত্র বদল ঠেকানো যাবে না। উঠতি মধ্যবিত্তের শ্রেণিচরিত্র ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ দ্রুত উঠতি ও লুটেরা পুঁজিপতিদের শ্রেণিচরিত্র লাভ করবে। দেশ আবার সামন্তবাদী, সাম্প্রদায়িক ও বিশাল শ্রেণি-বৈষম্য ও বঞ্চনার দেশে পরিণত হবে। কেবল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে লিপিবদ্ধ করে শোষক পুঁজির বিকাশ ও থাবা থেকে দেশকে তিনি বাঁচাতে পারবেন না। ফলে তিনি জীবন বাজি রেখে তিনি আওয়ামী লীগের শ্রেণিচরিত্রকে পুঁজিবাদী প্রবণতা থেকে রক্ষা করে বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ কৃষক-শ্রমিকের শ্রেণিচরিত্র দ্বারা তাকে পুনঃগঠিত করতে চেয়েছিলেন। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কাঠামো সংকুচিত করে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাকশাল রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন।
বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাঙালি জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন তিনি। তাই স্বাবলম্ভিতা অর্জনের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজান নবগঠিত বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দেয়া তার বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তবে, এখানে যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা আমরা বলেছি, সে অর্থনীতি আমাদের, সে ব্যবস্থা আমাদের। কোনো জায়গা থেকে হায়ার করে এনে, ইমপোর্ট করে এনে কোনো ‘ইজম’ চলে না। এ দেশেÑকোন দেশে চলে না। আমার মাটির সাথে, আমার মানুষের সাথে, আমার কালচারের সাথে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে, আমার ইতিহাসের সাথে যুক্ত করেই আমার ইকনমিক সিস্টেম গড়তে হবে। কারণ আমার দেশে অনেক সুবিধা আছে। কারণ, আমার মাটি কী, আমার পানি কতো, আমার এখানে মানুষের কালচার কী, আমার ব্যাকগ্রাউন্ড কী, তা না জানলে হয় না। ফান্ডামেন্টালি আমরা একটা শোষণহীন সমাজ গড়তে চাই, আমরা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি করতে চাই। বাট দি সিস্টেম ইজ আওয়ার্স। উই ডু নট লাইক টু ইমপোর্ট ইট ফ্রম এনিহোয়ার ইন দি ওয়ার্ল্ড।’ বাংলাদেশে এখন আওয়ামী লীগ বাকশাল নাম, তার আদর্শ এবং তার শ্রেণিচরিত্রও ত্যাগ করেছে।
জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি বাংলাদেশের স্বপ্ন, এর জনগণের আকাঙ্খার কথা দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরেন। বাংলাদেশ কেন সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিল, কী তার ত্যাগ, কোন্ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রটির এসব ইতিহাস চমৎকারভাবে উঠে আসে তাঁর বক্তৃতায়। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ব্যাখ্যা করে সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন বাঙালির এ মহান নেতা। এ সময় সাধারণ সভার সভাপতি আলজিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুুল আজিজ বুতাফ্লিকা নিজ আসন থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে নেন। বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ান গলাবন্ধ কোট, কালো ফ্র্রেমের খুব মানানসই চশমা, আর ব্যাকব্রাশ করা চুলের বঙ্গবন্ধু। দীর্ঘদেহী স্মার্ট সুদর্শন আর আভিজাত্যপূর্ণ এক সৌম্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারেননি নানা দেশের প্রতিনিধিরা।
নাতিদীর্ঘ ভাষণের সূচনায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগিদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনভাবে বাঁচিবার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচিবার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাঁহারা বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাঙিক্ষত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন।’
১৯৭৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়ায় যান। সেখানে জোট নিরেপেক্ষ সন্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে শোষক শেণি আরেক ভাগে শোষিত শ্রেণি, আমি শোষিতের দলে।’
এই ভাষণের পরে কিউবার তখনকার রাষ্ট্রপতি, কিংবদন্তী বিপ্লবী ফিদেল কাস্ট্রো শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন, ‘তুমি আজ যে ভাষণ দিয়েছ, তারপর থেকে সাবধানে থেকো। আজ থেকে তোমাকে হত্যার জন্য একটি বুলেট তোমার পিছু নিয়েছে।’
ফিদেল কাস্ট্রোর সেই আকাঙ্খা সত্য হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হলো। রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্মম ও নৃশংসতার বিরল ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তীতে রাতারাতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেকগুলো বড় বড় পরিবর্তন আসল। প্রথমেই সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার মূল দুটি স্তম্ভকেও মুছে ফেলা হলো। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রাপ্তির যে মৌলিক চেতনা বুকে নিয়ে হিন্দ-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান আদিবাসী সবাই মিলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, অর্জন করেছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ রাতারাতি হলে গেল ‘ধর্মীয় বাংলাদেশ’। পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়ে দেওয়া হলো। তাই ১৫ আগস্ট আমরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হারাইনি, আমরা হারিয়েছি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকেও।
চার.
বঙ্গবন্ধু ছিলেন দেশপ্রেমে বিহ্বল। আজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীনভাবে লড়াই করে গেছেন। একটা সত্যকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, তা হচ্ছে শোষণহীন সমাজ, সাম্যমূলক সমাজ, কৃষক-শ্রমিক মুক্তির সমাজ। তিনি বাঙালি জাতীয়তা, বাঙালি সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সবার অজান্তে পাকিস্তান সমর্থক এবং সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র মেতে ওঠে।
১৯৭৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের উন্মুক্ত উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা শাসনতন্ত্র দিয়েছি। এর মধ্যে কোনো ঘোরানো ফেরানো কথার সুযোগ নেই। শাসনতন্ত্রে আমরা চারটি নীতিকে মেনে নিয়েছি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। …আমি যা মনে করি, আলজিয়ার্স কনফারেন্সে যেটা আমি বলেছিলাম, দুনিয়া আজ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। একটি শোষক, আরেকটি শোষিত। শোষিতের পক্ষে যারা থাকে, আর শোষকের পক্ষে যারা থাকে- তারা কে, তারা কারা, সে কথা দুনিয়ার মানুষ জানে। …সমাজতন্ত্র আমাদের প্রয়োজন। সমাজতন্ত্র না হলে এ দেশের দুঃখী মানুষের বাঁচবার উপায় নাই। আমরা শোষণহীন সমাজতন্ত্র চাই। …সমাজতন্ত্রের রাস্তা সোজা নয়। সমাজতন্ত্র করতে হলে যে ক্যাডারের দরকার, তা আমরা করতে পেরেছি কিনা এ নিয়ে আলোচনার দরকার আছে। …সমাজতন্ত্রের রাস্তায় আমরা যে পদক্ষেপ নিয়েছি, তা থেকে আমরা পিছু হটতে পারি না, পারবো না- যত বড় ষড়যন্ত্রই চলুক না কেন।’
বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা সম্পর্কে সিপিবি’র তৃতীয় কংগ্রেসের (২৪-২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮০) মূল্যায়ন ছিল এরকম, …বঙ্গবন্ধু এই নতুন স্বাধীন দেশের (বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠাতা। বহু অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করে তিনি দৃঢ়চিত্তে এদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন মহান দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী নেতা। দুনিয়াব্যাপী সমাজতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তি বিপ্লব এবং আমাদের দেশের জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রভাব এবং জনগণের প্রতি তাঁর দরদ তাঁকে ক্রমে প্রগতির ধারায় নিয়ে এসেছিল। আরও প্রগতির পথে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনাও তাঁর ছিল।
দ্বিতীয় কংগ্রেসের (৪-৯ ডিসেম্বর, ১৯৭৩) মূল্যায়ন করা হয়েছিল যে—‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমাজ বিপ্লবের প্রক্রিয়ার সূচনা হইয়াছে।’
পাঁচ.
বাকশাল গঠনে বঙ্গবন্ধু ভাষণ বর্তমান যুগে সত্য কথা বলা সবাই পছন্দ করে না। আর এই সত্যটা যদি তার বা সমগোত্রীয়দের বিরুদ্ধে যায়, তা হলে তো কথাই নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দেশটা রাতারাতি একশ্রেণির টাউট, বাটপার, ধান্ধাবাজ, টেন্ডারবাজ, চোরাকারবারি, মজুতদার আর চশমখোরদের দখলে চলে যায়। এরা তখন হয় মুক্তিযোদ্ধা অথবা আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড গলায় ঝুলিয়েছে। দেশে এই সব দুর্বৃত্তের কারণে একধরনের অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়। এদের অনেকে মুদি দোকানদার থেকে ব্রিফকেস-নির্ভর ব্যবসায়ী বনে যায় রাতারাতি। এরা যখন যে ব্যবসা সুবিধা পায় তখন সেই ব্যবসা করতো। অর্থাৎ ‘ফ্লাইং বিজনেসম্যান’। তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে লাভবান ব্যবসা হচ্ছে চোরাকারবারি অথবা নিত্যপয়োজনীয় পণ্যের মজুতদারি। এমন অরাজক অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করলেন। আসলে এটি কোন রাজনৈতিক দল ছিল না। ছিল একটা প্ল্যাটফরম। যারা দেশের স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে তাদের সকলকে তিনি এক পতাকা তলে আনার জন্য এই ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানে আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিভিন্ন পেশাজীবী ব্যক্তিবর্গ, সিভিল সোসাইটির সদস্যরা স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, চারদিকে যেভাবে দেশের শত্রুরা কিলবিল করছে তাদের সবাইকে এক প্ল্যাটফরমে আনতে হলে এমন একটি সহায়ক ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য এই ব্যবস্থার সঠিকভাবে প্রণয়ন হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন।
১৯৭৫ সালে সংসদে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি মাল্টি-ক্লাস পার্টি। আমি তার নামের আগে কৃষক শ্রমিক লাগিয়েছি বৈকি, কিন্তু দলটির চরিত্র এখনো বদলাতে পারিনি, রাতারাতি সব সম্ভবও নয়। আমার দলে নব্য-ধনীরাও আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় তাদের লুটপাটের সুযোগ বহুগুণ বেড়ে গেছে। আমি তাদের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই বাকশাল করেছি। যদি এই ব্যবস্থা সফল করতে ব্যর্থ হই এবং আমার মৃত্যু ঘটে তাহলে দলকে কবজা করে ওরা আরো লুটপাটে উন্মত্ত হয়ে হয়ে উঠতে পারে। এমনকি শত্রুপক্ষের নীতি ও চরিত্র অনুসরণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের মূলমন্ত্র, এমনকি আওয়ামী লীগের চরিত্র ও নীতি পালটে ফেলতে পারে। যদি তা হয়, সেটাই হবে আমার দ্বিতীয় মৃত্যু। সেজন্য আগেই বলেছি, আমার দল, আমার অনুসারীদের হাতেই যদি আমার এই দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটে, তাহলে দীর্ঘকালের জন্য বিস্মৃতির অন্ধকারে চলে যেতে হবে। কবে ফিরব তা জানি না।’ (সত্য কথা তো সকলে পছন্দ করে না : আবদুল মান্নান)
ছয়.
ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েলের একটি উক্তির উদ্ধৃতি দিতে চাই। তিনি বলেছিলেন, ‘সত্য হতে একটি সমাজ যত বেশি দূরে সরে যাবে তত বেশি যারা সত্য বলেন তারা ঘৃণার পাত্র হবেন।’ (The further a society drifts from truth the more it will hate those who speak it.) বঙ্গবন্ধুর ভুল অথবা দুর্বলতা সীমাবদ্ধতা নাই, এইভাবে ভাবা ঠিক নয়। তেমনি তার শক্তি, অবদান ও ভূমিকাকে খাটো করে দেখা ঠিক নয়।
লেখক: রাজনীতিবিদ ও লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি