প্রজন্ম, তুমি জেনে নাও বাংলাদেশকে
১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৩:০১
সুপ্রিয় প্রজন্ম,
তুমি কি জানো আজ আমাদের বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস নয়। আমাদের স্বাধীনতা দিবস ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ। আর বিজয় দিবস ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর।
এর মানে হলো, বাংলাদেশ নামের যে রাষ্ট্রে তুমি বসবাস কর, যে রাষ্ট্রের নাগরিক তুমি; তার জন্ম ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ। ইদানীং দেখছি, এগুলো খুব গুলিয়ে ফেলো তুমি।
তুমি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছো? আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তখনকার ঘোড়দৌড়ের মাঠ রেসকোর্সের ময়দানে) এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। আমাদের সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ৫ম তফসিলে এই ঘোষণাটির প্রতিটি শব্দ পেয়ে যাবে তুমি। এর শেষ লাইনটি ছিল ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
এই ‘মুক্তি’ আর ‘স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি তিনি সচেতনভাবেই আলাদা ক’রে উচ্চারণ করেছিলেন। ‘মুক্তি’ বলতে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক নির্যাতন থেকে মুক্তির কথা বুঝিয়েছিলেন। আর ‘স্বাধীনতা’ বলতে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে স্বাধীনতা অর্জনের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
তুমি মাঝেই মাঝেই পথ হারিয়ে ফেলো। তুমি বুঝতে পারো না – বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক কে? কে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি? পথ হারিয়ো না। আজকেই তুমি বাংলাদেশের সংবিধানটি সংগ্রহ কর। এর নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। সংবিধান মানে একটি রাষ্ট্রের ‘সর্বোচ্চ আইন’। যেকোনো বিষয়ে যদি সংবিধানে কিছু বলা থাকে সেটি আর আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করা যায় না।
আমাদের এই সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ৬ষ্ঠ তফসিলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা’ সন্নিবেশিত আছে।
“This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved”.
১৯৭১সালের ২৫মার্চ মধ্য রাত শেষে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ইপিআর-এর ট্রান্সমিটার, টেলিগ্রাম ও টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রচারিত হয়।
তোমার মত ‘বিভ্রান্তদের’ কারণে এটি নিয়ে একটি মামলাও হয়েছিল। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রীট পিটিশন নং-২৫৭৭/২০০৯-এ প্রদত্ত রায়ে স্বাধীনতার এই ঘোষণাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে স্বীকৃত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংবিধানে সন্নিবেশিত হবার পর তাই এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। এটি এখন একটি মীমাংসিত বিষয়।
তোমার ‘মগজ’ আরো গুলিয়ে দিচ্ছে আজকাল কিছু অমানুষ। তোমাকে অনেকেই চরম অশ্রদ্ধা মিশিয়ে বলেছে ‘শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন না’। যারা এদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘৃণা করে তারাই কেবল ‘জাতির পিতা’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দগুলো ব্যবহার করে না। ‘জাতির পিতা’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ ব্যবহার না করার পেছনেও রয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অবজ্ঞা এবং অশ্রদ্ধা করার এক ঘৃণ্য অপ-প্রয়াস। সে আলোচনা আরেকদিন করবো।
প্রজন্ম, তুমি নিশ্চই জানো, বাংলাদেশের প্রথম সরকার (মুজিবনগর সরকার) গঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে – মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায়। ঠিক ধরেছো, এই সরকার গঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই। আমাদের সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ৭ম তফসিলে এই সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি সন্নিবেশিত আছে। সেখানে শেষ পৃষ্ঠায় বলা আছে- “এতদদ্বারা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন ……”
“আমরা আরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে”।
কেন বঙ্গবন্ধুকেই প্রথম রাষ্ট্রপতি করা হলো এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে? আরেকটু পেছনে যেতে হয়ে তাহলে। ১৯৭০ এ পাকিস্তানে একটি সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পরাস্ত হয়। পাকিস্তানের জনগণ সরকার গঠনের ‘ম্যান্ডেট’ দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগকে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাষকগোষ্ঠী আমাদের মত ‘আউটক্লাসড’দের কাছে রাষ্ট্র ক্ষমতা দিতে চায়নি। যাইহোক, যুদ্ধ যখন অনিবার্য হয়ে যায় এবং জনগণের ম্যান্ডেট যখন আগে থেকেই ছিল, তখন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই মুজিবনগর সরকার গঠন সহজ হয়ে যায় এবং সেই সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আর কোনো অবকাশ থাকে না। তারপরও একটি মামলা হয়। অষ্টম সংশোধনী মামলায় মুজিবনগর সরকার কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট সংবিধানের মূল সূচনা (Genesis of the Constitution) হিসেবে আখ্যা দেয়।
সুপ্রিয় প্রজন্ম, তোমরা পথ হারিয়ো না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কোনো গোঁজামিল নেই। যারা তোমাদেরকে পদে পদে বিভ্রান্ত করতে চায় তাদেরকে চিনে রাখো, সতর্ক থাকো।
ভাল থেকো। সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খাঁন
পুরকৌশল বিভাগ,
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।