Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রানা প্লাজা, বাংলাদেশের আজীবনের ক্ষত


২৪ এপ্রিল ২০১৮ ১৬:০৭

।। জিমি আমির ।।

পাঁচ বছর হয়ে গেল রানা প্লাজা ধসের। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সাভারের অধর চন্দ্র স্কুলে শ’ শ’ লাশের সারি। বাতাসে নতুন পুরনো লাশের উৎকট গন্ধ। স্বজনদের গগনবিদারি আহাজারির মর্মান্তিক দৃশ্য। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে চোখের সামনে দেখেছি এ ঘটনাগুলো।

রানা প্লাজায় যে লাশটি উদ্ধার হচ্ছে তা সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাশের অধর চন্দ্র স্কুলে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা স্বজনরা খুঁজে নিচ্ছেন প্রিয়জনদের মরদেহটি। মরদেহগুলো কোনটা অক্ষত, আবার ওয়ারিশ না থাকায় দিনের পর দিন উন্মুক্ত অবস্থায় থেকে অর্ধগলিত হবার পথে, আবার কোনো লাশের শরীরের অনেক অংশ নেই। এই দৃশ্যগুলো কেমন তা নিজের চোখে না দেখলে অন্য কাউকে বিশ্বাস করানো প্রায় অসম্ভব।

অধর চন্দ্র স্কুলে কি সাংবাদিক, এনজিওকর্মী, যেই যাচ্ছেন না কেন, নতুন কাউকে পেলেই স্বজনরা আশায় দৌড় দিচ্ছেন। ছবি দেখিয়ে, আইডি কার্ড দেখিয়ে বলছেন, তাকে খুঁজে দিতে। এই অবস্থায় যে কারো পক্ষে স্বাভাবিক হয়ে থাকাটা কত যে কষ্টের এ শুধু ভুক্তভোগীই জানেন।

অথচ এর মাঝে সংবাদকর্মী হয়েও চোখের পানি আটকে একের পর এক লাইভ দিয়েছি। পাশ থেকে কেউ বলছেন মা আমার মেয়েটাকে খুঁজে দাও। কেউ বলছেন মা আমার ছেলেটার লাশ কিভাবে নিয়ে যাব? কেউ বলছেন, মা আমার পরিবারের ৩ জনই মারা গেছেন, কি হবে এখন আমার? আমি নির্মমভাবে সেই ঘটনাগুলোরই বর্ণনা দিচ্ছিলাম লাইভে। সত্যিই কি নির্মমতা। আমরা কাঁদতে পারি না। আমাদের কাঁদতে নেই!

রানা প্লাজা থেকে লাশ উদ্ধার হচ্ছে আর তা সাথে সাথে নিয়ে রাখা হচ্ছে অধরচন্দ্র স্কুলের বারান্দায়। সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের ব্ল্যাক বোর্ডে লেখা হচ্ছে মৃতের সংখ্যা। সেখান থেকেই একটা একটা সংখ্যা গুনে অফিসকে জানাচ্ছি। এই নির্মম বাস্তবতার মধ্যেই সবকিছুই যার যার কাছ থেকে সত্য।

বিজ্ঞাপন

রানা প্লাজা ধসের পর থেকেই সাংবাদিক, উদ্ধারকর্মী বা নির্দিষ্ট কেউ ছাড়া সেখানে কারো ঢোকা নিষেধ ছিল। নিচের তিন থেকে চারতলা পর্যন্ত ভেঙ্গে পরিণত হয়েছিল এক তলায়। যে পাশে সিঁড়ি ছিল সে পাশেই মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কারণ, ভেঙ্গে পড়ার সময় হুড়োহুড়ি করে সিঁড়ি দিয়েই সবাই নামতে চেয়েছিলেন। ওই পাশটায় যাওয়াই যায় না। বিকট গন্ধ, জীবনে এমন গন্ধ আমি আর পাইনি। নাকে কাপড় চেপেও টেকা যাচ্ছিল না। ছয় তলার ওপরে গিয়ে দেখলাম এমন গন্ধের মধ্যেই স্বেচ্ছাসেবী, উদ্ধারকার্মী সবাই যার যার কাজ করে যাচ্ছেন। নিজেদের কাজের পাশাপাশি নির্বিকারভাবে অনেককে খেতেও দেখলাম।

হঠাৎ করে কিছুক্ষণের জন্য অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিভাবে খাচ্ছে ওরা? কিন্তু একটু পরেই সে ভ্রম ভাঙ্গল। ভেবে দেখলাম পরিস্থিতি আবেগের নয়। প্রত্যেককেই অবিরতভাবে কাজ করতে হচ্ছে। তাই, কাজের পাশাপাশি বাকি দরকারি কাজগুলোও তো করে যেতেই হবে।

স্বেচ্ছাসেবী ছেলেমেয়েগুলোকে দেখলাম একমনে কাজ করে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওদের পরিবারের কাজ। প্রথম দুইদিন একনাগাড়ে চলেছে আহতদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা। এরপর শুরু হয়েছে লাশ খোঁজার কাজ। ওইদিন রানা প্লাজায় কতজন কাজ করছিল তার মোটামুটি একটি তালিকা বের করে নিজের মনে করেই তারা মরদেহগুলো খুঁজে বের করছে। কোথায় কোথায় মরদেহগুলো থাকতে পারে সেগুলো খুঁজে দেখার চেষ্টা করছে। চাপাপড়া লাশগুলো বের করতে দরকারি যন্ত্রপাতিগুলো দিয়ে সহায়তা করছে স্বেচ্ছাসেবী ছেলেমেয়েগুলো।

একদম নীচ থেকে কাউকে জীবিত বের করার যে দৃশ্য তার বর্ণনা দেওয়া মনে হয় কঠিনের চেয়ে বেশি কিছু। মনে আছে, একজন স্থুলকায় ব্যক্তি দুটি বীমের মাঝখানে পড়েছিলেন। গ্রীজ দিয়ে পিচ্ছিল করেও তাকে বের করা যাচ্ছিল না। আবার বীম কাটতে গেলে তার জীবনের আশংকা আছে। এই অবস্থার সমাধান কারো মাথায় নেই। তবু, সর্বোচ্চ চেষ্টাই ছিল তখনকার সেই উদ্ধারকর্মীদের। সত্যিই তাদের স্যালুট।

বিজ্ঞাপন

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রানা প্লাজা ট্রাজেডির খবর দ্রুত ছড়িয়ে গিয়েছিল দেশের বাইরেও। কারণ রানা প্লাজায় ছিল গার্মেন্টস কারখানা। এই খবরেই তোলপাড় শুরু হয় গোটা বিশ্বে। বিশ্ববাণিজ্যসংস্থার জেনারেলাইজড সিস্টেম অফ প্রিফারেন্সেস (জিএসপি) বাতিলে যেন শেষ পেরেক ঠুকলো রানা প্লাজা। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের একক বৃহত্তম বাজার ছিল বাংলাদেশের দখলে। এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে আলোচনা হল বাংলাদেশের জিএসপি বাতিল নিয়ে। ক্রেতারা হুমকি দিতে লাগল  বাংলাদেশ থেকে কাপড় না কেনার।

ইউরোপেও একই আলোচনা শুরু হল। বলা যায়, সবাই যেন গিলোটিন উঁচিয়েই রেখেছে কখন বাংলাদেশকে তার নিচে ফেলবে। করলোও তাই। বাতিল হলো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা–জিএসপি। ইউরোপ বাতিল না করলেও কড়া হুশিয়ারি দিয়ে বলল, কর্মপরিবেশ যথাযথ না হলে তারাও বন্ধ করবে জিএসপি। অর্থনৈতিক বিচারে জিএসপিতে বাংলাদেশ যে সুবিধা পায় তা থাকা না থাকায় কোনো কিছু যায় আসে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জিএসপি ছিল বাংলাদেশের ভাবমূর্তির প্রতীক।

রানা প্লাজা ট্রাজেডির আগে থেকেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন তুলেছিল আন্তর্জাতিক ক্রেতাগুলো। রানা প্লাজার পর এ নিয়ে বাংলাদেশের মুখে কুলপ আঁটা ছাড়া পথ রইল না। সেই সুযোগ নিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা। জন্ম নিল ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট—এ্যাকর্ড আর উত্তর আমেরিকাভিত্তিক ক্রেতাদের নিয়ে গঠিত জোট এ্যালায়েন্স।

বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য এই সংগঠনগুলোই এখন সার্টিফিকেট দিচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে। সরকারও কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। শ্রম আইন সংশোধন করার চেষ্টা করছে। চেষ্টা চলছে ট্রেড ইউনিয়নগুলো সচল করার।

বলা হচ্ছে, গত ৫ বছরে আগের চেয়ে পরিস্থিতি বদলেছে। সবশেষ এপ্রিল পর্যন্ত ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট এ্যাকর্ড চুরাশি ভাগ কারখানা পরিদর্শন শেষ করেছে। তাদের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ৯৬ শতাংশ কারখানায় কোলাপসিবল গেট বাদ দেওয়া হয়েছে, অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা চালু হয়েছে ৩৬ ভাগ কারখানায়, বের হওয়ার পথে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে ৮৯ শতাংশ কারখানায়।

অন্যদিকে, ২০১৩ সালে উত্তর আমেরিকাভিত্তিক ক্রেতাদের নিয়ে গঠিত হয় এ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি (অ্যালায়েন্স)। কানাডার হাডসন বে, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালমার্ট, গ্যাপের মতো কোম্পানিসহ মোট ২৮ ব্রান্ডের ক্রেতা জোট এ্যালায়েন্স। তাদের দাবি, ৬শ কারখানাকে ৯০ ভাগ দুর্ঘটনা প্রতিরোধের আওতায় এনেছে তারা। প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিককে তারা অগ্নি নির্বাপক নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্সের কাজে তারা সন্তুষ্ট। এই দুটি সংগঠনের কারণে বাংলাদেশ হারানো ভাবমূর্তি ফিরে পেয়েছে বলে মনে করেন বিজিএমইএ সভাপতি। তার মতে, প্রায় শতভাগ কারখানাতেই কর্মপরিবেশ ফিরে আসছে। যেসব কারখানায় এখনো পুরোপুরি পরিবেশ ফিরে আসেনি সেসব কারখানায় বার বার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, রানা প্লাজার পরেই ২০০৬ সালের শ্রম আইন সংশোধন করা হয়। সেই আইন অনুযায়ী প্রতিবছর শ্রমিকদের ৫ শতাংশ বেতন বাড়াতে হবে, শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে রপ্তানির দশমিক শুন্য ৩ শতাংশ অর্থ দিতে হবে। সেসব অগ্রগতি ধারাবাহিকভাবেই এগিয়ে চলছে।

রানা প্লাজার পরেই ক্রেতারা বলেছিল, তারা `মেড ইন বাংলাদেশ’ কিনবেন না। কিন্তু গত ৫ বছরে মালিকপক্ষ, সরকার মিলে যত উদ্যোগ নিয়েছে তাতে ক্রেতারা এখন উল্টো বলেন, `মেড ইন বাংলাদেশ উইদ প্রাইড’। পোশাক শিল্পে নেওয়া নানা উদ্যোগের ফলেই বিশ্বের কাছে এখন বাংলাদেশ প্রশংসিত হচ্ছে।

বিজিএমইএর আওতায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজারের মত তৈরি পোশাক কারখানা আছে। এর মধ্যে ৬শ কারখানা আধুনীকিকরণ না করতে না পারায় পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে। বাকি গুলোতে এখনো চলছে নানা ধরণের পর্যবেক্ষণ। তদারকি করছে, সরকার, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ’সহ অনেকেই।

আশির দশক থেকেই তৈরি পোশাক খাত দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে থাকে। এখন সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা আসে এই খাত থেকেই। আর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৪০ লাখের বেশি মানুষের সম্পৃক্ত হওয়া এই খাতটিতে সবার নজরও তাই বেশি। রানা প্লাজা তৈরি পোশাক খাতে যে ডিমেরিট পয়েন্ট যোগ করেছিল তা আজ হয়তো ম্লান। কিন্তু জিএসপি ফিরে না পাওয়ায় সেই ক্ষত আজীবনের জন্য রয়েই গেল।

 

লেখক : জয়েন্ট নিউজ এডিটর, সারাবাংলা ডট নেট

সারাবাংলা/ এসবি

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর