প্রজন্ম সতর্ক হও— ষড়যন্ত্র স্তরে স্তরে সাজানো
২৮ আগস্ট ২০২২ ১৬:০১
করোনাভাইরাস মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্বের মানুষের অর্থনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রভাব ফেলেছে।আমাদের দেশ বিশ্বের বাইরে নয়, তাই সঙ্গত কারণেই বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব কিছুটা এদেশেও পড়ছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, লোডশেডিং, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে আমাদের দেশের মানুষ সংকটে। কিন্তু এ সংকট একা আমাদের নয়, বা আমাদের কারণে হয়নি, এর জন্য দায়ী বিশ্ব চালানো বড় বড় নেতারা। বাংলাদেশ ভিকটিম।
কিন্তু এসব বাস্তবতা অস্বীকার করে একটি বিশেষ গোষ্ঠী অত্যন্ত সুচতুরতার সঙ্গে সরকারবিরোধী প্রচারে লিপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের এই সাময়িক ভোগান্তি যেন তাদের কাছে এক মহা-উদযাপনের উপলক্ষ হয়ে এসেছে। তাদের আচরণ, কথাবার্তা দেখে ও শোনে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির জন্য এতদিন কায়মন বাক্যে প্রার্থনা করে আসছিল তারা। বাংলাদেশ কেন শ্রীলংকার মতো দেউলিয়া হচ্ছে না—এ জন্য তারা সরকারের উপর ক্ষুব্ধ। তাদের কথাবার্তায় মনে হয়, সরকার কেন সংকট উত্তরণের জন্য পদক্ষেপ নিলো এটাই সরকারের দোষ। কেউ কেউ আবার দিন তারিখ দিয়ে ঘোষণা করে বসে আছেন কবে কখন বাংলাদেশ দেউলিয়া হবে। বলাই বাহুল্য, তাদের পূর্বাভাস বারবার পাগলের প্রলাপ বলে প্রমাণ হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তাদের কথিত বিশ্লেষণের ধারেকাছেও নেই, বরং সংকট কাটিয়ে উন্নতির দিকে অগ্রসরমান।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে মানুষের যে কষ্ট হচ্ছে এটা সরকার, সরকারি দল সকলেই স্বীকার করছেন। আমাদের হাতে এই মুহূর্তে কোনো বিকল্প নেই এটা সরকার তথ্য-উপাত্ত যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন। দেশের মানুষও তা বুঝতে পারছেন। তারা বিশ্বের অন্যান দেশের অবস্থা দেখছেন, তাতে তারা বুঝতে পারেন, বাংলাদেশ বহু উন্নত দেশ থেকে ভালোই আছে।
গত শুক্রবারই খবর এসেছে, যুক্তরাজ্যের গ্যাস ও বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আফজেম সেদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম ৮০ শতাংশ বাড়িয়েছে। আগামী ১ অক্টোবর থেকে নতুন দাম কার্যকর হবে। জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্সের মতো উন্নত সব দেশে জ্বালানি সাশ্রয়ে গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে নানা কঠোরতা আরোপ করেছে সরকার। এত সব খবর প্রতিনিয়ত চোখের সামনে দেখেও এক শ্রেণীর স্বার্থপর লোক প্রতিনিয়ত সকল দায় সরকারের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। দেশবিরোধী পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা এসব প্রচারণা চালাচ্ছে, চালাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার দুঃখের যায়গাটি হলো আমাদের নতুন প্রজন্মের একটি অংশ চরমভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বার্থপর হয়ে বেড়ে উঠেছে। দেশ ও জাতি নিয়ে তাদের যেন কোনো দায় নেই। শুধু হাসি ঠাট্টা করতে গিয়ে তারা দেশবিরোধী শক্তির গুটিতে পরিণত হচ্ছে।
সরকার জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য যেসব নীতি গ্রহণ করেছে তা বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশেরই লাভ। কিন্তু এসব সিদ্ধান্তকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে দেশের ক্ষতি করছে ওই দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রজন্ম। খুব অবাক হয়ে যাই তাদের চিন্তার বিকাশ এতো নিচে নামল কিভাবে? আমাদের কি বিবেক কমে যাচ্ছে? খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয়, বিএনপি-জামাতের শাসন আমলে আমাদের কি প্রতিবাদ করার জায়গা ছিল? ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট কি এদেশে ঘটেনি? সেই ঘটনাগুলো কারা ঘটিয়েছে, কেন ঘটিয়েছে তা কি আমাদের তরুণ প্রজন্মরা ওয়াকিবহাল? আমার তো মনে হয় তারা চরমভাবে বিভ্রান্ত।
এরা সেই সুবিধাভোগী প্রজন্ম যারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত স্তরে স্তরে তৈরি হয়েছে। নানাভাবে বাংলাদেশবিরোধী গোষ্ঠী প্রজন্মের মনমানসিকতাকে দূষিত করেছে। তারা এখন এতটাই নিজস্ব লাভ-ক্ষতিতে মনোযোগ দিয়েছে যেখানে দেশের ভালো-খারাপ নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই। তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আর বিপক্ষের শক্তিকে এক করে দেখতে শিখেছে। এতে করে তারা ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের যে মানবিক কারণে প্রতিবাদের প্রয়োজনীয়তা আছে সেটাও করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে মানুষ হিসেবে তারা অমানবিক এবং দ্বৈতনীতিসম্পন্ন হয়ে উঠছে।
কয়েক বছর আগে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক সংসদ ভবনে বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শন করেছিলেন। সেখান থেকে একটি লেখা আজকের প্রজন্মের জন্য-
“কেউ আছেন, যিনি ইতিহাস হয়ে আসেন না
বরং তার থেকেই শুরু হয় ইতিহাস।
কেউ আছেন,যখন একা দাঁড়ান না, দাড়ায় লক্ষ কোটি জনতা,স্বাধীনতা, দাড়ায় একটি জাতি।
তেমনি এক কিংবদন্তী শেখ মুজিবুর রহমান
রাজনীতির কবি,আমাদের বঙ্গবন্ধু, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বিশ্বজুড়ে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্থপতি।
৫৫ বছরের জীবন।
১২ বছরের অধিক কেটেছে কারাগারে,জীবনের অর্ধেক কেটেছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে।পুরো জীবন গেছে স্বাধীনতা নির্মাণে।
সেই স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর।
তারই ভূখণ্ড এ সপরিবারে সজ্জনসহ নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাকে
১৫ আগস্ট ১৯৭৫”
বঙ্গবন্ধুর জীবন কিন্তু ৬০ বছরেরও কম। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তাকে হত্যা করে খুনিরা। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর বেঁচে ছিলেন। এর আগে তার জীবনের ১৩টি বছর কেটেছে কারাগারে। ১৮ বছর থেকে যদি ৫৪ বছর বয়স পর্যন্ত ধরি তাহলে পাওয়া যায় ৩৬ বছর। অর্থাৎ, কৈশোর পার হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বেঁচেছেন ৩৬ বছর। এর মধ্যে ১৩ বছর তিনি কারাগারেই কাটিয়েছেন। বাকিটা শুধু আপসহীন সরকারবিরোধী রাজনীতি করেছেন। দেশ ও জাতির জন্য এই ত্যাগ যদি প্রজন্মকে স্পর্শ করতে না পারে তাহলে তারা নিজের ক্ষতিই বেশি করবে। আর প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জাতি।
বর্তমান এই অবস্থার জন্য আমি মনেকরি ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগেরও কিছু দায় আছে। ছাত্র রাজনীতিতে এখন সহমত ভাই, রাইট ভাই এ ধরনের শব্দের ব্যবহার অনেক বেশি। সত্য-মিথ্যা ভালো-মন্দ যাচাই করার সময় নেই। কারণ এ ধরনের শব্দগুলো ব্যবহার করতে পারলেই একশ্রেণীর প্রভাবশালী নেতাদের কাছে ভালো হয়ে থাকা যায়, তার আনুগত্য পাওয়া যায়। সত্যি কথা বলতে গেলে রাজনীতি করতে গেলে শিষ্টাচার জানা এবং মানার যে একটা প্রক্রিয়া আছে তা বর্তমান সময়ে নাই বললেই চলে। ছাত্ররাজনীতি করতে গেলে যে নির্ভীক সাহসী হতে হয় তার অভাব রয়েছে এখন। সহমত ভাই, রাইট ভাই শব্দ সাহস ও নির্বিকতার নয়। এসব শব্দ সুবিধাভোগী এবং মেরুদণ্ডহীনতার প্রতীক।
আমরা জানি বাংলাদেশবিরোধী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র স্তরে স্তরে সাজানো। তারা হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে ব্রেনওয়াশ সবই করে আসছে। যদি আমাদের তরুণ প্রজন্ম এবং ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা সৎসাহসী, ত্যাগী, বুদ্ধিমান, মানবিক ইত্যাদি গুণাবলি আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হয় তাহলে ওই কালো শক্তির ষড়যন্ত্রে পা দেবে। ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর সুপরিকল্পিত ফাঁদে তারা আটকে পড়বে। তাই প্রজন্মের উচিত শুধু নিজ স্বার্থ আর সস্তা অনলাইন জনপ্রিয়তার আশায় যা ইচ্ছা তাই স্রোতে গা না ভাসিয়ে সতর্কতারও প্রয়োজনও আছে। না হলে নিজের পাশাপাশি বড় ক্ষতি হয়ে যাবে দেশ ও জাতির।
লেখক: সদস্য, আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
সারাবাংলা/আইই